X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

হত্যা মামলা, রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

মাসুদ কামাল
১০ অক্টোবর ২০১৮, ২০:৩০আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০১৮, ২০:৩৫

মাসুদ কামাল একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় হলো। বিষয়টি নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গেছে। ধারণা করা যায়, আগামী কয়েকদিনে বিশ্লেষণেরও নানা শাখা-প্রশাখা গজাবে। এরই মধ্যে তাৎক্ষণিক কিছু প্রতিক্রিয়াও পাওয়া গেছে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বেশিরভাগ প্রতিক্রিয়াই রাজনৈতিক। 
বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছে রায়কে। তাদের মতে, এটি ‘ফরমায়েশি’-‘প্রতিহিংসার’ রায়। ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে এই রায় দেওয়া হয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলন করে বললেন, ‘‘এ রায়ের মাধ্যমে সরকার আরও একটি নোংরা প্রতিহিংসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো। যেভাবে ‘মিথ্যা’ মামলায় খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়া হয়েছিল, সেভাবে আরেকটি ‘মিথ্যা’ মামলায় বিএনপির নেতাদের সাজা দেওয়া হলো।’’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন–তারা রায়ে অখুশি নন, তবে পুরোপুরি সন্তুষ্টও নন। কেন পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন? সাদামাটা কথায়–যেহেতু তারেক রহমানের ফাঁসি হয়নি, তাই তারা সম্পূর্ণ তৃপ্ত হতে পারেননি। তিনি অবশ্য তারেক রহমানের নামটি উচ্চারণ করেননি। বলেছেন, ‘এই রায়ের পরিকল্পনাকারী ও মাস্টারমাইন্ডের ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট হওয়া উচিত ছিল। এই হামলার মাস্টরমাইন্ড কে? তা দেশের জনগণ জানে। বিষয়টি প্রকাশ্য দিবালোকের মতো সত্য।’

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অতটা রাখঢাকের মধ্যে যাননি। সরাসরিই বলেছেন, ‘এই ঘটনার মূল নায়ক তারেক রহমান, তারেকের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত ছিল।’ তিনি আরও জানিয়েছেন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া বিএনপি তিন নেতা, তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী ও কায়কোবাদের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে তারা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। 

নেতা নেত্রী, মন্ত্রীদের এমন সব মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হতে পারে–এটি কি নিছক কোনও রাজনৈতিক মামলাই ছিল? অস্বীকার করার উপায় নেই, ঘটনাটির পেছনে রাজনীতি ছিল। একটি দলকে, দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা ছিল। এমনকি আমি তো মনে করি, এই একটি ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিকে পর্যন্ত পাল্টে দিয়েছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বদলে দিয়েছে। জন্ম নিয়েছে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসের রাজনীতি। এই যে আজকে শত জাতীয় সংকটেও বিরোধী দলের সঙ্গে বসা দূরে থাক, এমনকি মুখোমুখি দেখা সাক্ষাৎও বন্ধ হয়ে গেছে, তার মূলে কিন্তু ওই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। কেউ যদি জেনে যান, কে তাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল, তাহলে তার পক্ষে সেই হত্যাপ্রচেষ্টাকারীর সঙ্গে হাসিমুখে বৈঠক করা আসলেই কষ্টকর। একথাগুলো খোদ প্রধানমন্ত্রীর মুখে একাধিকবার উচ্চারিত পর্যন্ত হয়েছে। তাহলে দেশের জাতীয় নানা সংকটে আগামীতে কি আর কখনোই প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের আর এক টেবিলে দেখা যাবে না? এমন প্রশ্ন হয়তো আগামীতে, এই রায়ের পর, আরও বেশি জটিল হয়ে দেখা দেবে। জটিলতা যে প্রতিদিনই বাড়ছে, সে নমুনাও দেখা যাচ্ছে।  

কিন্তু এরকম না হলেও তো পারতো। ২১ আগস্টের ঘটনাটিকে একটি নৃশংস হত্যাযজ্ঞ হিসাবে দেখতে পারলেই মনে হয় ভালো হতো। আর কিছু না হোক, অন্তত পক্ষে যে মামলার রায় হলো, সেটিকে আমি একটি হত্যা মামলা হিসাবেই দেখতে চাইবো। যে ঘটনায় ২৪ জন নিহত হয়, কয়েকশ’ নিরপরাধ মানুষ আহত হয়, সেটির রায় নিয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশের সময় রাজনীতিকে সামনে না নিয়ে আসাই ভালো। তারেক রহমান বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা, অতএব তিনি অপরাধী হতে পারেন না, তাকে মুক্তি দিতে হবে—এটা কোনও যুক্তি হতে পারে না। আবার বিপরীত দিকে, যেহেতু সে আওয়ামী লীগের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী দলের শীর্ষ নেতা, অতএব তার অস্তিত্বই দুনিয়া থেকে বিলীন করে দিতে হবে, যাবজ্জীবন নয়, মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে–এমন মানসিকতাও রাজনীতির সুস্থতা প্রমাণ করে না। একটা সুস্থ সমাজের বড় বড় মানুষের মধ্যে ভাবনা বোধকরি প্রত্যাশিত নয়। তিনি অপরাধী হলে সাজা পাবেন, তা তিনি যে দলেরই হোন না কেন, যে পর্যায়ের নেতাই হোন না কেন। আর যদি অপরাধী না হয়ে থাকেন, তাহলে রাজনীতির মাঠে যত শত্রুতাই থাক না কেন, শাস্তি থেকে অব্যাহতি পাবেন। কিন্তু সেটা কেন হয় না? শীর্ষ নেতারাই কেন যুক্তির চেয়ে অযৌক্তিক আবেগকে ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট হন?  

