X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ বিএনপির সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি!

ফারজানা মাহমুদ
০৬ জুন ২০১৭, ১৪:১৫আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০১৮, ১৪:৫৫

ফারজানা মাহমুদ গত সপ্তাহ দুয়েক ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা নির্বাচনি প্রচারণা, দলের ভাবমূর্তির প্রচার এবং নৌকার ওপর জনগণের আস্থা ও ভরসা রাখার আহ্বান জানিয়ে ‘ভরসা রাখুন নৌকায়’ স্লোগান সংযুক্ত ছবি পোস্ট করছেন। পাল্টাপাল্টি জবাবে বিএনপির কর্মী ও অঙ্গ সংগঠনগুলো একই উদ্দেশ্যে ‘ভরসা রাখুন আল্লায়’ স্লোগান দিচ্ছে সপ্তাহ খানেক ধরে। একজন স্বল্প শিক্ষিত নাগরিকেরও বোঝার সক্ষমতা আছে যে ‘ভরসা রাখুন নৌকায়’ স্লোগানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ জনগণকে নৌকা প্রতিকের ধারক ও বাহক আওয়ামী লীগের কর্মপরিকল্পনা, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে দূরদর্শিতার প্রতি আস্থা ও ভরসা রাখার আহ্বান জানিয়ে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জয়ী করার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে।
বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ, কোন মসজিদ বা পবিত্র কোরআনের বাণী নয়। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যেখানে বিএনপি কাগজে কলমে কোনও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নয় সেখানে বিএনপি তাদের প্রতিক ধানের শীষে আস্থা না রাখতে বলে ‘ভরসা রাখুন আল্লায়’ কেন প্রচার করছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের জনগণের মনে আশঙ্কা জাগা অস্বাভাবিক নয় যে বিএনপি সম্ভবত একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসেবে নিকট ভবিষ্যতে আবির্ভূত হবে। বা তাদের দোসর জামাতের একটি অঙ্গ সংগঠন এ পরিণত হবে অথবা বিএনপি সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে দেশের জনগণের দ্বিধা বিভক্ত করে জাতিকে পাকিস্তানের মতো একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হবে।
বিএনপি তার জন্মলগ্ন থেকে সাম্প্রদায়িক মনোভাব শুধু পোষণই করেনি, লালনও করেছে। প্রায় প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপি আমাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালিয়েছে। বাঙালি জাতিকে ধর্মের নামে দ্বিধা বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র নতুন কিছু নয়, বিএনপি আবারও সেই পুরনো পন্থায় ধর্মকে ব্যবহার করে জনগণের মধ্যে সন্দেহের বিষ বপনে ব্যস্ত।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ও ভিত্তি ছিল ধর্ম নিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে পাকিস্তানের শাসনামলে ও মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্মের নামে রাজনীতির অপব্যবহারের তিক্ত অভিজ্ঞতা অবলোকন করেছে। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭২ সালে প্রণিত আমাদের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি বা মতবাদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যেখানে সবধরনের সাম্প্রদায়িকতা কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্ব, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার এবং কোন ধর্মের মানুষের প্রতি নির্যাতন ও নিপীড়নের সমাপ্তিই ধর্মনিরপেক্ষতার মূল লক্ষ্য বলে অবিহিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার সাম্প্রদায়িকতার, বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মের অনুপস্থিতি নয়, বরং সকল ধর্ম ও ধর্মের মানুষের সমান সুযোগ ও সহাবস্থান, সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতার অবসান এটাই ছিল জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামী লীগের মূলনীতি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি আওয়ামী লীগ এই বিশ্বাস লালন করে আসছে।  

