‘পুকুর চুরি’ শব্দের সঙ্গে সবাই পরিচিত। অর্থও অজানা নয়। প্রাচীন ভারতে যৌথ সম্পদ সংরক্ষণ করা হতো ধর্মীয় গুরু ঋষির তত্ত্বাবধানে। যা পরিচিতি পেয়েছিল ‘ঋষির পুকুর’ হিসেবে। মূলত সরকারি সম্পদ চুরিই ‘ঋষির পুকুর’ থেকে ‘পুকুর চুরি’ নামে প্রবাদে স্থান পায়। পরবর্তীতে বড় সব রকমের চুরি ‘পুকুর চুরি’ নামে অভিহিত করা হয়।
অনেক বছর আগের কথা। ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ‘পুকুর চুরি’ বিষয়ক একটা গল্প শুনেছিলাম। ঢাকা কলেজের ভেতরে বেশ বড় একটি পুকুর আছে। ছাত্র রাজনীতির এক নেতা-ক্যাডার এই পুকুর বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কেন এবং কিভাবে? প্রেমিকাকে উপহার দেওয়ার জন্য অর্থের প্রয়োজন। ঢাকা কলেজ সংলগ্ন নিউ মার্কেটে তখন নির্মাণ কাজ চলছে। নির্মাণ কাজের পানি দরকার। শুষ্ক মৌসুম, আশেপাশে কোথাও পানি নেই। ঠিকাদার যোগাযোগ করলেন সেই নেতা-ক্যাডারের সঙ্গে। ছাত্রনেতা পুকুরের পানি বিক্রি করে দিলেন ঠিকাদারের কাছে। রাতে মেশিন দিয়ে পানি টেনে নেওয়া হলো। সকালে ছাত্র-শিক্ষকরা দেখলেন পুকুর প্রায় পানিশূন্য। এই পুকুর বিক্রির অর্থ দিয়ে সেই নেতা প্রেমিকাকে স্বর্ণের লকেট উপহার দিয়েছিলেন।
‘পুকুর চুরি’র এমন প্রত্যক্ষ গল্প দ্বিতীয়টি শুনিনি। তবে আজকের আলোচনার বিষয় পুকুর চুরি নয়, ‘সাগর চুরি’। ‘সাগর চুরি’র ঐতিহাসিক কোনও প্রেক্ষাপট আছে কিনা জানি না। জানার চেষ্টাও করছি না। ‘সাগর চুরি’ মানে বড় চুরি তা জানার বা বোঝার জন্য তো আর অভিধান খোঁজার দরকার নেই।
‘সাগর চুরি’ বিষয়ক অর্থমন্ত্রীর স্বীকারোক্তি গণতন্ত্র, উন্নয়ন, আইনের শাসন বিষয়ে কিছু কথা।
১. ‘উন্নয়নের চাবিকাঠি গণতন্ত্র, আইনের শাসন’- বলেছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। আমরাও তাই বলি। যদিও তার অস্তিত্ব এখন বাংলাদেশে নেই। এখন যে ‘সাগর চুরি’ হচ্ছে, গণতন্ত্র থাকলে কি এমন ঘটনা ঘটত না? যখন গণতন্ত্র বা নির্বাচন প্রক্রিয়া সঠিক ছিল, তখন কি সাগর চুরির ঘটনা ঘটেনি?
নির্বাচন প্রক্রিয়া যখন সঠিক ছিল তখনও চুরি হয়েছে, পুকুর চুরি হয়েছে, সাগর চুরি নয়। নির্বাচন প্রক্রিয়া সঠিক থাকলেও যে এই চুরি বন্ধ হয়ে যেত তাও নয়। হয়ত ‘সাগর চুরি’র ঘটনা ঘটত না। ঘটত না কারণ, নির্বাচন বা জনমত বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের ভেতরে একটা শঙ্কা কাজ করত। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর থেকে ক্ষমতাসীনদের ভেতরে সেই শঙ্কা কাজ করে না।
ফলে নজীরবিহীন নৈরাজ্যকর অবস্থায় রূপ নিয়েছে আর্থিক খাত। ‘পুকুর চুরি’ পরিণত হয়েছে ‘সাগর চুরি’তে। চলছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে।
২. বড় প্রকল্পের দুর্নীতি বিষয়ে অনেক বলেছি, লিখেছি। আজ তার পুনরাবৃত্তি করছি না। আর্থিক খাতের নৈরাজ্যের, ভিন্ন রকমের ‘সাগর চুরি’র কিছু প্রসঙ্গ উল্লেখ করছি।
ক. ৫ লাখ ভারতীয়সহ কমপক্ষে ১০ লাখ বিদেশি কাজ করেন বাংলাদেশে। বৈধভাবে অনুমতি নিয়ে কাজ করেন মাত্র ১৬ হাজার। বাংলাদেশে শিক্ষিত-যোগ্য-দক্ষ কত মানুষ বেকার, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। যা আছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
খ. অভিজ্ঞ বাজার বিশ্লেষকরা বলেন, যত বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করেন, তার ৫% থেকে ৭% দক্ষ জনবল আমাদের দরকার আছে। ৯৩% থেকে ৯৫% বিদেশিদের কোনও দরকার নেই, এই মানের লোকবল দেশেই আছে। দেশের লোকবল দক্ষ করার জন্য কিছু উদ্যোগ নিলেই সমস্যার সমাধান করা যায়।
