X
শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪
৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
গোপীবাগে ট্রেনে আগুন

৪০ দিন পর বুঝিয়ে দেওয়া হলো লাশ, এখন বিচারের অপেক্ষা

কবির হোসেন
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:০০আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:১৮

‘পোশাক কারখানায় কাজ করি। বেশিরভাগই সময় কাজেই ব্যস্ত থাকতাম। স্ত্রী-পরিবারকে সময় দিতে পারতাম না। সংসার আগলে রেখেছিল আমার  স্ত্রী এলিনা। আমাদের ছয় মাসের একটি ছেলে সন্তান আছে। কাছে পায় না বলে সে আমাকে তার মায়ের মতো করে চেনে না। বাচ্চাটার হার্টে একটা ছিদ্র আছে, অণ্ডকোষেও সমস্যা। তার চিকিৎসার জন্য ১৭ জানুয়ারি ভারতে যাওয়ার কথা ছিল আমাদের। কিন্তু যাওয়া হলো না। বুঝতে পারিনি আমার স্ত্রী এভাবে চলে যাবে। কারও যেন এরকম মৃত্যু না হয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় আমার স্ত্রীসহ কয়েকজন মারা গেলেন, আমার বাচ্চা সারা জীবন কী বলবে? রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে সাধারণ জনগণকে কেন ভুগতে হবে?’

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মর্গের পাশে স্ত্রীর মরদেহ বুঝে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন চপল। এসময় বাংলা ট্রিবিউনকে এসব কথা বলেন তিনি। প্রায় ৪০ দিন আগে গত ৫ জানুয়ারি রাতে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে মারা যান তার স্ত্রী এলিনা ইয়াসমিনসহ (৪০) চার জন। এমনভাবে পুড়ে যায় যে লাশের পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। ৪০ দিন লেগে যায় ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত করতে। আজ বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) যার যার পরিবারের কাছে চারটি লাশ হস্তান্তর করে রেলওয়ে থানা পুলিশ।

স্ত্রীর লাশ নিতে মর্গের সামনে সকাল থেকে অপেক্ষা করছিলেন চপল, আহাজারি আর আক্ষেপ নিয়ে মনে করছিলেন সংসারের নানা স্মৃতি

চপল আরও জানান, মা-হারা ছেলেকে সামলানোই কঠিন হয়ে গেছে। মাকে না পেয়ে যার কোলেই ওঠে, সেখানেই কান্নাকাটি করে সে।

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ঢামেক মর্গের সামনে অপেক্ষা করছিলেন বেনাপোল এক্সপ্রেসের অগ্নিকাণ্ডে নিহত চার জনের পরিবারের সদস্যরা। এলিনা ইয়াসমিন ছাড়াও নাতাশা জেসমিন নেকি (২৫), আবু তালহা (২৪) ও চন্দ্রিমা চৌধুরী সৌমির (২৮) মরদেহ স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। লাশ নিতে আসা এই মানুষগুলোর দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে মর্গ এলাকা। তাদের কেউ কেউ পরিবারের হারিয়ে ফেলা সদস্যের স্মৃতিচারণা করছিলেন বারবার, শেষ মুহূর্তের ঘটনাগুলো বলার চেষ্টা করছিলেন। সঙ্গে চলছিল আহাজারি।

এলিনা ইয়াসমিনের লাশ নিতে তার স্বামীর পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন ভাই মনিরুজ্জামান মামুন। নাতাশা জেসমিনের মরদেহ বুঝে নেন তার বড় ভাই খুরশীদ আহমেদ। আবু তালহার মরদেহ গ্রহণ করেন তার মামা মনিরুল ইসলাম এবং চন্দ্রিমা চৌধুরীর মরদেহ গ্রহণ করেন বড় ভাই ডা. দিবাকর চৌধুরী।

নাতাশার বোনের স্বামী এহতেশাম নেওয়াজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে জেসমিন ছিল সবার ছোট। সে রাজধানীর ওয়ারী অ্যাকাডেমিয়া স্কুলে শিক্ষিকা ছিল। আমরা ওয়ারীতে থাকি। নাতাশা তার স্বামীকে নিয়ে থাকতো নারিন্দায়। ঘটনার আগে নাতাশা তার স্বামীকে নিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকায় তার মামাশ্বশুরের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। বেড়ানো শেষে ঘটনার দিন ভাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে ওই ট্রেনে রওনা দিয়েছিল তারা। কে জানতো এভাবে পুড়ে সে মারা যাবে! গত ২৫ জানুয়ারি তাদের বিবাহবার্ষিকী ছিল। এর আগেই তাকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হলো! তার স্বামীও দগ্ধ হয়েছিল, বর্তমানে সে বাসায় আছেন। মেয়ে হারানোর কষ্ট সহ্য করতে পারছেন না আমার শ্বশুর-শাশুড়ি। উনারা অসুস্থ হয়ে বাসায় পড়ে আছেন। মর্গে আসতে পারেননি।

ট্রেনে পুড়ে মারা যাওয়া চার জনের মরদেহ ৪০ দিন পর বৃহস্পতিবার বুঝে নেন স্বজনরা

তিনি আরও জানান, যত দ্রুত সম্ভব মরদেহ রাজধানীর ওয়ারীর নারিন্দা এলাকায় পঞ্চায়েত কবরস্থানে দাফন করার ব্যবস্থা করা হবে।

