ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সম্প্রতি ইসরায়েলের ওপর সরাসরি হামলা চালিয়ে ইরান যেভাবে দেশটিকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে, তা মূলত ব্যর্থই হয়েছে। তারা বলছেন, এমন পদক্ষেপের কারণে ইসলামি এই প্রজাতন্ত্রটি তার মূল শত্রুর কাছ থেকে এখন আরও ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকা এই খবর জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বিমান হামলা ইরানের এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পুরোটাই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ১ অক্টোবর ইসরায়েলের ওপর ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পাল্টা জবাবে এই হামলা চালায় ইসরায়েল। এদিকে, ইসরায়েলি ওই হামলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও মূল্যায়ন করছে ইরান।
ওয়াশিংটনভিত্তিক নিউ লাইন্স ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসির নিকলাস হেরাস ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেছেন, এই বিমান হামলাগুলো এটিই প্রমাণ করছে, ইসরায়েলের ‘ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে গুণগত সামরিক সুবিধা রয়েছে’, যা মুসলিম রাষ্ট্রটির প্রতিরোধ কৌশলের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
হেরাস বলেন, ‘তারা উন্নত এস-৩০০ বিমানবিধ্বংসী ব্যবস্থা দিয়ে হামলা করেছে। ফলে দেশটি ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে, যেসব জায়গা আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের বাহক নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ এবং একইসঙ্গে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য জ্বালানি সরবরাহ করে, সেখানে আঘাত করেছে। সেগুলো ইরানের প্রতিরোধ কৌশলের মূল উপাদান।’
তিনি বলেন, ‘তারা মূলত ইরানিদের এই বার্তাই দিতে চেয়েছিল, প্রযুক্তিগত যুদ্ধের ক্ষেত্রে ইরানিরা ইসরায়েলিদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে।’
কার্নেগি এন্ডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর গবেষক নিকোল গ্রাজুয়েস্কি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে অনলাইন দিওয়ান পাবলিকেশনে লেখেন, ‘সরাসরি আক্রমণের মাধ্যমে ইসরায়েলকে প্রতিহত করার ইরানি প্রচেষ্টা হিতে বিপরীত হয়েছে। তারা নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় যে ফাঁকফোকর রয়েছে, যেটিকে ইসরায়েল ক্রমবর্ধমানভাবে লক্ষ্যবস্তু করতে চায়, সেদিকে নজর দেয়নি। আর তাই ১ অক্টোবরের তুলনায় ইরান সম্ভবত এখন নিজেকে আরও আশঙ্কাজনক অবস্থানে নিয়ে গেছে।’
দ্য ওয়ার জোন পত্রিকায় টমাস নিউডিক তার একটি লেখায় নিকোল গ্রাজুয়েস্কির মন্তব্যকে সমর্থন করে বলেন, ‘ইরানের এস- ৩০০ ক্ষেপণাস্ত্রকে কর্মক্ষমতার বাইরে রাখার কারণে ইসরায়েলকে ব্যাপক পরিমাপের প্রত্যক্ষ ও পরবর্তী আক্রমণের পথ খুলে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, এটি ‘ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর আক্রমণের ও ইরানের পাল্টা জবাব প্রতিহত করার সুযোগ করে দিয়েছে।’
নিউডিক বলেন, ‘এটি প্রায় অবশ্যম্ভাবী যে ইরান যদি আবারও ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে এ ধরনের আক্রমণ চালায়, তবে ইসরায়েলের কাছে বহু পাল্টা বিকল্প পরিকল্পনা রয়েছে।’
ইরানের প্রতিরোধ ব্যবস্থার আরেকটি কৌশল হচ্ছে বহু বছর ধরে সিরিয়া ও আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন। এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ইরাকের অভ্যন্তরের সশস্ত্র গোষ্ঠী, গাজায় হামাস, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ রয়েছে। ইয়াহিয়া সিনওয়ার ও হাসান নাসরাল্লাহসহ হামাস ও হিজবুল্লাহর বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল।
ওয়াশিংটন কুইন্সি ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক স্টিভেন সাইমন একটি অনলাইন প্রেজেনটেশনে বলেন, ইরানের অনেক অজ্ঞাত ‘প্রতিরোধ অক্ষশক্তি’ রয়েছে। সাইমন প্রশ্ন করেন, ‘ইরানের নিজেদের কথা না হয় বাদই দিলাম, লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাদের অক্ষশক্তির কতটুকুই বা অবশিষ্ট রয়েছে?’
সাইমন বলেন, ‘হামাসকে মূলত একটি সামরিক সংগঠন হিসেবে ধ্বংস করা হয়েছে। হিজবুল্লাহ মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে। তাদের খুব গুরুতর আঘাতের সম্মুখীন হতে দেখা গেছে: পেজার হামলা, নাসরাল্লাহ এবং হিজবুল্লাহ কর্মকর্তা হাশেম সাফিইয়েদ্দিনসহ অন্যান্য নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেটের গুদামে ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতির বিষয়ে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক মূল্যায়ন কতটা সঠিক, তা আমি জানি না। তবে ‘তারা এখন দাবি করছে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় ওই সব রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্রের ৮০ শতাংশই হয় ধ্বংস, নয়তো অকেজো হয়ে পড়েছে।’
সাইমন আরও বলেন, ইরান থেকে পাওয়া অস্ত্রের সরবরাহ আবারও পূরণ করে নিতে হিমশিম খাবে হিজবুল্লাহ। কেননা, অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যম হিসেবে সিরিয়া তার সীমান্ত দিয়ে লেবাননে অস্ত্রশস্ত্র প্রবেশ করতে দিতে পারবে কিনা তা নিশ্চিত করতে সক্ষম নয়।
কার্নেগির গ্রাজুয়েস্কি বলেন, তিনি মনে করেন ইরানের পক্ষে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্পগুলো ‘মারাত্মকভাবে কমে এসেছে’। কেননা, ইরানের নেটওয়ার্ক দুর্বল হয়ে গেছে এবং দেশটির নিজের ‘ক্ষেপণাস্ত্রের মজুদই সীমিত হয়েছে এবং সেগুলোর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।’