X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুর, বেসুর আর অসুর

মাকসুদুল হক
১৫ মে ২০১৬, ১৭:০৪আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২১, ১১:৫৩

মাকসুদুল হক ইউটিউবে কয়েকদিন আগে কোনও এক চ্যানেলের শিল্পী বাছায় প্রতিযোগিতায় দেখলাম, একজন দেশ বরেণ্য গায়িকা নবীন এক শিল্পীকে হেদায়েত করছেন এই মর্মে, ‘গান যখন গাইবে, তখন গান থেকে একটু নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখো। গানের ভেতরে বেশি ডুবে গেলে যে সমস্যাটা হয়, তা হলো ইমোশনাল হয়ে গেলে তোমার কান্না আসবে। আর যে মুহূর্তে এটা ঘটবে তোমার সুর বিচ্যুত হয়ে গান হয়ে যাবে বেসুরো। অনেক বিখ্যাত ক্রিটিক (সমালোচক) বলেন an artist must maintain a distance from their art.’
কথাটা শুনে বড্ড হোঁচট খেলাম। গান গাওয়া কি কোনও গাড়ি ড্রাইভ করার মতো কৌশল যে, 'নিরাপদ দূরত্ব' বজায় রাখতে হবে? আর কোন ক্রিটিকের গান এ পর্যন্ত  শ্রোতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে? ক্রিটিকের  একমাত্র কাজ ক্রিটিসাইজ করা, তবে তার একার কথা  সত্য বা ‘সর্বশেষ কথা’ এমন কোনও হাদিস কোথাও লেখা আছে? গান কি কোনও কুস্তি খেলা নাকি তা দূর পাল্লার দৌড়। আমি বলব, গান কুস্তি আর দৌড়ের মাঝামাঝি অবস্থান করে।
একজন শিল্পী যখন গান পরিবেশন করেন, তখন প্রথম 'কুস্তিটা' হলো তার কণ্ঠ—যা একটি প্রকৃতি প্রদত্ত যন্ত্র বনাম মানুষের আবিষ্কৃত বাদ্যযন্ত্র; যার সুর, তাল, মাত্রা, লয় সব কিছুই মেকানিক্যালি বা যান্ত্রিকভাবেই (কন্ট্রোল) নিয়ন্ত্রণ  করা যায়—এর সঙ্গে ব্যাপক লড়াই। মানবকণ্ঠ  কখনোই ১০০% 'হালাল সুর' ডেলিভারি দিতে পারে না। আর এটা আশা করা বিলকুল বোকামি।  

আরও পড়তে পারেন: জন্মোৎসবে আগত তারকাদের আরও ছবি

তবে কি আমি 'বেসুরো' গান গাওয়াকে প্রশ্রয় দিচ্ছি? একেবারে না। আমার শুধু একটিই লক্ষ্য, কেউ বেসুরো গাচ্ছেন, এই অপবাদ দেওয়ার আগে একটু ভাববেন শিল্পীর গান কি আগাগোড়াই বেসুরো? যদি তাই হয়, তাহলে যিনি গান করছেন তিনি কোনও শিল্পী নন বা তার কণ্ঠশিল্পী হওয়ার কোনও যোগ্যতাই নেই।  

উল্টোদিকে মানুষের ইমোশন কখনোই যন্ত্রের মতো কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। যারা ইমোশনকে নিয়ন্ত্রণ করে গান করেন, তারা শিল্পীসত্তার সঙ্গে প্রতারণা করেন। তাদের এই 'শিল্প' রোবটের মতো এবং রোবট দ্বারা পরিচালিত। তবু, মানবদেহের ভেতরে যদি  সেই রোবট থাকে ও মানবকণ্ঠ দিয়ে শিল্পী গান করেন, তা হলে আবার বলছি  ১০০% 'হালাল সুরে' গান গাওয়া সম্ভব নয়। মানুষের কানকে ধোঁকা দেওয়া এত সহজ নয়।

