X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০
বিএডিসিতে অনিয়ম পর্ব- ৮

খরচের চেয়ে বিল বেশি!

শাহেদ শফিক
১২ জুলাই ২০২১, ১৫:০০আপডেট : ১২ জুলাই ২০২১, ১৬:১১

নানা অনিয়মে চলছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)বিভিন্ন প্রকল্পে কাজের চেয়েও ঠিকাদারকে বিল বেশি পরিশোধ করে আত্মসাৎ করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকাএ নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের অষ্টম পর্ব আজ

ফোর্সমোড নলকূপ স্কিমে ইউপিভিসি পাইপ দিয়ে ভূ-গর্ভস্থ সেচনালা নির্মাণে প্রকৃত খরচের চেয়েও সাড়ে ছয় লাখ টাকা বেশি পরিশোধ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার যোগসাজশে আত্মসাৎ হয়েছে অতিরিক্ত অর্থ। এভাবে বিএডিসির বিভিন্ন প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ টাকা অনিয়মের মাধ্যমে আত্মসাৎ হয়েছে।

প্রকল্পের পানি নিয়ন্ত্রণ বা সংরক্ষণ অবকাঠামো নির্মাণেও প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি কাজ দেখিয়ে ঠিকাদারদের প্রায় ১২ লাখ ৪৪ হাজার এবং বিভিন্ন পূর্তকাজের বিপরীতে দুই লাখ টাকারও বেশি অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সিলেটের শেখঘাট বিএডিসির ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের বাজেট আওতাভুক্ত সিলেট ও হবিগঞ্জ অঞ্চলের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ দশমিক ৫/২ কিউসেক ভূ-গর্ভস্থ সেচনালা নির্মাণ করা হয়। নথি, বিল-ভাউচার, ব্যয় বিবরণী ও রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এ প্রকল্পে প্রকৃত খরচের চেয়ে বার্ষিক হিসাব বিবরণীতে বেশি দেখানো হয়েছে সাড়ে ৬ লাখ টাকারও বেশি।

প্রকল্পের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাব কোড- ৪১১৩০৬ খাতে সেচনালা নির্মাণে ২০১৯ সালের ৩০ জুন ১৭৪, ১৫৮, ১৮০ নং বিলের মাধ্যমে ৩২ লাখ ২৪ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। একই বছরের ১৭ এপ্রিল ৬৫ নং বিলের মাধ্যমে প্রায় ১০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা এবং ১০৬ নং বিলের মাধ্যমে ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়।

সব মিলিয়ে খরচ হয় ৫৩ লাখ ৯১ হাজার টাকা। অথচ, হিসাব বিবরণীতে দেখানো হয় ৬০ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। অনিয়মে জড়িতদের দায় নির্ধারণ করে ক্ষতির টাকা আদায় করতে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।

বিএডিসি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বলছে, সেচনালা নির্মাণে বাড়তি অর্থ প্রকল্পের আওতাধীন সিলেট দফতরে বরাদ্দ দিয়েছেন সিলেট বিএডিসির সহকারী প্রকৌশলী। এতে প্রকল্পের ক্ষতি হয়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই অর্থের কোনও অংশ প্রকল্পের আওতাধীন সহকারী প্রকৌশলী (সওকা) সিলেট দফতর হতে পরিশোধ করা হয়েছে কিনা তার প্রমাণ নেই।

এ অবস্থায় পূর্ণাঙ্গ হিসাব বিবরণী দাখিল কিংবা বাড়তি টাকা আদায় করা সরকারি কোষাগারে জমার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

একই প্রকল্পের ‘পানি নিয়ন্ত্রণ বা সংরক্ষণ অবকাঠামো’ নির্মাণে প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি কাজ দেখিয়ে বিল দেওয়া হয় ঠিকাদারকে। এতে বাড়তি ১২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। শুধু ঠিকাদারকে সুবিধা দিতেই এমন দুর্নীতি হয়েছে- এমনটাই বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

সিলেট বিভাগ ক্ষুদ্রসেচ উন্নয়ন প্রকল্পে ২০১৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর ৩০৫ নং কার্যাদেশে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার আহম্মদাবাদ ইউনিয়নের সাতপাইকা মৌজায় ফুলছড়ি ছড়ার ওপর মমতাজ উল্লার বাড়ির পাশে মাঝারি আকারের পানি নিয়ন্ত্রণ বা সংরক্ষণ অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয় নিয়াজ ট্রেডার্সকে।

নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সালের ৩০ জুন ১৭৩ নং বিলের মাধ্যমে ওই কাজের জন্য প্রায় ২৬ লাখ ৫১ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়।

এ কাজের প্রাক্কলনের আইটেম নং ১-এর প্রাক্কলিত কাজের পরিমাপ ছিল ৮২৫ ঘনমিটার, ৮-এর পরিমাপ ছিল ১.২৫ ঘনমিটার, ৯-এর ২৫ বর্গমিটার, ১৬-এর ৭১৫.৭৯ কেজি এবং ২৪-এর পরিমাপ ছিল ৬ হাজার ৬৫০ কেজি।

কিন্তু ১-এর প্রাক্কলিত কাজের বিপরীতে বিলে পরিমাপ দেখানো হয় ৩ হাজার ৮৮৫ ঘনমিটার, ৮ নং-এর বিপরীতে দেখানো হয় ১০ দশমিক ১২৫ ঘনমিটার, ৯-এর বিপরীতে ৭১ বর্গমিটার, ১৬-এর বিপরীতে ৭৯২ দশমিক ৮৫ কেজি এবং ২৪-এর বিপরীতে ৭ হাজার ৮৫৭ দশমিক ৮৫ কেজি।