কেবল শীর্ষ নেতাদের কথাই বা কেন বলছি। মাঝারি পর্যায়ের নেতারাও কি কম কিছু বলেছেন? বরং তাদের মধ্যেও একটা প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে, কে কার চেয়ে বেশি বলতে পারে। বিষয়টা যেন এমন–যে যত বেশি বলতে পারবে, তারই তত বেশি সম্ভাবনা থাকবে শীর্ষ নেতাদের খুশি করার। এটা অবশ্য এই ভূখণ্ডে অনেক দিন থেকে চলতে থাকা রাজনৈতিক সংস্কৃতি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে–বিষয়টা যখন বিচারিক কোনও রায়কে কেন্দ্র করে হয়, তখন এর নেতিবাচক প্রভাবটা হয় অনেক বেশি মারাত্মক। এই যে এখন যারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যন্ত তারেক রহমানের ফাঁসি চেয়ে মিছিল করছেন, কিংবা যারা তারেককে কেন মুক্তি দেওয়া হলো না–সেই প্রশ্নকে তুলে ধরে বিক্ষোভ মিছিল করছেন; তারা সবাই কিন্তু রাজনীতির ওই নেতিবাচক চিন্তা দ্বারাই প্রভাবিত থাকছেন। 

রায়ে দুঃখিত হয়ে বিক্ষোভ যারা করছেন, তারা আসলে কার বিরুদ্ধে রাগান্বিত? ‘প্রতিহিংসার রায়’ যদি বলি তাহলে প্রতিহিংসাটি কে নিলো? এসব প্রশ্নের জবাব হয়তো কেউ সরাসরি উচ্চারণের ঝুঁকিতে যাবেন না। তবে একটা পাবলিক পারসেপশন হয়তো রয়েছে। আবার বিপরীত দিকে, যদি ওই সন্দেহ পোষণকারীদের চিন্তা অনুসরণ করে ধরেই নেওয়া হয়– বিচারকের ওপর সরকারের প্রভাব আসলেই রয়েছে, তাহলে তারেক রহমানের মৃত্যুদণ্ডই বা হলো না কেন?
সরকারি দলের শীর্ষ নেতারা বিশ্বাস করেন, হাওয়া ভবন থেকেই এই হামলার নীলনকশা তৈরি করা হয়েছে। নীলনকশা যার তত্ত্বাবধানে হয়েছে, মাস্টারমাইন্ড যে ব্যক্তি, তাকেই যদি চরম দণ্ড দেওয়া না হয়, তাহলে বাদীপক্ষের অসন্তুষ্ট হওয়ারই কথা। তাহলে কি সরকারের তেমন একটা প্রভাব নেই বিচারকের ওপর? নাকি সরকার নিজেই চায়নি যে তারেক রহমানের চরম দণ্ড হোক? তা কেন হবে?

আসলে কীভাবে কী হয়েছে—এসব খুবই সংবেদনশীল প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর নিশ্চিতভাবে প্রশ্নের চেয়েও বেশি সংবেদনশীল। কেবল তাই নয়, একইসঙ্গে ইদানিং বেশ ঝুঁকিপূর্ণও বটে। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন-উত্তর পর্বকে হয়তো প্রকাশ্যে নিয়ে আসা যাবে না, তবে মানুষের মনে আরও অনেকদিন ধরে থেকেই যাবে।   

লেখক: সিনিয়র নিউজ এডিটর, বাংলা ভিশন

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সোনার দাম কমলো
সোনার দাম কমলো
মামুনুল হকের বিরুদ্ধে তৃতীয় দফায় সাক্ষ্য দিলেন তদন্ত কর্মকর্তা
মামুনুল হকের বিরুদ্ধে তৃতীয় দফায় সাক্ষ্য দিলেন তদন্ত কর্মকর্তা
পর্যটনে সহযোগিতা করতে আগ্রহী আরব আমিরাত
পর্যটনে সহযোগিতা করতে আগ্রহী আরব আমিরাত
আবারও আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ স্থগিত করেছে অস্ট্রেলিয়া 
আবারও আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ স্থগিত করেছে অস্ট্রেলিয়া 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