উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার রাত পেরিয়ে তখন সকাল হতে শুরু করেছে। রাত পৌনে নয়টা থেকে শুরু হয়েছিল জঙ্গিদের তাণ্ডব। রাতের প্রথমভাগেই হলি আর্টিজানের ভেতরে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল তারা। বাইরে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হওয়ায় ভেতরের পরিস্থিতি আঁচ করা যাচ্ছিল কিছুটা। সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযান শেষে দেখা গেল, দেশি-বিদেশি ২০ জন নাগরিককে নির্মমভাবে হত্যা করেছে জঙ্গিরা। আর যারা জিম্মি হয়ে রাতভর ভেতরে ছিলেন, মৃত্যু আতঙ্কে তাদের চোখে ছিল বিস্ময়। এমন নারকীয় হত্যাযজ্ঞের মধ্যেও প্রাণ হাতে ফিরতে পেরেছেন তারা।
গত বছরের ১ জুলাই রাতে হোলি আর্টিজানে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পরদিন সকালের চিত্র ছিল এমনই। যারা বেঁচে ফিরেছিলেন তারা ভাবতেই পারেননি, রাত পেরিয়ে দিনের আলো আবারও দেখতে পাবেন তারা।
২ জুলাই সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে অভিযান শুরু করে সেনা কমান্ডোদের দল। এরমধ্যেই জিম্মি অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসেন দুই শিশুসহ আট জন। হাসনাত করিম, তার স্ত্রী শারমিনা করিম, দুই সন্তান শেফা করিম ও রায়হান করিম, তাহমিদ হাসিন খান, তাহমিদের দুই বান্ধবী ফাইরুজ মালিহা ও তাহানা তাসমিয়া এবং ভারতীয় নাগরিক সাত প্রকাশ।
তাদের আগে বেরিয়ে আসেন গুলিবিদ্ধ একজন জাপানি নাগরিক ও এক শ্রীলঙ্কান দম্পতি। তাদের সবাইকে নেওয়া হয় পুলিশি হেফাজতে। প্রায় ৫০ মিনিটের সেনা অভিযান শেষে উদ্ধার করা হয় রেস্তোরাঁর ১৩ কর্মীকে। তাদের চোখেমুখে তখনও ভয় আর আতঙ্ক। মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরার কান্না। আর যারা ফেরেননি তাদের স্বজনদের কান্নায় গোটা এলাকার পরিবেশ বেদনায় ভারী হয়ে উঠেছিল। ততক্ষণে তারা বুঝে গেছেন স্বজনরা আর ফিরবেন না। তবুও কান্না চেপে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন তারা। বাংলাদেশি তিন নাগরিক ফারাজ আইয়াজ হোসেন, অবিন্তা কবির আর ইশরাত আখন্দের পরিবারের সদস্যরা এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছিলেন। পরিচিত পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ধীরে ধীরে নিশ্চিত হতে থাকেন, তাদের স্বজনেরা আর বেঁচে নেই। দুপুর একটায় আইএসপিআর-এর আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং শেষে সবাই নিশ্চিত হন। ছুটে যান সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের মরচু্য়ারিতে। নিজেদের চোখে দেখতে পান স্বজনদের লাশ।
এদিকে হলি আর্টিজান থেকে যারা বেঁচে ফিরে এসেছেন, তাদের স্বজনদের কান্নায়ও বাতাস ভারী হয়ে ওঠে ২ জুলাই এর সকাল।আপনজনের খোঁজ না পেয়ে অনেকেই মনে করেন- হয়তো আর বেঁচে নেই। বেঁচে যারা ফিরেছেন তারাও ভাবেননি জীবন নিয়ে ফিরতে পারবেন।
হলি আর্টিজান থেকে ফিরে আসা সহকারী কুক আকাশ খান বলেন, ‘আমি ভাবতেই পারিনি, সেই রাতে জীবিত ফিরে আসতে পারবো। সারারাত আমরা বাথরুমে বন্দি ছিলাম। সকালে যখন বাথরুমের দরজা খুলে দিলো, তখন ভেবেছিলাম হয়তো বেঁচে গেলাম। কিন্তু বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি অসংখ্য লাশ। জঙ্গিরা তখনও হলি আর্টিজানের ভেতরেই ছিল। ভেবেছিলাম আমাদেরও হয়তো মেরে ফেলবে। কিন্তু জঙ্গিরা যখন বাইরে বের হয়ে গেল, কেবল তখন মনে হলো আমরা বাঁচলাম। ঠিক সে সময়ে শুরু হয় অপারেশন। অপারেশন শেষে আমরা নিশ্চিত হতে পারছি যে, এই যাত্রা বেঁচে গেলাম।’
হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে আসা আরেক রেস্তোরাঁকর্মী শিশির সরকার বলেন, ‘সারারাত খুব ভয়ে কেটেছে। সকাল হলে একটু বাঁচার আশা বাড়লো। অপারেশন শেষে আমাদের উদ্ধার করে যখন পাশের বাসার গ্যারেজে নেওয়া হয়, তখন আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, আমরা বেঁচে গেছি। সকাল যেন আমাদের কাছে নতুন করে ফিরে আসে।’
২ জুলাই সকালে হলি আর্টিজান বেকারিতে কমান্ডো অপারেশনে ১২ ঘণ্টার জিম্মি অবসান হলে, ভেতরে যান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন,ভেতরে গিয়ে সেই বীভৎস দৃশ্য দেখে আমার গা শিউরে ওঠে। চারদিকে ছড়ানো ছিটানো লাশ। রক্তে ভেসে গেছে মেঝে। কাউকে জবাই করা তো কারও শরীরে অসংখ্য ধারালো অস্ত্রের চিহ্ন। নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল জঙ্গিরা।সেনাবাহিনী হলি আর্টিজানের নিয়ন্ত্রণ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার পরপরই ক্রাইম সিনের সদস্যরা দ্রুত কাজে নেমে পড়েন। ময়নাতদন্তের জন্য লাশগুলো দ্রুত পাঠানো হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে নিহত হয় তিন বাংলাদেশি নাগরিকসহ ২০ জন। অন্যদের মধ্যে ৯ জন ইতালির, ৭ জন জাপানের এবং একজন ভারতীয়। এছাড়া জঙ্গিদের হামলার শুরুতেই তাদের আক্রমণে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন।রেস্তোরাঁর ভেতরে রাতভর জিম্মি ছিলেন অন্তত ২৪ জন, যাদের প্রায় ১১ ঘণ্টা পর পরদিন সকালে সেনা কমান্ডো পরিচালিত অপারেশন থান্ডারবোল্টের সময় উদ্ধার করা হয়। এছাড়া রাতের বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা হয় আরও অন্তত ৭ জনকে। অপারেশন থান্ডারবোল্টের পর রেঁস্তোরা থেকে ৫ জঙ্গিসহ ৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া পালাতে গিয়ে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরেক রেস্তোরাঁকর্মী। এ ঘটনায় গুলশান থানায় দায়ের হওয়া মামলাটি কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট তদন্ত করছে।
/এনএল/ এপিএইচ/
আরও পড়ুন:
অবিন্তা নেই, বেঁচে আছে তার স্বপ্ন
তুমি কোথায়, গুলশানে জঙ্গি হামলা!
দুর্বিসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন তারা
‘হয় আমি মরবো, না হয় ওদের মারবো’
গুলশানে এখনও কাটেনি আতঙ্কের রেশ
হলি আর্টিজান কেন বেছে নিয়েছিল জঙ্গিরা?
এসি রবিউলের সন্তানদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
অপারেশনের শুরুতে উত্তেজনায় কাঁপছিলাম
নিহত শাওনের মায়ের বিলাপে ভারি গুলশান
‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’ থেকে ‘সান ডেভিল’
৩ কারণে হলি আর্টিজান হামলার চার্জশিটে দেরি
পুলিশকে সেই রাতের কথা যা বলেছেন হাসনাত করিম
শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে বেঁচে আছেন এডিসি আব্দুল আহাদ
গুলি ও বোমার আঘাতেই মৃত্যু হয়েছিল হলি আর্টিজানের জঙ্গিদের
গুলশান হামলায় নিহতদের স্মরণে অনুষ্ঠান নিয়ে দূতাবাসগুলোয় সতর্কতা
হলি আর্টিজানের পলাতক জঙ্গিদের এক মাসের মধ্যে গ্রেফতার করা হবে: মনিরুল
হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনা রাজশাহীতে, কৌশল নির্ধারণ গাইবান্ধায়, চূড়ান্ত অপারেশন প্ল্যান ঢাকায়