X
বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

উল্টোপথে টেলিভিশন

সিমিত রায় অন্তর
০৩ ডিসেম্বর ২০১৫, ১৩:৫১আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫, ১৪:৫৭

Simin Ray Ontor বিদেশি চ্যানেলে দেশি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন করেছে টেলিভিশন মার্কেটিং ও নাট্যব্যক্তিত্বরা। এমনটা যে হবে, তা অনেক আগেই ধারণা করেছিলাম। বহুবার তা বলেছি ফেসবুক স্ট্যাটাস অথবা পত্রিকার কলামে। মাত্র একটা বড় প্রতিষ্ঠান ভারতীয় চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করাতেই এই অবস্থা! এতটাই নড়বড়ে আমাদের টিভি ইন্ডাস্ট্রি!

আসলে মানববন্ধন বা টকশো’তে আলোচনার ঝড় তুলে এর সমাধান সম্ভব নয়। আগে আমাদের মূল সমস্যাটা কোথায় জানতে হবে। সেই মোতাবেক ব্যবস্থা।

আমাদের দেশের প্রতিটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের প্রধান ও একমাত্র আয়ের উৎস বিজ্ঞাপন। যার জন্য টেলিভিশনকে বিজ্ঞাপনের কাছে জিম্মি হয়ে যেতে হয়েছে। প্রতিটি টিভি চ্যানেলেই আছে মার্কেটিং বিভাগ। অথচ হওয়া উচিত ছিল উল্টোটা। বিজ্ঞাপনদাতার মার্কেটিং বিভাগ আসবেন টিভিতে তাদের বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য। এখন বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য বিজ্ঞাপনদাতার চেয়ে টিভি কর্তৃপক্ষেরই যেন দায় বেশি।

কোনও প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন সেখানেই দেয় যেখানে তার টার্গেট দর্শক বেশি। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমাদের টিভি চ্যানেলের চেয়ে বহুগুণ বেশি দর্শক ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর। তাহলে বিজ্ঞাপনদাতারা কেন সেদিকে ঝুঁকবে না? আর যদি বিদেশি চ্যানেলগুলোতে আমাদের বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধের দাবি তুলি, তাহলে আমাদের দেশেও তো বিদেশি বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করতে হবে। তাতে কী অবস্থা হবে তা ভাবনার বিষয়।

দেশীয় চ্যানেলে দেশি বিজ্ঞাপন কমে যাওয়ার একটাই কারণ, তা হলো দেশীয় চ্যানেলের দর্শকপ্রিয়তা কমে যাওয়া। আর দর্শকপ্রিয়তা কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে অনেকগুলো কারণ।

প্রথমতঃ আমাদের সংবাদের চ্যানেল ছাড়া প্রতিটি চ্যানেলই খিচুড়ি চ্যানেল। মানে এক চ্যানেলেই নাটক, সিনেমা, গান, টকশো, সংবাদ, খেলা, কার্টুন ইত্যাদি প্রচার করা হয়। অথচ হওয়া উচিত ছিল উল্টোটা। একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে টিভি চ্যানেল হলে দর্শকপ্রিয়তা বাড়ানো যেত। এক চ্যানেল দিয়ে সকল শ্রেণির দর্শকদের ধরার অভিপ্রায়ে আসলে কাউকেই ধরা যাচ্ছে না। অস্বীকার করা যাবে না, টিভির সিংহভাগ দর্শক নারী। টেলিভিশন ড্রয়িংরুম মিডিয়া। সারাদিনের কাজের ফাঁকে বিনোদন খুঁজতে টিভি দেখে অনেকে। কিন্তু তাদের জন্য আমাদের চ্যানেলে অনুষ্ঠানের সংখ্যা নিতান্তই হাতেগোনা। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গের টিভিতে নারীদের জন্য নির্মিত হচ্ছে অনুষ্ঠান। খেয়াল করলে দেখা যায়, ভারতীয় সকল নাটকের সময়সূচি সন্ধ্যা থেকে রাত নয়টা। কারণ ওই সময়টায় তাদের অবসর থাকে।

তাদের চ্যানেল পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তারা শুধু বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করে চলছে না। তাদের আয়ের সিংহভাগ আসে দর্শকদের কাছ থেকেও। তাই তাদের চ্যানেলে পণ্যের বিজ্ঞাপনের চেয়ে নিজেদের প্রোগ্রামের প্রমো বেশি প্রচার হয়। এমনকি প্রোগ্রাম হয়ে যাওয়ার পরও প্রমো চলতে দেখা গেছে। তাদের প্রধান টার্গেটই হলো দর্শকদের চাহিদা পূরণের। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে উল্টো। দর্শকের কাছে কোনও চ্যানেলেরই যেন দায় নেই। কারণ দর্শকের কাছ থেকে তার কোনও আয় নেই। সে দর্শকদের ফ্রিতে চ্যানেলে দেখাচ্ছে। ফ্রিতে দেখালেই যে দর্শক তা দেখতে বাধ্য তা তো নয়। ঠিক এই কারণগুলোতেই দেশের আপামর মানুষ দেশীয় টিভি থেকে মুখ ফিরিয়ে ভারতীয় চ্যানেল দেখছে।

এবার আসি এর থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে।

একটা সময় আমাদের দেশে নাটকের প্রচুর দর্শক ছিল। আমি বিশ্বাস করি তারা এখনও আছে। শুধু আমাদের নাটকের মানের কারণে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভাল নাটক হলে এখনও তারা ইউটিউব থেকে দেখে নেয়। ভাল নাটক না হওয়ার পেছনে বাজেট একটি বড় কারণ। নাটকের বাজেট দিন দিন কমতে কমতে যে পর্যায়ে এসেছে, তা দিয়ে ভালো-মানের নাটক নির্মাণ করা এখন আর সম্ভব হয়ে উঠছে না। আর বাজেট কমার কারণ বিজ্ঞাপনের রেট কমে যাওয়া। টিভির আয় নেই, তারা বেশি দামে নাটক ক্রয় করবে কিভাবে? টিভির আয় বাড়লে নাটকেরও বাজেট বাড়বে, ফলে ভাল নাটকও নির্মাণ হবে। তাই টিভির আয় বাড়ানো প্রয়োজন। কিভাবে?

টিভির আয় বাড়াতে হলে প্রথমে ব্যয় কমাতে হবে। আমাদের প্রতিটি চ্যানেলেই খিচুড়ি টাইপের হওয়াতে এখানে বিশাল কর্মচারীর বেতনভাতাসহ অনেক খরচ বহন করতে হয়। প্রতিটি টিভি চ্যানেলে সংবাদ প্রচারের কারণেই খরচটা বেড়ে যাচ্ছে। সংবাদ প্রচারের জন্য একাধিক গাড়ি, ক্যামেরা, এডিট প্যানেল, রিপোর্টার, প্রেজেন্টার, সম্পাদক প্রয়োজন হয়। যা ব্যয়বহুল। আধাঘণ্টা করে প্রতি ঘণ্টা সংবাদের হিসেবে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা শুধু সংবাদই প্রচার হয় প্রতি চ্যানেলে। এক সংবাদ সারাদিন ধরে দেখার কী আছে? তারপর একসাথে সকল চ্যানেলে শুরু হয় টক শো। যা আসলেই বিরক্তিকর। আমার ইচ্ছে করলেও বিনোদন নেওয়ার মতো কোনও চ্যানেল নেই।

তাই সর্বপ্রথমে বিনোদন, মিউজিক, সিনেমা, সংবাদ, খেলা; এর যে কোনও একটি নির্দিষ্ট বিভাগ বেছে চ্যানেলকে সাজাতে হবে। প্রতিদিন চব্বিশ ঘণ্টার পরিবর্তে মাত্র ছয় ঘণ্টার অনুষ্ঠানমালা দিয়ে সাজাতে হবে। যা সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত প্রচারিত হবে। বাকি সময় এই অনুষ্ঠানগুলোই উল্টেপাল্টে রিপিট হবে। বিনোদন চ্যানেলে কোনও ধরনের স্ক্রল, সংবাদ, টকশো, খেলা প্রচার করা যাবে না। অনুষ্ঠানমালার মধ্যে সিংহভাগ থাকবে নাটক। বাংলা চ্যানেলগুলোর মূল দর্শক বয়স্করাই। তাই নাটকের বিষয়বস্তু হতে হবে তাদের রুচিমাফিক। তারা তরুণদের মুখে ‘আসছিস’, ‘যাচ্ছিস’ বা রুচিহীন শব্দ শুনতে চায় না। তারা চায় সামাজিক, ফোক গল্প। যেখানে জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। মূল কথা, বিনোদন চ্যানেলের সবটাই যেন হয় বিনোদন।