প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি কাজ দেখিয়ে বিল পরিশোধ হয় ৮ লাখ ১৬ হাজার টাকা।

একইভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর ও সদর উপজেলার ক্ষুদ্রসেচ উন্নয়ন কর্মসূচি থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মেসার্স রেজাউল আলমকে ৪৫ নং বিলে, ২০১৮ সালের ২৬ জুন আলিফ কন্সট্রাকশনকে ২ নং বিলে, ২০১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ৮ নং বিলে, ২৮ ফেব্রুয়ারি সেচনালা নির্মাণ বাবদ ৫৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। এতেও প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি প্রায় ৩ লাখ ৮১ হাজার টাকা।

অপরদিকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আশুগঞ্জের সেলিম মিয়াকে ৬ নং বিলে ও ২০১৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সেচনালা নির্মাণ বাবদ ১০ লাখ ৯১ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। এতে অতিরিক্ত খরচ হয় ৪৭ হাজার টাকা।

বিএডিসির সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক জানিয়েছেন, দরপত্র আহ্বানের আগে সাইটের নাম উল্লেখ না করে একটি মডেল প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়। পরে সাইট সিলেকশনের পর সয়েল টেস্ট করে নকশা প্রস্তুত করার পর কাজের পরিমাণ সংশোধন করা হয়। কিন্তু ঠিকাদার যে দর দিয়েছেন তা প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে ১০ শতাংশ কম হওয়ায় বেশি কাজ হয়নি।

প্রাক্কলিত দরের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে না

প্রকল্প পরিচালকের এই জবাব গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করছে নিরীক্ষা দল। তারা বলছে, নথিতে রক্ষিত প্রাক্কলনের ভিত্তিতে অনিয়ম ধরা পড়েছে। নথিতে সংশোধিত প্রাক্কলন পাওয়া যায়নি। কর্তৃপক্ষকে সংশোধিত কোনও প্রাক্কলনও দেওয়া হয়নি। এতে পিপিএ ২০০৬-এর ধারা ৬৪ (৩) লঙ্ঘন হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও অতিরিক্ত পরিশোধিত অর্থ আদায় করে কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে।

বিভিন্ন পূর্তকাজের কার্যাদেশেও প্রদত্ত মূল্যের চেয়ে ঠিকাদারদের অতিরিক্ত বিল দেওয়া হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর ও সদর উপজেলার ক্ষুদ্রসেচ উন্নয়ন কর্মসূচির ২০১৫-১৮ অর্থবছরের হিসাব কর্মসূচির ব্যয় বিবরণী, বিভিন্ন পূর্তকাজের কার্যাদেশ, বিল ও নথিপত্র এবং আনুষঙ্গিক রেকর্ডপত্র যাচাই করা হয়। এতে দেখা যায় যে, ওয়াটার পাস বা কন্ডুইট নির্মাণ ও আরসিসি আউটলেট নির্মাণকাজের কার্যাদেশে ঠিকাদারকে অতিরিক্ত বিল দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ঠিকাদারকে কোনও লিখিত নোটিশ দেওয়া হয়নি। ভেরিয়েশন অর্ডারও জারি হয়নি। তারপরও ঠিকাদার অতিরিক্ত কাজ দেখিয়ে বেশি বিল নিয়েছে। এতে সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়েছে ২ লাখ ৯ হাজার টাকা। যা ঠিকাদারদের কাছ থেকেই আদায়যোগ্য বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

এ বিষয়ে নিয়ে জানতে চাইলে সিলেট সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ও নির্বাহী প্রকৌশলী প্রনজিত কুমার দেব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এগুলোতো প্রকল্প থেকে কেনা। প্রকল্পের মেয়াদ শেষে আপত্তিগুলো হেড অফিস দেখে। এখন তা কোন অবস্থায় আছে তা জানা নেই।’

জানতে চাইলে বিএডিসি’র চেয়ারম্যান ড. অমিতাভ সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিষয়গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে জবাব চেয়েছি। এটা নিষ্পত্তি করা না হলে তারা পেনশন পাবেন না।’

/এফএ/
টাইমলাইন: বিএডিসিতে অনিয়ম
১৪ জুলাই ২০২১, ১২:৫৭
১৩ জুলাই ২০২১, ১১:০০
১২ জুলাই ২০২১, ১৫:০০
খরচের চেয়ে বিল বেশি!
সম্পর্কিত
কার পকেটে গেলো রেলওয়ের ৯৭ লাখ টাকা?
নিয়ম ভঙ্গ করে ওয়াসার প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ
শ্যালক-দুলাভাইয়ের পারিবারিক দুদক!
সর্বশেষ খবর
কুড়িয়ে পাওয়া সাড়ে চার লাখ টাকা ফিরিয়ে দিলেন ইজিবাইকচালক
কুড়িয়ে পাওয়া সাড়ে চার লাখ টাকা ফিরিয়ে দিলেন ইজিবাইকচালক
সরকার ক্ষমতায় থাকতে ভোটের ওপর নির্ভর করে না: সাকি
সরকার ক্ষমতায় থাকতে ভোটের ওপর নির্ভর করে না: সাকি
ঢাকার পর্দায় আবার গডজিলা-কিং কং দ্বৈরথ
ঢাকার পর্দায় আবার গডজিলা-কিং কং দ্বৈরথ
বিপজ্জনক অবস্থা থেকে ফিরেছেন খালেদা জিয়া: মির্জা ফখরুল
বিপজ্জনক অবস্থা থেকে ফিরেছেন খালেদা জিয়া: মির্জা ফখরুল
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
কারাগারে যেভাবে সেহরি-ইফতার করেন কয়েদিরা
কারাগারে যেভাবে সেহরি-ইফতার করেন কয়েদিরা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি