X
রবিবার, ০৮ জুন ২০২৫
২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

পোশাক শিল্পের জন্য বাজেটে আমাদের যে প্রত্যাশা

মো. মহিউদ্দিন রুবেল
০২ জুন ২০২৫, ২০:২৯আপডেট : ০২ জুন ২০২৫, ২৩:১৭

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা, ৪০ লাখ শ্রমিক ভাইবোনের রুটি-রুজির উৎস বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প খাত। বেসরকারি উদ্যোগে সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী এই খাতটি বর্তমানে বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে সঙ্গিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা পাল্টা শুল্ক, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল, উচ্চ ব্যাংক সুদ, মজুরি বৃদ্ধি এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের ঘন ঘন মূল্য বৃদ্ধির চাপে শিল্পটি পিষ্ট।

অন্যদিকে, আগামী বছরেই অর্থাৎ ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হচ্ছে। এই গ্র্যাজুয়েশনের ফলে রফতানিতে ৮৪ শতাংশ অবদান রাখা পোশাক শিল্প সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে চলেছে। কারণ তখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুবিধাগুলো প্রত্যাহার করা হবে, যা শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতায় সরাসরি আঘাত করবে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর রফতানি সাড়ে ৫ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। এই হ্রাসের মূল কারণ হবে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা (যেমন- জিএসপি) হারানো।

তাই আগামী দিনে পণ্য রফতানি, বিশেষ করে পোশাক রফতানি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে চলেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এ পরিপ্রেক্ষিতে এবারের বাজেট পোশাক শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশা করছি, বর্তমানে শিল্পের বিরাজমান সমস্যাগুলো মোকাবিলা এবং গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী সময়ে শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখার ব্যাপারে আসন্ন বাজেটে সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা থাকবে।

এ মুহূর্তে সরকারের কাছ থেকে আমরা যে নীতি সহায়তাগুলো আশা করছি, সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হলো:

করপোরেট কর হার:

আমরা আশা করছি, বর্তমান সংকটকালীন সময়ে পোশাক শিল্পের করপোরেট কর হার ১২ শতাংশ অব্যাহত রাখা হবে। উল্লেখ্য, ১২ শতাংশ বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে আমরা আরও বেশি করপোরেট কর দিই। সরকার উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে অগ্রিম কর আদায় করে, যদিও সেই টাকা আর ফেরত পাওয়া যায় না। তাই করপোরেট করের বর্তমান হার অব্যাহত রাখা যুক্তিযুক্ত।

উৎসে কর

বর্তমানে আমাদের রফতানির বিপরীতে ১ শতাংশ হারে উৎসে কর দিতে হচ্ছে। শুরুতে এটি ০.২৫ শতাংশ ছিল, তারপর ০.৫০ শতাংশ করা হয়। এখান থেকে আবার ০.৬০ শতাংশ করা হয়। তারপর এক লাফে উৎসে কর ১ শতাংশ করা হয়, যা শিল্পের সক্ষমতা কমিয়ে দেয়। আমরা চাই নতুন অর্থবছরে বাজেটে রফতানির বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে কর আগের মতো ০.৫০ শতাংশ এ নামিয়ে আনা এবং ৫ বছরের জন্য তা বলবৎ রাখা হোক। এটি করা হলে উদ্যোক্তারা আত্মবিশ্বাসের সাথে মধ্যমেয়াদি ব্যবসায়িক ও বিনিয়োগ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারবেন।

ম্যান মেইড ফাইবার

আমাদের শিল্পের অন্যতম একটি দুর্বল দিক হলো, শিল্পে কটন নির্ভরশীলতা রয়ে গেছে, যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নন-কটন পোশাকের রফতানি প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক। অথচ টেকসই ও পরিবেশ বান্ধব পোশাকের জন্য চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক পোশাক বাজারে ক্রেতাদের নন-কটন পণ্যের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। যেখানে বিশ্বে মোট টেক্সটাইল কনজাম্পশনের প্রায় ৭৫ শতাংশ নন-কটন, এবং কটনের শেয়ার মাত্র ২৫ শতাংশ; বর্তমানে বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্যের ৫২ শতাংশ পণ্য নন-কটনের, সেখানে আমাদের নন-কটন পোশাকের রফতানির মাত্র ২৬ শতাংশ। তাই নন-কটন পণ্যে আমাদের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে এবং সরকারের নীতি সহায়তার বলে আমরা এ চেষ্টাকে আরও ত্বরান্বিত করতে চাই।

আমাদের প্রত্যাশা, আসন্ন বাজেটে নন-কটন পণ্যের বৈশ্বিক বাজার এবং আমাদের রফতানি  সম্ভাব্যতা বিবেচনায় নিয়ে এখাতে বিনিয়োগ ও রফতানি উৎসাহিত করতে এবং প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে নন-কটন পোশাক রফতানির ওপর বিশেষ প্রণোদনা থাকবে। এই বিশেষ প্রণোদনা প্রদান করা হলে আমাদের রফতানি বাড়বে, নতুন বিনিয়োগ আসবে, কর্মসংস্থান বাড়বে, এর সাথে সংশ্লিষ্ট সেবা খাতে ব্যাপক সুযোগ তৈরি হবে, সর্বোপরি সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বাড়বে।

