মেয়েটি কবিতা লিখত। কবিতায় সে নদী, বৃক্ষ এবং ফুলের কথা লিখত, মেয়েটি ভালোবাসার কথাও লিখত। লিখত গোপনে। কারণ বাড়ির কেউ যদি দেখে ফেলে সে কবিতা লিখেছে, তবে আর আস্ত রাখবে না তাকে। সবাই বলবে মেয়ে নিশ্চয়ই প্রেমে পড়েছে। আসলে দোলন কখনও কারও প্রেমে পড়েনি। প্রেমকে ভীষণ ভয় দোলনের। তার বড় দিদি দোয়েল একবার প্রেম করছিল, আর সেই অপরাধে দোয়েলকে বাড়ির একটি অন্ধকার ঘরে সাতদিন শেকলবন্দি থাকতে হয়, ইদ্রিস আলী সাতদিন পর শেকল খুলে দোয়েলকে কাছে ডাকেন, জিজ্ঞেস করেন – ‘ওই নচ্ছার ছেলেটিকে এখন নিশ্চয়ই ভুলতে পেরেছ, তাই না?’
দোয়েল উত্তর দিয়েছিল – ‘হ্যাঁ বাবা পেরেছি।’
দোলন গানও গাইত। গোপনে। বাথরুমে শাওয়ারের শব্দের সঙ্গে গানের সুর মিলিয়ে যেতে পারে এই সম্ভাবনায় দোলন যা গাইত বাথরুমেই গাইত। মাঝে দু-একদিন সে ছাদে বসেও গাইল, যেন ঘর থেকে শোনা না যায়। কিন্তু শোনা গেল। তাকে ডাকা হলো বাড়ির বৈঠক ঘরে। ইদ্রিস আলী জিজ্ঞেস করলেন- ‘তুমি ছাদে ওঠ?’
‘হ্যাঁ।’
- ‘কেন?’
- ‘বিকেলে ছাদে হাওয়া বয় তো, ভাল লাগে।’
- ‘গান গেয়েছিলে?’
দোলন চুপ করে থাকে। ইদ্রিস আলি চিৎকার করে ওঠেন – ‘আমার মেয়ে হয়ে তুমি এই বাড়িতে গান গাও? তোমার এত স্পর্ধা?’ দোলনের চোখ জ্বালা করে জল ঝরে। ইদ্রিস আলী দোলনের গালে কষে দুটো চড় বসান। দোলন ফুঁপিয়ে বলে – ‘আর গাইব না বাবা।’
দোলন এখন গোপনে কবিতাও লেখে না, গানও গায় না। সে চুপচাপ ঘরে বসে থাকে। তার বিয়ে হবে। কার সঙ্গে বিয়ে হবে দোলন জানে না। তাকে জানানো হয়নি। সে মাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে, এখনও রেজাল্ট হয়নি। আর এই সময়ে ইদ্রিস আলী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি মেয়ের বিয়ে দেবেন, ভাল নাকি পাত্র পেয়েছেন। পাত্র কী করে, কেমন দেখতে, পাত্রের স্বভাব চরিত্র কিছু দোলন জানে না। তাকে আলেয়া বেগম জানিয়ে গেছেন – ‘ওরা তোকে দেখতে আসবে। মাথা নিচু করে বসে থাকবি। ধীরে কথা বলবি, সুন্দর করে, আস্তে। মাথার চুল দেখতে চাইলে চুল খুলে দেখাবি। যদি জিজ্ঞেস করে, রান্না জানো? সেলাই জানো? বলবি জী জানি। যদি হাঁটতে বলে হাঁটবি। শাড়ি তুলে পা টাও দেখতে পারে। গা হাত পা আগে থেকে মেজে ঘষে রাখিস।’
আলেয়া বেগম দোলনের মা। তাঁরও বিয়ে হয়েছিল এই কায়দায়। বরপক্ষ তাঁর চুল, দাঁত, চোখ, হাত পা পরীক্ষা করে তবে ঘরে তুলেছিল। তাই তিনিও সতর্ক করে দিচ্ছেন তাঁর মেয়েকে। তাঁর বড় ইচ্ছে যেন বিয়েটা হয়। বিয়ে হয়ে গেলেই মেয়ের একট গতি হবে।
দোলন সারাদিন শুয়ে থাকে। তাঁর এখন লেখাপড়ার বই হাতে নেওয়া বারণ। কারণ লেখাপড়ার পাট চুকেছে, এখন তাকে জায়নামাজ পেতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হয়। আলেয়া বেগম গলায় তাবিজ পরিয়ে গেছে, দুবেলা বুকে মুখে ফুঁ দিয়ে যান, যেন ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হয়ে যায়। দোলনকে একটি তসবিহ দিয়ে গেছেন তিনি, কিছু দরুদও দিয়েছেন মুখস্থ করতে। মেয়ে ধার্মিক ও পর্দানশীল হলে ভাল হয় বরপক্ষ জানিয়েছে। দোলনকে কাঁচা হলুদ মেখে গোসল করানো হয়। কারণ বরপক্ষ ফর্সা মেয়ে চায়।
দোলনকে ঘরের বার হতে দেওয়া হয় না। স্কুলের বান্ধবীরা দল বেঁধে আসে, হাসে, রসালো গল্প করে, চলে যায়। দোলনের এসব কিছুই ভাল লাগে না। একদিন বরের ছবি নিয়ে ওদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল, সকলে বলল ‘ভালই তো দেখতে, দোলনের সঙ্গে মানাবে ভাল।’ দোলনকে ছাদে উঠতে দেওয়া হয় না। তার খুব ইচ্ছে করে নক্ষত্র, নদী, সমুদ্র ও ঝাউপাতার সঙ্গে মনে মনে কথা বলতে। তার খুব ইচ্ছে করে একটি খোলা মাঠে বসে গলা ছেড়ে গান গাইতে।
দোলনকে একদিন দেখেও গেলও বরপক্ষের গোঁফঅলা দাড়িঅলা লোকজন। একটি শাড়ি পরিয়ে ঘোমটায় মাথা ঢেকে ওদের সামনে তাকে হাজির করা হলো। মেয়ের নতমুখ দেখে সকলের পছন্দ হলো মেয়ে। সকলে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল যে মেয়ে আদব কায়দা জানে, মেয়ে ঘরোয়া হবে, মেয়ে কথা কম বলে, মেয়ে মাথা নিচু করে থাকে, স্বামীর বাধ্য হবে নিশ্চয়। বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেল, দিন ধার্য হলো।
বাড়িতে আনন্দ উৎসব হচ্ছে, কারণ দোলনের বিয়ে হচ্ছে। ভাল বিয়ে হচ্ছে। পাত্র বড় ব্যবসা করে, প্রচুর টাকা পয়সা। দেখতে শুনে ভালো। দোলনের ভাগ্য বটে এমন পাত্র পাওয়া। আলেয়া বেগম উঁচু করে আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে পাত্রের বংশ এবং মাইনে নিয়ে গর্ব করলেন। বিয়ের দিন দোলনকে লাল বেনারসী পরানো হল, মুখে স্নো পাউডার মাখানো হল, কপাল থেকে গাল পর্যন্ত লালসাদা নকশা আঁকা হল। রাতে বর এল। বাড়িতে নিমন্ত্রিতদের ভিড়। ইদ্রিস আলী খুশিতে বাগবাগ, খানিক পর পর মেয়ের সাজসজ্জার নজর করে যাচ্ছেন। একসময় কাজী এলেন দোলনের ঘরে, দোলনকে ঘিরে তখন আত্মীয়স্বজন, মা বাবা পড়শী ও ঘনিষ্ঠ বান্ধবীরা। কাজী সাহেব বিছানার সামনে চেয়ার পেতে বসলেন। বললেন- ‘মোহাম্মদ নেয়ামুল করিমের জ্যেষ্ঠ পুত্র বদরুল আলমের সঙ্গে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেনমোহর বাবদ মোহাম্মদ ইদ্রিস আলীর দ্বিতীয় কন্যা আঞ্জুমান আরা দোলনের বিবাহ তুমি কি কবুল করিয়াছ?
দোলন চুপ হয়ে থাকে। কথা বলে না। সকলে তাকে ঠেলতে থাকে, মা খালা, ফুপু, মামি সকলে ফিসফিস করে শাসায় – ‘দোলন বল, কবুল বল।’
দোলন তবুও চুপ। সে খুঁটে খুঁটে নখের পালিশ তোলে। একটি কথাও বলে না। কাজী সাহেব আবার ওই একই বাক্য উচ্চারণ করে। ইদ্রিস আলী এবার কাছে এসে দোলনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন- ‘মা গো দেরি হয়ে যাচ্ছে, কবুল বলে ফেল।’
দোলন নির্বিকার, সে কারও দিকে তাকায় না, খুব মনযোগ দিয়ে নখের পালিশ খোঁটে। কাজী সাহেব বিরক্ত হন, বিরক্ত হয় উপস্থিত সবাই। সময় পার হয়ে যায় পনেরো মিনিট, কুড়ি মিনিট।
কাজী সাহেব আবার বলেন, ‘বল মা তুমি কি রাজি?’
এবার দোলন মুখ তোলে, মুখ তুলবার কারণে তার মাথার ঘোমটা খসে পড়ে মাথা থেকে। সে তার আত্মীয় বন্ধুদের দিকে একবার তাকায়, তাকায় কাজী সাহেবের দিকে, তারপর ঘৃণায়, অবজ্ঞায়, বেদনায় সে কাজী সাহেবের প্রশ্নের জবাব ছুঁড়ে দেয় – ‘না।’
বিয়ে বাড়ির সকলে অবাক হয়। মাত্র ষোল বছর বয়সের মেয়ের কী স্পর্ধা দেখ, সাহস দেখ, সে এক বাক্যে এত বড় আসর, আয়োজনকে ধুলিসাৎ করে দিল!
এক গাদা আবর্জনার মধ্যে দোলনেরও মনে হয় সে একটি জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি ফেলল।
লেখক: কলামিস্ট
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।