সুর বিচ্যুতি হয় না এমন কণ্ঠশিল্পী পৃথিবীতে নেই।  বিশেষ করে লাইভ পারফরমেন্সের ক্ষেত্রে । যখন এটা ঘটে, তখন আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো, অধিকাংশ সময় আমরা কণ্ঠশিল্পীদের দিকেই আঙুল তাক করি, একবারও চিন্তা করি না যে, সঙ্গের বাদ্যযন্ত্রীদের কোনও ভুল হচ্ছে কি না। যদি কৃত্রিম যন্ত্রেই সুরে না থাকে, বা কাঁচা ম্যাজিশিয়ানদের আবহ ও যন্ত্রসঙ্গীত পরিচালনায়  গলদ থাকে, একজন কণ্ঠশিল্পীর পক্ষে কখনোই সুর ঠিক রেখে গান করা সম্ভব নয়। টেলিভিশনের অনুষ্ঠানগুলোয় বিশেষ করে প্রতিযোগিতায় যন্ত্রশিল্পীদের সীমাবদ্ধতা ও ক্ষেত্র বিশেষে 'পলিটিক্স'-এর শিকার হন বহু নবীন শিল্পী।

সুর যেমন আছে, তেমন আছে বেসুর। আমার বিবেচনায় বেসুরও এক ধরনের সুর। মাঝামাঝি অবস্থান করে 'অসুর'। অসুরের দাপটে বহু প্রতিভাবান শিল্পীর জীবন ও ক্যারিয়ার ভেস্তে গেছে। আমরা তা হলে কোন মানদণ্ড রাখব? কোনটা সুর আর কোনটা বেসুর?

প্রথমত, কাউকে বেসুরো বলার আগে খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের নিজের কানের কী অবস্থা? কণ্ঠশিল্পীরা বিশেষ করে প্রতিযোগিতার বিচারকরা কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনার অর্থই হচ্ছে তারা নিজেরাই কানে ভালোমতো শুনতে পারছেন না। এমন হতে পারে রুমের  অবস্থা এতটাই খারাপ যে, হেডফোন ছাড়া কোনওভাবেই জাজমেন্ট দেওয়া সম্ভব নয়। এটাও কোনও দোষ নয়। তবে খেয়াল করেছি যে, তাদের সব চেষ্টা থাকে শুধু 'গান' বা কণ্ঠকে ফলো করার। যন্ত্রীরা কী বাজাচ্ছেন বা তাদের যন্ত্রগুলো সুরে আছে কিনা সেদিকে খেয়াল কখনোই থাকে না।

একজন শিল্পীর গান—সে হোক ৩ বা ৫ মিনিট। আর অন্য কিছু না। কেবলই তার ইমোশনের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। সেই ইমোশন ও তার প্রকৃত ডেলিভারি শিল্পী ও শিল্পকে শক্ত ভিতের ওপরে দাঁড় করায়।একজন শিল্পীকে তার ইমোশন নিয়ন্ত্রণ করার উপদেশ দেওয়ার অর্থই হলো তাকে কৃত্রিমতার দিকে ঠেলে দেওয়া। আর্টিফিশিয়াল গানের ভিড়ে ন্যাচারাল শিল্পীদের কদর এমনিতেই অনেক কমে যাচ্ছে। এটা মহামারী আকার যেন ধারণ না করে, সেদিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বিশেষ করে সেই সব কণ্ঠশিল্পীর যারা বিভিন্ন টেলিভশন  চ্যানেলের প্রতিযোগিতায় বিচারকের মঞ্চ আলোকিত করেন।

লালন সাঁইজি যেমনটি বলেছেন, ‘গুরু পদে ডুবে থাকরে আমার মন/ গুরু পদে না ডুবিলে তোর জনম যাবে অকারণ/ থাকরে আমার মন।’ 
লেখক: ব্যান্ডশিল্পী                   

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