সার্কুলার ফ্যাশন ও রিসাইকেল পণ্য

সার্কুলার ফ্যাশন আজ সাসটেইনেবল ফ্যাশন এজেন্ডার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিজিএমইএ পরবর্তী প্রজন্মকে একটি পরিচ্ছন্ন পৃথিবী উপহার দিতে ফোর আর তথা রিইউজ, রিডিউস, রিসাইকেল, রিকভার ধারণার বাস্তবায়ন নিয়ে কাজ করছে। আমাদের কারখানাগুলো নতুন নতুন টেকনোলজি ব্যবহার ও প্রসেস আপগ্রেডেশনের মাধ্যমে তাদের অপচয় কমিয়ে আনছে। বর্তমানে প্রতি বছর টেক্সটাইল ও পোশাক খাত থেকে প্রায় ৫ লাখ টনের মতো ঝুট তৈরি হয়। এর একটি অংশ আমরা প্রায় রফতানি করে থাকি, যার মাধ্যমে বছরে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার আয় হয়। আমরা যদি এ ঝুটগুলো রিসাইকেল করতে পারি, তবে তা দিয়ে আমরা প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পণ্য উৎপাদন করতে পারবো, যা আমাদের দেশজ প্রবৃদ্ধি আনবে। এই বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা সরকারকে অনুরোধ করেছি যেন রিসাইকেলিং শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সব প্রক্রিয়া, পণ্য ও সেবাকে শুল্ক ও ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হয়। ফলে বিনিয়োগকারীরা এ খাতে আকৃষ্ট হবেন। আশা করছি, আসন্ন বাজেটে এর প্রতিফলন থাকবে।

শ্রমিক ভাইবোনদের জন্য রেশনিং

বর্তমানের জীবনযাত্রার ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধির কারণে শ্রমিক ভাইবোনেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে দিশেহারা। তাদের জন্য যদি রেশনিং, ফেয়ার শপ করে দেওয়া হয়, তবে তা কিছুটা হলেও তাদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিবে। তারা সন্তুষ্টি নিয়ে কাজ করবে। আমরা চাই, তৈরি পোশাক খাতে সরকার কারখানা ভেদে শ্রমিকদের জন্য রেশন ব্যবস্থা চালু করুক।

পোশাক শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় কমানোর বিকল্প নেই।

এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু চাওয়া হলো:

১. শতভাগ রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের বিভিন্ন পণ্য ও সেবাকে শতভাগ ভ্যাটমুক্ত করা।

২. কারখানাকে আধুনিক, নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত এবং পরিবেশবান্ধবে এবং পরিচালনা ব্যয় সাশ্রয় করতে আরও তালিকার বাইরে থাকা কিছু অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি ও উপকরণসমূহ শুল্কমুক্ত/রেয়াতি হারে আমদানির অনুমোদন দেয়া।

৩. পরিবেশবান্ধব শিল্প স্থাপন ও জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য সোলার পিভি সিস্টেমের সবগুলো সরঞ্জাম আমদানিতে শুল্ক রেয়াত প্রদান।

আমদানি-রফতানি কার্যক্রম সহজীকরণ

 আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, আমদানি-রফতানি কার্যক্রম আরও সহজ করতে হবে। সহজীকরণ না হলে আমরা ক্রেতা হারাব। কারণ আমরা যে ব্যবসাটা করি সেটা হলো ফ্যাশন বেইজড, টাইম বেইজড। এক দিন দেরি হলে সমস্যায় পড়তে হয়ে। দুই দিন দেরি হলে অর্ডার বাতিল হয়ে যায়। তাই আমদানি করা মাল যেন দ্রুত খালাস করাতে পারি, আবার রফতানির সময় যেন দ্রুত পণ্য পাঠাতে পারি, সে ব্যাপারে নিয়মকানুন আরও সহজীকরণ করা জরুরি।

বন্ড ব্যবস্থাপনায় আমদানি পণ্যের চালান খালাসের সময় জটিলতা নিরসনে এইচএস কোড সহজ করা দরকার।

আসন্ন গ্র্যাজুয়েশনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের অর্থনীতির ধারা অব্যাহত রাখতে পোশাক শিল্পকে অবশ্যই সুরক্ষা দিতে হবে। শিল্পের জন্য যেকোনও ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে, তা সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব রাখবে, যা মোটেও কাম্য নয়। আশা করি বাজেটে শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা থাকবে।

লেখক: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি; উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাতীয় নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ নিতে কতটা প্রস্তুত পুলিশ
জাতীয় নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ নিতে কতটা প্রস্তুত পুলিশ
লন্ডনে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য আলোচনায় বসছে সোমবার
লন্ডনে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য আলোচনায় বসছে সোমবার
সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে কোরবানির বর্জ্যমুক্ত হলো চট্টগ্রাম
সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে কোরবানির বর্জ্যমুক্ত হলো চট্টগ্রাম
শাকিব খানের ‘তাণ্ডব’ চলাকালে কারিগরি ত্রুটি, ছায়াবাণী হলে ভাঙচুর-লুট
শাকিব খানের ‘তাণ্ডব’ চলাকালে কারিগরি ত্রুটি, ছায়াবাণী হলে ভাঙচুর-লুট
সর্বশেষসর্বাধিক