X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমেরিকার মোড়লগিরি ফিকে হয়ে আসছে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
১২ এপ্রিল ২০১৯, ১৭:০৫আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০১৯, ২১:৩০

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী এখন বিশ্বনেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় দৃশ্যমান হয়েছে চীন। রাশিয়াও যে এ প্রতিযোগিতা থেকে জাতিচ্যুত হয়েছে তা নয়। দীর্ঘ সময়ব্যাপী নিজের বিশালত্ব হারানোর পর ম্রিয়মাণ হয়েছিলো মাত্র। নিজেকে পুনর্গঠনের পর ক্রিমিয়ার ঘটনা আর মধ্যপ্রাচ্যে উপস্থিতি রাশিয়াকে পুনরায় বিশ্ব মাতব্বরির ভূমিকায় এনে উপস্থিত করেছে। কিন্তু এতকালব্যাপী যে আমেরিকা বিশ্বনেতৃত্বের শীর্ষে ছিল, ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে আমেরিকা নিজেই ঘরমুখী হয়ে নিজের বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে।

ইউরোপের বড় বড় শক্তিগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকার সহযোগী শক্তি হিসেবে ছিল। তারা সোভিয়েতের আগ্রাসন থেকে বাঁচার জন্য একসময় আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো জোট গঠন করেছিলো। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন ন্যাটোকেও নিষ্ক্রিয় করে ফেলার পর্যায়ে নিয়ে আসছেন ধীরে ধীরে। তিনি ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে বলছেন, তোমরা নিজেদের রক্ষা ব্যবস্থার আয়োজন নিজেরাই করো। তারাও আমেরিকার আচার-আচরণে বিরক্ত হয়ে নিজেদের পথ নিজেরাই বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সেই পথে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে।

এখন আমেরিকার একরোখা মেরুকরণও হয়েছে। একরোখা মেরুকরণগ্রস্ত কোনও শক্তির পক্ষে বিশ্বনেতৃত্ব দেওয়া আদৌ সম্ভব নয়। জাতিসংঘের বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া আর তেলআবিব থেকে আমেরিকার দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং অনুরূপ ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সম্মতিপত্র প্রদান- আমেরিকার একরোখা মেরুকরণের প্রকৃত উদাহরণ। এখন সিরিয়ার গোলান মালভূমিকেও ইসরায়েল তার অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দিয়েছে। তাতেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প লিখিত স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়েছেন, চলমান নির্বাচনের পর তারা জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরকেও ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দেবেন। হয়তোবা তার স্বীকৃতি দিতেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্বিধা করবেন না।

অথচ দীর্ঘ দিনব্যাপী আমেরিকার ট্রাম্প পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টরা দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনে মুসলমান ও ইহুদিদের জন্য দু’টি পৃথক জাতি গঠনের যে প্রক্রিয়া চালিয়ে ছিল, ট্রাম্প সেই প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত করে দিলেন। গত ৭০ বছরব্যাপী ফিলিস্তিন সমস্যাটা ক্যানসারের মতো বিশ্বকে উদ্বিগ্ন করে রেখেছে। ইসরায়েল একটা মৌলবাদী রাষ্ট্র। এম ইদ্রিস আলী তার ‘ইসরায়েলের পুত্রগণ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,  ‘হিব্রু বাইবেলে আল্লাহ নাকি তাদের একটা ভূমি প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ইহুদি পণ্ডিতেরা বলেন, সেই ভূমিটা সিরিয়া থেকে লেবানন আর জর্ডান থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত।' সম্ভবত তারা তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী ওই ভূমিটা দখলে নিতে চায়।

আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাম্প্রতিক সময়েও বলেছেন, ইসরায়েলকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সব সাহায্যই আমেরিকা প্রদান করে যাবে। পৃথিবীতে ইহুদি ধর্মের অনুসারী হচ্ছে এক কোটি ৪৫ লক্ষ। সম্ভবত ইসরায়েল কামনা করে সব ইহুদিরা প্রতিশ্রুত ভূমিতে বসবাস করুক। আমেরিকার ৭০ শতাংশ পুঁজির মালিক ইহুদিরা আর ৭৫ শতাংশ মিডিয়ার মালিকও ইহুদি। এই ক্ষুদ্র ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীটা আমেরিকাকে হাতের কব্জায় নিয়ে রেখেছে। ফিলিস্তিনি মুসলমানেরা ইহুদিদের সঙ্গে টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। ইহুদিরা খুবই আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন ও মেধাবী জাতি।