একটি পর্যায়ে চ্যানেলকে ফ্রি চ্যানেল থেকে পে-চ্যানেলে রূপান্তর করতে হবে। যেন দর্শকের কাছে দায়বদ্ধতা বাড়ে। বিজ্ঞাপন হলো পিঁপড়ার মতো, মিষ্টি যেদিকে বেশি থাকবে সেদিকেই তারা ছুটবে। সুতরাং দর্শক আপনার সাথে থাকলে বিজ্ঞাপনের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারবেন। তখন টিভির মার্কেটিং বিভাগ না থাকলেও চলবে। উল্টো দেখা যাবে, বিজ্ঞাপনদাতারাই আপনার টিভিতে বিজ্ঞাপন দিতে লাইন ধরেছে। ফলে অল্প বিজ্ঞাপনেই বেশি আয় করা সম্ভব হবে। আর তাতে অতিরিক্ত বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণা থেকেও দর্শক মুক্তি পাবে।

ভারতে বাংলাদেশের চ্যানেল চলতে আইনত বাধা নেই। কিন্তু ভারতীয় আইন অনুযায়ী কিছু শর্ত পূরণের কারণেই আমাদের দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলো প্রচারে আগ্রহী হচ্ছে না ভারত। ভারতীয় আইন অনুযায়ী কোনও বিদেশি টিভি ভারতে প্রচার করতে হলে, নতুন করে ভারতে ডাউনলোড ফ্রিকোয়েন্সি নিতে হয়, মানে নতুন করে ভারতীয় লাইসেন্স নিতে হয়। যার জন্য বেশ মোটা অংকের টাকা ভারত সরকারকে দিতে হয়। এ ছাড়া বাৎসরিক একটা চার্জ তো থাকছেই। তারা যাতে সকল বিদেশি চ্যানেলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সে জন্যই এমনটা করা। যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ, কিছুদিন আগে বিবিসি কর্তৃক দিল্লির বাসে ধর্ষণের ওপর একটি প্রতিবেদন ভারতে প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। সারাবিশ্বে বিবিসিতে তা প্রচার হলেও ভারতের বিবিসিতে তা প্রচার হয়নি। আর তা করা সম্ভব হয়েছিল শুধু সেই লাইসেন্স (ডাউনলোড ফ্রিকোয়েন্সি) এর কল্যাণেই।

এটা তাদের আইন। তা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সকল দেশের জন্যই প্রযোজ্য। আমাদের টিভি ভারতে প্রচার করতে হলে সেই আইন মেনেই করতে হবে। আমাদের দেশে এই ধরনের আইন নেই, তার জন্য তো তারা আমাদেরটা ফ্রিতে চালাবে না। আমরা বোকা বলে তাদেরটা ফ্রিতে চালাচ্ছি। আমাদের দেশেও এই ধরনের আইন থাকাটা জরুরি ছিল। কিন্তু এখন সেই আইন করা এবং তা প্রয়োগ করা অনেক কষ্টকর হয়ে যাবে। একটি গাছ ছোট থাকতে একস্থান থেকে অন্যস্থানে সরানো যায়, কিন্তু তার শেকড় মাটির অনেক ভেতরে ছড়িয়ে গেলে সম্ভব হয় না। আর যদি তা হয় আবার বটবৃক্ষ!

সুতরাং, ভারত আমাদের টিভি চ্যানেল প্রচার করে না, এই মুখস্তবুলি থেকে দূরে এসে আমাদের উচিত হবে দেশেও এই ধরনের আইনের দাবি করা।

মূলকথা হলো, ভারতীয় নাটকের অনুকরণে শুধু ক্যামেরা ইফেক্ট দিয়ে নাটক বানালেই তা দর্শক গ্রহণ করবে না। কারণ আপনার সিস্টেমটাই ভাল না। ভারতীয় চ্যানেলের নাটকের কপির মতো তাদের সিস্টেমটাকেও কপি করতে হবে। তাদের মতো প্রোগ্রাম ক্যাটাগরি ওয়াইজড চ্যানেল গঠন করতে হবে। তখন আশা করি আমাদের সুদিন ফিরে আসবে। নইলে সামনে অন্ধকার। বিশ্বায়নের যুগে কাউকে জোর করে কোনও কিছু দেখা বন্ধ তো করতে পারবেন না। আইন করে বিদেশি চ্যানেল প্রদর্শন বন্ধ করতে পারবেন, কিন্তু দেশি চ্যানেল দেখাতে তো পারবেন না। দেখাতে হলে অবশ্যই দর্শকের চাহিদা পূরণ করেই দেখাতে হবে। দর্শকের সাধাসিধে চাওয়া- পরিষ্কার পর্দায় সময়মাফিক নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপন বিরতিতে নাটক/প্রোগ্রাম দেখা। ব্যস! এইটুকও কি আমরা দিতে পারি না?

লেখক: নাট্যনির্মাতা

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজীপুরে ব্যাটারি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে চীনা প্রকৌশলীর মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ ৬
গাজীপুরে ব্যাটারি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে চীনা প্রকৌশলীর মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ ৬
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