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশকে একটি সাম্পদায়িক ও ধর্মান্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্ত ও প্রক্রিয়া শুরু করে। মেজর জিয়া ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক বৈধতা পাওয়ার চেষ্টা করে এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধান থেকে মুছে ফেলে বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে মেজর জিয়া কেবিনেট সহ সরকারি মন্ত্রণালয় গুলোতেও তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে। বাংলাদেশকে একটি অস্থিতিশিল সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য রাষ্ট্রিয় মালিকানাধীন সংবাদপত্র ও প্রচার মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছড়ানো হয়। ১৯৭৬ সালে পলিটিক্যাল পার্টিস রেগুলেশন অ্যাক্ট এর মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি চর্চার স্বাধীনতা দেওয়া হয়। ১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগীতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় চরম অরাজকতা ও কারচুপির মধ্য দিয়ে ১৯৭৯ সালে বিএনপি জয় লাভ করে। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের মূলনীতির পরিবর্তন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দেওয়া হয় এবং ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে বৈধতা দিয়ে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছড়িয়ে বিএনপি রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করার চেষ্টা করে। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে মুছে ফেলার মাধ্যমে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়। রাজনৈতিক বৈধতা লাভের আশায় ধর্মকে পুঁজি করে, সাম্প্রদায়িকতাকে বিনিয়োগ করে জিয়া বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার খর্ব করে, তাদেরকে নির্যাতন ও নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে এবং মৌলবাদের পুনজন্ম ঘটায়।

পরবর্তী সময়ে প্রায় প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপি ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা চালায়। ধর্মের নামে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের চাল চেলে বিএনপি, জামাতের সাথে একাত্ম হয়ে আওয়ামী লীগের উন্নয়নের গতিকে প্রতিরোধ করার জন্য জাতিকে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দ্বিধা বিভক্ত করতে বিএনপি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, নির্যাতন, নিপীড়নকে জাগিয়ে রাখতে বিএনপি তার দোসর জামাতের সাথে পরিকল্পনা করে তাদের বিদেশি প্রভুদের তুষ্ট করতে কাজ করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ বিএনপি- জামাত এর সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করেছে, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করেছে এবং জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী মাধ্যমে বাঙালি জাতির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে জাগ্রত করার লক্ষ্যে ধর্মনিরপেক্ষতাকে আবারও রাষ্ট্রপরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে স্থান দেয়। উপরন্তু অনুচ্ছেদ ৩৮ এর মাধ্যমে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সাম্প্রতি নষ্ট করে এমন কোন উদ্দেশ্যে কোন দল বা সংগঠন গঠন করা নিষিদ্ধ করা হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথকিকরণ কে বোঝায় না,  যা পশ্চিমা দেশগুলোতে বিরাজমান। বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে এবং সংবিধান অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতার বিনাশ, ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা না দেওয়া বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার এবং যে কোনও ধর্মের মানুষের প্রতি কোনও ধরনের নির্যাতন বা বঞ্চনার অবসান।

আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে এদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ কিন্তু সাম্প্রদায়িক নয়। বাংলাদেশকে উগ্র-মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে বিএনপি জামাত সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে। বিএনপি সাময়িক ফায়দা লোটার লোভে ধর্মকে ব্যবহার করে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ আবার ও বপন করতে ‘ভরসা রাখুন আল্লায়’ স্লোগান দিয়ে তাদের রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্য জনগণের সামনে তুলে ধরেছে। দেশের ৯০ ভাগ মুসলিমের পাশাপাশি ১০ ভাগ ধর্মীয় সংখ্যালঘুর মূল্যবোধ ও বিশ্বাসকে সম্মান দিতে না পারলে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছাড়বেই এবং বিএনপি-জামাত তাই চায়।

আওয়ামী লীগ সরকার ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না দেওয়ার স্বার্থে যেমন- সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে (যা জাতীয় ঈদগা সংলগ্ন), ভাস্কর্য স্থানান্তর করে এ্যানেক্স ভবনের সামনে নিয়েছে, তেমনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আইন প্রণয়ন সহ নানাবিধ কাজ করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে জনগণের কল্যাণে নিবেদিত, তাই আমরা যে ধর্মের হই না কেন উন্নয়ন এবং কল্যাণের জন্য আস্থা শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ এবং নৌকায়।

লেখক: আইনজীবী

.

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