১৯৪৮ সালে যখন ইহুদি রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয় তখন টমেটো রফতানি করে তারা তাদের রফতানি বাণিজ্য শুরু করে। এখন তারা অস্ত্রশস্ত্র রফতানি করে। চতুর্দিকে ৩০ কোটি আরবীয়দের মাঝে ৭০ লাখ ইহুদি নিজেদের এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে খুবই কঠোর পরিশ্রম করে। ফিলিস্তিনি মুসলমানকে টিকে থাকতে হলে তাদের মতো গুণাবলি রপ্ত করতে হবে।

ইহুদিরা লেবাননের হিজবুল্লাহ ছাড়া কাউকেই ভয় করে না। হিজবুল্লাহ আত্মপ্রকাশের পর থেকে ইসরায়েল সহজে লেবানন সীমান্ত অতিক্রম করে না। হামাসও সাহসী সংগঠন। কিন্তু টিকতে পারছে না আমেরিকার কারণে। মুরসিকে মিশরের প্রেসিডেন্টের পদ থেকে আমেরিকা সরিয়ে দিয়েছে শুধু তিনি ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে।

যা হোক, বিশ্বনেতৃত্বে যারা প্রতিযোগিতায় রয়েছে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এ লেখার অবতারণা। ইসরায়েল, ফিলিস্তিন আর আমেরিকা সম্পর্কে আলোচনাটা প্রাসঙ্গিক বলে আলোচনা করলাম। চীন ৬৫টি দেশের সঙ্গে রোড বেল্ট নৌপথ আর বন্দর স্থাপনের মধ্য দিয়ে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী কিছুদিনের মধ্যে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের দ্বিতীয় সামিট হবে। চীন এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এক ট্রিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে। চীনের এই পরিকল্পনা বাস্তবরূপ পেলে এশিয়া, ইউরোপ আর আফ্রিকা- এই তিন মহাদেশের মাঝে একটা মসৃণ পথ সৃষ্টি হবে, যাতে উন্মুক্ত হবে সহজভাবে বাণিজ্যের পথ। শুধু বাণিজ্য নয়, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানও সহজতর হবে।

কোনও বৃহৎ শক্তি অনুরূপ একটা পরিকল্পনার কথা কখনও কল্পনা করেনি। চীনের এ পরিকল্পনা দিয়ে শুধু চীন উপকৃত হবে তা নয়, তিন মহাদেশের কোটি কোটি মানুষও উপকৃত হবেন। ইউরোপ এখন আমেরিকার লেজুড়বৃত্তিতে ব্যস্ত। ইউরোপকে এশিয়ামুখী করতে না পারলে দুনিয়ায় শান্তিপূর্ণ কিছু করা সম্ভব হবে না। সুখের কথা যে ইতালি ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের অংশীদার হওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। ফ্রান্সও ডায়লগ ওপেন করার কথা বলছে। ইতালি মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে আর এ মাসে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের দ্বিতীয় সম্মেলনে অংশ নেওয়ার সময় তা পূর্ণতা পাবে। সম্ভবত ইতালি হবে ইউরোপের ‘হাব’। সড়ক, রেল ও সমুদ্রপথ যুক্ত হওয়ার সংযোগস্থল।

আমেরিকা যে ইউরোপের জন্য কিছু করেনি তা নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্শাল পরিকল্পনায় যথেষ্ট সাহায্য সহানুভূতি নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলো, কিন্তু ১৯৫৩ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরমাণু শক্তির মালিক হওয়ার পর আমেরিকা ন্যাটো গঠন করে পাহারা দেওয়ার কাজে নিজেকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। ১৯৫৩ সালে সোভিয়েট ইউনিয়নের বোমা বিস্ফোরণের খবর প্রেসিডেন্ট আইজেন আওয়ারের কাছে পৌঁছলে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করতে চেয়েছিলেন এবং নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভাও ডেকেছিলেন। কিন্তু নিরাপত্তা কাউন্সিলের পরামর্শে সোভিয়েত আক্রমণ করার পরিকল্পনা স্থগিত করেছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট আইজেন আওয়ার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জেনারেল ছিলেন।

ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মাঝে জার্মানির সঙ্গে আমেরিকার বৈরিতা বেশি। চ্যান্সেলর মের্কেল এখন আর রাখডাক রেখে কথা বলছেন না। জার্মানির সঙ্গে এখন চীনের সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। এ সম্পর্কে জার্মানিও খুশি। কারণ, চীনের বাজার বিশাল, জার্মানি সেই বাজারে প্রবেশ করেছে। চীনে এখন দ্বিতীয় শিল্প-বিপ্লব আরম্ভ হয়েছে। চীন হাইটেক প্রযুক্তিতে তার শিল্প কারখানাগুলোকে রূপান্তর করার উদ্যোগ নিয়েছে। জার্মানি এখন চীনের এ রূপান্তরে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করবে। জার্মানি হাইটেক প্রযুক্তির শীর্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দেশ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ব্রিটেন ইউরোপে আমেরিকান স্বার্থের তদারকি করেছে। ফ্রান্স, জার্মানি আর ইতালির ভিন্ন সিদ্ধান্তের কারণে তাতেও পরিবর্তন আসবে। ব্রিটেনের জন্য ভিন্ন কোনও পথ খোলা থাকবে না। গত ৭ মার্চ চীনের প্রেসিডেন্ট ইউরোপ সফর করেছেন। এ সফর খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে।

ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আছে ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া আর আমেরিকা। ভারতের কারণে সম্ভবত বাংলাদেশ বেল্ট রোডের প্রথম সম্মেলনে কোনও উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠাতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশ যে বেল্ট রোডের ইনেশিয়েটিভের সঙ্গে জড়িত তা বলতে কোনও দ্বিধা করেনি। নির্বাচনের পর আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় টিভি সিএনএন-১৮-এ যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তা খুবই সাহসী পদক্ষেপ। এখন সোনাদিয়া বন্দরকে বেল্ট এন্ড রোডের সঙ্গে যুক্ত করতে কোনও দ্বিধা করবেন না বাংলাদেশ সরকার তা পরিষ্কার করে দিয়েছেন।

গত বছর এসএ টিভির এক টকশোতে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছিলাম যেন সোনাদিয়া বন্দরকে বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে যুক্ত করে নেন। ওই টকশোতে প্রফেসর সলিমুল্লাহ খান এবং মোফাজ্জল করিমও ছিলেন। তারাও এ বিষয়ে আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করেছিলেন। বিলম্ব হলেও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’র দ্বিতীয় সম্মেলনে যেন তিনি নিজেই উপস্থিত থাকার চেষ্টা করেন। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের প্রথম সম্মেলনের সময় ভারতের বহু টকশোতে দেখেছি ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা এ ইনিশিয়েটিভের বিরোধিতা করেননি। তবুও ভারত কেন এই ইনিশিয়েটিভের অন্তর্ভুক্ত হলো না বুঝে আসে না। নরেন্দ্র মোদি অবশ্য আমেরিকার বাতাসে চীনের বন্ধু হওয়ার চেয়ে প্রতিপক্ষ হয়ে বেশি খুশি।

ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ ৬৫ দেশের সঙ্গে যুক্ত। টাকা বিনিয়োগ করছে চীন। চীনের প্রেসিডেন্ট কম কথা বেশি কাজ করা লোক। তাকে দিয়ে অনুরূপ কাজ সফল হবে। আর ৬৫ দেশের আগ্রহও প্রচুর। এখন ধীরে ধীরে ইউরোপও এগিয়ে আসছে। সুতরাং ইনিশিয়েটিভটা শতাংশে সফল হবে বলে আমরা আশা রাখি। এ উদ্যোগ সফল হলে দ্রুত বিশ্বনেতৃত্ব চীনের হাতে চলে যাবে আর আমেরিকার নেতৃত্ব ফিকে হয়ে আসবে।

 

 

 

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

 

[email protected]

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