গ. ৫ লাখ ভারতীয় প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৩.৭৬ বিলিয়ন ডলার ভারতে পাঠায়। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৩০ হাজার কোটি। এটা গত বছরের হিসেব। এবং অর্থের প্রায় পুরোটা থেকে ট্যাক্স বঞ্চিত হয় বাংলাদেশ। ভারত সারা পৃথিবী থেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে, বাংলাদেশ সেখানে ৫ম অবস্থানে রয়েছে।
কর্মরত ৫ লাখ ভারতীয় ৯৫% থেকে ৯৮% বৈধ ভিসা, কাজের অনুমতি না নিয়ে কাজ করেন। যে কারণে তারা ট্যাক্স ফাঁকি দিতে পারেন। ট্যাক্স ফাঁকি দিতে পারেন দেশিয় উদ্যোক্তাদের সহায়তাতেই।
ঘ. পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, আফ্রিকাসহ আরও বিভিন্ন দেশের ৫ লাখ বিদেশি কাজ করছে বাংলাদেশে। তারাও বৈধ কাজের অনুমতিপত্র ছাড়া কাজ করছেন এবং ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। ১০ লক্ষাধিক বিদেশিরা প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন।
ঙ. আর্থিক খাতের সামগ্রিক বিশৃঙ্খলার একটা ছোট্ট দিক এটা।
আরও পড়তে পারেন: বাজেট আলোচনায় বক্তা নেই, আগেভাগে অধিবেশন মুলতবি
৩. ‘জনগণ অর্থ না দিলে, সরকার কিভাবে কাজ করবে’- বলেছেন এনবিআরের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান। খুব ভালো কথা। জনগণকে অবশ্যই কর দিতে হবে। ১০ লাখ বিদেশি যে ট্যাক্স না দিয়ে প্রতিবছর ৫ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে, তা দেখবে কে? শুধু ঘোষণা দিলেই হবে, ‘তাদের করের আওতায় আনা হবে!’ জনগণ সরকারকে অর্থ দেবে, সরকার জনগণের কথা বলে বিদেশ থেকে ঋণ আনবে, কাজ করার জন্য। জনগণের জন্য যা কিছু ভালো, তা করার জন্য। সেই অর্থ এভাবে ‘সাগর চুরি’র নামে দৃশ্যমানভাবে লুটপাট হয়ে যাবে, আর জনগণ অর্থ দিয়েই যাবে? দৃশ্যমান লুটেরারা দেশে বিদেশে সম্পদ গড়ে তুলবে, কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, নেওয়া যাবে না? তারা লুট করবে, আর জনগণ অর্থের যোগান দিয়ে যাবেন?
৪. অর্থমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে স্বীকার করছেন আর্থিক-ব্যাংকিং খাতে ‘সাগর চুরি’ হচ্ছে। এই সংসদে দাঁড়িয়েই তিনি বলেছিলেন, চোর ধরতে বা ব্যবস্থা নিতে পারছেন না ‘রাজনৈতিক কারণে’। যদি লুটেরাদের রাজনীতির কারণে ধরা না যায়, ব্যবস্থা নেওয়া বা চুরি থামানো না যায়, এই স্বীকারোক্তিতে জনগণের কিছু আসে-যায় না। আপনার অধীনে ব্যাংকিং খাত, ‘সাগর চুরি’ হয়ে যাবে আর আপনি তা দেখবেন, স্বীকার করবেন! শুধু স্বীকার করার মধ্যে আপনার কাজ সীমীত থাকতে পারে না। স্বীকার বা আক্ষেপ করছেন কার কাছে, ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব তো আপনারই। রাজনীতির কারণে চোর ধরতে না পারলে, পদে থাকার দরকার কি? দেশের মানুষের সঙ্গে এমন তামাশা করা উচিত নয়। রাষ্ট্র চোরদের পাহারাদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে না।
৫. বড় প্রকল্পের ‘সাগর চুরি’ ছাড়া গত চার বছরে সড়ক উন্নয়নের নামে ব্যয় করা হয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকা। নতুন এক কিলোমিটার সড়ক বাড়েনি। পুরনোগুলোর অবস্থা কী, সবারই তা জানা আছে। কেমন ‘সাগর চুরি’ হয়েছে এক্ষেত্রে, তা বোঝার জন্যে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার হয় না।