নাতাশার বড় ভাই খুরশীদ আহাম্মেদ বলেন, ৪০ দিন অপেক্ষার পর আমার বোনের মরদেহ বুঝে পেলাম। এই ৪০টা দিন আমাদের পরিবারের কীভাবে কেটেছে বোঝানো যাবে না। এরকম ঘটনার শিকার যেন কেউ না হয়! নৃশংস এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি। এ ঘটনার পেছনে যারাই জড়িত আমরা তাদের কঠিন বিচার চাই। এছাড়া মরদেহ খুঁজে বের করতে কতো সময় লেগেছে, এই প্রক্রিয়াটা যেন দ্রুত হয়। এভাবে অপেক্ষা করা কতোটা বেদনার, যাদের হারিয়েছে তারাই শুধু বুঝতে পারেন।

নিহত আবু তালহার (২৩) মামা মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, রাজবাড়ী স্টেশন থেকে আমার ভাগ্নে ওই ট্রেনে উঠেছিল। ঢাকায় পৌঁছানোর পর তার আরেকটি ট্রেনে ওই রাতেই পঞ্চগড়ে যাওয়ার কথা ছিল। অগ্রিম টিকিটও কাটা ছিল। সেই যে নিখোঁজ হলো, আর পেলাম না তাকে। আজ আমরা পুড়ে অঙ্গার হওয়া মরদেহ নিয়ে রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলায় তার নিজ গ্রামে যাচ্ছি।

চন্দ্রিমা চৌধুরী সৌমির চাচাতো ভাই অনিন্দ্য বলেন, এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি থেকে ফার্মাসিতে গ্র্যাজুয়েশন করেছিল সৌমি। তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে রাজধানীর ফার্মগেটে থাকতো। ট্রেনে আগুন লাগার ১০ মিনিট আগেও তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। এরপর থেকেই আমরা খোঁজাখুঁজি করেছি। একসময় আমরা ধরেই নিয়েছিলাম মর্গে পড়ে থাকা চার জনের মধ্যে একজন সৌমি। আজ মর্গ থেকে তার মরদেহ নিয়ে রাজবাড়ী যাচ্ছি। সেখানে তার শেষকৃত্য হবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদৌস আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, চারটি দেহ আগুনে এমনভাবে দগ্ধ হয়েছিল যে কোনোভাবেই পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না। নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজছিলেন তাদের স্বজনরা। পরবর্তী সময়ে আমরা আদালতের অনুমতি নিয়ে মরদেহ দাবিদার চার পরিবারের স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি আমরা ডিএনএ রিপোর্ট হাতে পাই। এরপর আমরা কোর্টে আবেদন করি। কোর্ট নির্দেশ দেওয়ার পরপরই আমরা তাদের স্বজনদের খবর পাঠাই, মর্গে আসতে বলি।

এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গতকাল পুলিশ সদর দফতর থেকে আমরা একটি চিঠি পেয়েছি। পুলিশের পাশাপাশি মামলার ছায়াতদন্ত করবে আরও দুটি সংস্থা, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এছাড়া জড়িতদের খুঁজে বের করতে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারিনি।.

/এফএস/এমওএফ/
টাইমলাইন: ট্রেনে আগুন ঘটনা
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:০০
৪০ দিন পর বুঝিয়ে দেওয়া হলো লাশ, এখন বিচারের অপেক্ষা
০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ২৩:৪৬
সম্পর্কিত
৩০০ ফুট সড়কে বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে ‘ওভার স্পিড’ মামলা
সড়কে অসুস্থ হয়ে আনসার সদস্যের মৃত্যু
বুদ্ধ পূর্ণিমা ঘিরে কোনও ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি’ দেখছে না ডিএমপি
সর্বশেষ খবর
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের অধ্যায়
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের অধ্যায়
ত্বক তারুণ্যদীপ্ত দেখানোর ৮ টিপস 
ত্বক তারুণ্যদীপ্ত দেখানোর ৮ টিপস 
আসছে না পাকিস্তান, প্রথমবার খেলবে উগান্ডা 
আসছে না পাকিস্তান, প্রথমবার খেলবে উগান্ডা 
‘গডফাদার’ স্রষ্টাকে শুরুতে ৪, শেষে ৭ মিনিটের করতালি
কান উৎসব ২০২৪‘গডফাদার’ স্রষ্টাকে শুরুতে ৪, শেষে ৭ মিনিটের করতালি
সর্বাধিক পঠিত
সিলেটে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
সিলেটে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
জাহাজে ওঠার পর কোরআনের সুরা শুনিয়ে দস্যুদের নিবৃত্ত করা হয়
জাহাজে ওঠার পর কোরআনের সুরা শুনিয়ে দস্যুদের নিবৃত্ত করা হয়
এমপিও আবেদন সরাসরি অধিদফতরে পাঠানো যাবে না
এমপিও আবেদন সরাসরি অধিদফতরে পাঠানো যাবে না
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের বিরুদ্ধে আসতে পারে আইনি ব্যবস্থা
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের বিরুদ্ধে আসতে পারে আইনি ব্যবস্থা
ফুল দিয়ে বরণ, রিট দিয়ে শুরু কোন্দল!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিফুল দিয়ে বরণ, রিট দিয়ে শুরু কোন্দল!