৬. এখানে আলোচনা করছি এখন পর্যন্ত জানা গেছে, তেমন অল্প কয়েকটি ক্ষেত্রের ‘সাগর চুরি’। আরও বড় চুরি আলোচনা করছি না, পুনরাবৃত্তি হবে বলে। লেখা শেষ করি একটা ভিন্ন রকমের ঘটনা জানিয়ে।
কানাডিয়ান তেল-গ্যাস উত্তোলন কোম্পানি নাইকো। টেংরা টিলা গ্যাস ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বাংলাদেশের প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার গ্যাস সম্পদ ধ্বংস করেছে।
দেশের আদালতের নির্দেশনায় নাইকোর টাকা আটকে রেখেছে বাপেক্স। নাইকো মামলা করেছে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপুটেড (ইকসিড)’-এ। বর্তমান সংখ্যা ‘সাপ্তাহিক’-এ সাংবাদিক আনিস রায়হান একটি বিস্তারিত রিপোর্ট করেছেন বিষয়টি নিয়ে। এই মামলায় বাংলাদেশের পক্ষের আইনজীবীরা যথাযথ কাগজপত্র আদালতে উপস্থাপন করেননি। নাইকোর আইনজীবীরা যা দাবি করেছেন, কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষের আইনজীবীরা তা সমর্থন করেছেন। নাইকোকে বিজয়ী করার জন্যে, বাংলাদেশকে পরাজিত করার জন্যে, যা করা দরকার, তাই করেছেন বাংলাদেশের পক্ষের আইনজীবীরা। বাংলাদেশ তাদেরকে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছিল। এই মামলায় বাংলাদেশের পক্ষের আইনজীবী তৌফিক নেওয়াজসহ আরও কয়েকজন। তৌফিক নেওয়াজ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির স্বামী। আইনজীবী তৌফিক নেওয়াজদের এই কর্ম বুঝতে পেরে, জ্বালানি মন্ত্রণালয় দ্রুতগতিতে তাদের পরিবর্তন করে অন্য আইনজীবী নিয়োগ দেন। ততদিনে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। নাইকোর কাছে পরাজিত হয়েছে বাংলাদেশ। ২৭৫ কোটি টাকাসহ বাংলাদেশকে হারাতে হয়েছে আরও অনেক কিছু। অথচ এই মামলায় সবকিছুই ছিল বাংলাদেশের পক্ষে।
আরও পড়তে পারেন: কানাডা প্রবাসী তামিম চৌধুরীই আইএস-বাংলাদেশের আবু ইব্রাহিম!
নাইকো ইতিমধ্যে কানাডার আদালতে দুর্নীতিগ্রস্ত কোম্পানি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপি সরকারের জ্বালানিমন্ত্রী মোশারফ হোসেনকে ৫ হাজার ডলার এবং গাড়ি ঘুষ দেওয়ার অপরাধ নাইকোর বিরুদ্ধে প্রমাণ হয়েছে কানাডার আদালতে। এই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানটির কাছে বাংলাদেশ পরাজিত হয়েছে মূলত আইনজীবীদের উল্টো ভূমিকা পালন করার কারণে। এখন বাংলাদেশ নাইকোর বিরুদ্ধে ৯ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা দায়ের করেছে। নাইকোর অন্যায্য যুক্তি মেনে নিয়ে, একবার পরাজিত হয়ে, ক্ষতিপূরণ মামলায় কতটা সুবিধা করা যাবে, বড় প্রশ্ন সেটা।
নাইকোর পক্ষে বিএনপি-আওয়ামী লীগের সময়ের আমলাতন্ত্র এবং রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের কাজ করতে দেখা গেছে। সেই সব কর্তা-ব্যক্তিদের অনেকে আবার পরবর্তীতে গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি পেয়েছেন। যে আমলার ভাইয়ের সিঙ্গাপুরের অ্যাকাউন্টে কনসালটেন্সির নামে প্রতিমাসে নাইকোর ডলার জমা হয়েছে, তাকে বিচারের আওতায় আনা তো দূরের কথা, পুরস্কৃত করা হয়েছে!
৭. আজকের বাংলাদেশে সবই হচ্ছে, সবই চলছে। শুধু রক্ষিত হচ্ছে না জনগণের স্বার্থ- দেশের স্বার্থ-সম্পদ। ব্যক্তিকেন্দ্রিক লাভের হিসেবে চলছে দেশ। গণতন্ত্রহীন নৈরাজ্যকর আর্থিক ব্যবস্থাপনায় আইনের শাসনহীন দেশে ‘সাগর চুরি’ অস্বাভাবিক কোনও বিষয় নয়! এমন দেশে চোরেরাই ভালো থাকে, ভালো আছে!!
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক