X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইসলাম পরিপন্থী ওয়াজ, উকিল নোটিশ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব

মো. জাকির হোসেন
৩০ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:২০আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:২০

মো. জাকির হোসেন বাংলাদেশে ওয়াজ বা ধর্মীয় সমাবেশে কুরআন এবং বিশুদ্ধ হাদিসের রেফারেন্স বাধ্যতামূলক করে বক্তব্য প্রদানের নির্দেশনা চেয়ে সরকারকে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান। নোটিশে দাবি করা হয়েছে, ওয়াজ মাহফিলে কিছু বক্তা রাষ্ট্রবিরোধী, উসকানিমূলক এবং নানা ধরনের কাল্পনিক বক্তব্য দিয়ে সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। গত ১৮ জানুয়ারি পাঠানো এই লিগ্যাল নোটিশে ৩০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য বলা হয়েছে। অন্যথায় এ বিষয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হবে বলেও নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “ওই ব্যক্তির চেয়ে কার কথা উত্তম হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নেক আমল করে। আর বলে অবশ্যই আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।”(সূরা ফুসসিলাত: ৩৩) ওয়াজের মাধ্যমে যারা মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকছেন তাদের বিষয়ে উকিল নোটিশের ভিত্তি কতটুকু সঠিক এবং এ বিষয়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব কতটুকু তার অনুসন্ধানই এই লেখার বিষয়বস্তু। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় মানুষের ‘নফস’ মন্দ-কর্মপ্রবণ, কিন্তু সে নয়, পালনকর্তা যার প্রতি অনুগ্রহ করেন। নিশ্চয়ই আমার পালনকর্তা ক্ষমাশীল, দয়ালু।”(সূরা ইউসুফ: ৫৩)

মানুষ মন্দ পথ পরিহার করে যাতে সত্যের পথে, স্রষ্টার নির্দেশিত পথে চলতে পারে সেজন্য মহান রব যুগে যুগে তাঁর মনোনীত নবী ও রাসুল প্রেরণ করেছেন। মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবী থেকে বিদায়ের পর আর কোনও নবী-রাসুল আসবেন না বলে মহান আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। একইসঙ্গে মহান রব এটাও জানিয়ে দিয়েছেন যে, এখন থেকে নবী-রাসুলদের পরিবর্তে স্রষ্টার দিকে আহ্বান করা তথা দাওয়াত দেওয়ার দায়িত্ব হবে সাধারণভাবে সকল মুসলমান এবং বিশেষভাবে আলেমসমাজের ওপর। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল যেন থাকে যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে; আর তারাই সফলকাম।” (সূরা আল ইমরান: ১০৪) রাসূল (সা.) বলেন: ‘আমার কাছ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছিয়ে দাও।’(বুখারী, ৩৪৬১)

আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেওয়া একটি মহান মিশন ও গুরু দায়িত্ব। কারণ দাওয়াত মানে মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাকা, তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসা। যিনি দাওয়াত দিবেন তার কুরআন-হাদিস ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা আবশ্যিক। কুরআন ‘বিজ্ঞানময় গ্রন্থ’ (সূরা ইয়াসিন: ২)। বিজ্ঞানময় কুরআনকে অনুধাবন করতে হলে, ব্যাখ্যা করতে হলে বক্তাকে বিশেষ পান্ডিত্য ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। আমাদের ওয়াজ মাহফিলে বক্তাদের অনেকেই পর্যাপ্ত জ্ঞানের অধিকারী নন। ফলে কুরআন-হাদিসের আলোচনার পুঁজি ফুরিয়ে গেলে হয় অন্যদের আক্রমণ করেন কিংবা উদ্ভট কিচ্ছা-কাহিনি বলে সময় ক্ষেপণ করেন। কোনও কোনও বক্তা লোক হাসাতে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে মাহফিলকে হাসি-তামাশা-কৌতুকের রঙ্গ-মঞ্চ বানিয়ে ফেলেন। অথচ আল্লাহ বলেন, “তোমরা কম হাসো, আর বেশি বেশি করে কাঁদো।”(সূরা তাওবা: ৮১) আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে তবে তোমরা খুব কমই হাসতে এবং খুব বেশি কাঁদতে।’(বুখারি, ৬৪৮৫; তিরমিজি, ২৩১৩) রাসূল (সা.) বলেন,  ‘যে ব্যক্তি মানুষ হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে তার জন্য ধ্বংস! তার জন্য ধ্বংস! তার জন্য ধ্বংস!’ (তিরমিযী, ২৩১৫; আবূ দাউদ, ৪৯৯০) কোনও কোনও বক্তা ওয়াজে ডাহা মিথ্যা কথা বলেন। এমনকি কুরআন-হাদিস নিয়েও মিথ্যা বলেন। উদাহরণস্বরুপ, রকেটে করে বক্তার যাতায়াত করা, দাজ্জাল ইয়েমেনের কারাগারে বন্দী আছে, বিশেষ রক্তের গ্রুপের মানুষরা জান্নাতী ইত্যাদি। হাদিসে বর্ণিত আছে, মুনাফিকের একটি স্বভাব মিথ্যা কথা বলা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘মুনাফিকদের নিদর্শন তিনটি: কথা বলার সময় মিথ্যা বলা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা এবং আমানতের খেয়ানত করা।’ (বুখারি, ৩৩; মুসলিম, ৫৯) পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “মিথ্যা বলার কারণে তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।” (সুরা বাকারা: ১০) সবচেয়ে বড় মিথ্যা হলো আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) এর ওপর মিথ্যারোপ করা। এর শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ। কেউ কেউ এ জাতীয় মিথ্যুককে কাফির পর্যন্ত বলেছেন। আলী (রা.) থেকে বর্ণিত : রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা আমার ওপর মিথ্যা বলবে না, যে আমার ওপর মিথ্যা বলবে, সে যেন জাহান্নামে প্রবেশ করে।’ (বুখারি, ১০৬)

কুরআন-হাদিসের পর্যাপ্ত জ্ঞানের পাশাপাশি বক্তার ধৈর্য, সহনশীলতা, কোমলতা, দয়া, পরিবেশ-পরিস্থিতি ও মানুষের আচার-অভ্যাস সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। আল্লাহ তা’আলা রাসূল (সা.)-কে বলেন: “আপনি মানুষকে দাওয়াত দিন আপনার রবের পথে হিকমত ও উত্তম ওয়াজের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে তর্ক করুন উত্তম পদ্ধতিতে।…।” (সূরা নাহল: আয়াত ১২৫) উত্তম তর্ক হচ্ছে- কোমলতা ও দয়ার মাধ্যমে, ইসলামের বুনিয়াদি দিকগুলো তুলে ধরা। অবশ্যই নম্রতার সাথে মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিতে হবে। এমনকি মহান রব মুসা (আ.) ও তাঁর ভ্রাতা হারুন (আ.)-কে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম অত্যাচারী শাসক নিজেকে আল্লাহ বলে দাবিকারী ফিরাউনকে পর্যন্ত নম্রতার সাথে দাওয়াত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, “তোমরা উভয়ে ফিরাউনের নিকট যাও, সে তো সীমালংঘন করেছে। তোমরা তার সাথে নম্র ভাষায় কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে।” (সুরা ত্বহা: আয়াত ৪৩-৪৪) বাস্তবজীবনে কোনও কিছুর ভিত তৈরি হয়ে পূর্ণতা পেতে যেমন সময়, পরিশ্রম ও ধৈর্যের প্রয়োজন তেমনি মানুষের অন্তরগুলো গড়ে তুলতে এবং সেগুলোকে সত্যের পথে নিয়ে আসতে সময়, ধৈর্য ও ত্যাগের প্রয়োজন। আল্লাহর পথে দাওয়াতের কাজে নিয়োজিত নবী-রাসুলদের যুগে যুগে অপমান, ঠাট্টা ও নির্যাতন  সহ্য করতে হয়েছে। অবিশ্বাসীরা নবী-রাসুলদের বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা তাঁদেরকে দৈহিক ও মানসিক কষ্ট দিয়েছে। কোনও কোনও নবীকে তাঁর উম্মতের হাতে জীবনও দিতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও নবী-রাসূলগণ মানব সমাজের হিদায়েতের জন্য ধৈর্যের সাথে, বিনয় ও নম্রতার সাথে কাজ করে গিয়েছেন। রাসূল (স.) ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়ে কাফির, ইহুদি ও মুনাফিকদের নির্যাতনে রক্তাক্ত হয়েও ধৈর্যধারণ করেছেন। তারা রাসূল (সা.) এর সাথে উপহাস করেছে, মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, কষ্ট দিয়েছে, পাথর ছুড়ে মেরেছে। তারা বলেছে- তিনি জাদুকর, পাগল, নিন্দিত ব্যক্তি। তারা তাঁকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বলেছে যে, তিনি কবি বা গণক। পবিত্র কুরআনে এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, “দেখুন ওরা আপনার জন্য কেমন সব উপমা দেয়। ওরা পথভ্রষ্ট হয়েছে। অতএব ওরা পথ পেতে পারে না।”(সুরা বনি ইসরাইল: আয়াত ৪৮)। এত কিছুর পরও রাসূল (সা.) ধৈর্য হারাননি। মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে দাওয়াত সহ সকল ক্ষেত্রে রাসূল (সা.)-কে অনুসরণ করা। তাঁর আদর্শে পথ চলা। আল্লাহ বলেন, “বল, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার অনুসরণ করো। ফলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করবেন।” (সূরা আল ইমরান: আয়াত ৩১) আল্লাহ বলেন “অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ, …।”(সূরা আহযাব: ২১) নম্রতার বদলে কঠোরতা অবলম্বন করলে কী হতো সে বিষয়ে আল্লাহ বলেন, “আল্লাহর দয়ায় আপনি তাদের প্রতি কোমল-হৃদয় হয়েছিলেন; যদি আপনি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতেন তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়তো। কাজেই আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন।” (সূরা আল-ইমরান: ১৫৯) গলার স্বর চড়িয়ে হুংকার দিয়ে, গালাগাল করে যদি কাউকে দাওয়াত দেন তিনি কি আপনার দাওয়াত গ্রহণ করবেন? কিন্তু আমাদের দেশে অনেক বক্তা ওয়াজের নামে যুদ্ধংদেহী শারীরিক ভাষায় হুংকার দিয়ে গলার স্বর সর্বোচ্চ করে উগ্রবাদকে উসকে দিয়ে এমনভাবে দাওয়াতের কথা বলেন যা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) এর দেখানো পথের পরিপন্থী।

অনেক ওয়াজ মাহফিলে ইসলামের সৌন্দর্যের চেয়ে এখন রাজনৈতিক বক্তব্য, সাম্প্রদায়িক উসকানি, নারী ও ভিন্ন ধর্মকে কটাক্ষ, অন্য ধর্মের অনুসারীদের বিরুদ্ধে উসকানি, বাংলা ও হিন্দি গান এবং গালাগালি মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠেছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা একটি মৌলিক স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা রক্ষায় ইসলাম বদ্ধপরিকর। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সবাই ঈমান আনত। তবে কি তুমি মু’মিন হওয়ার জন্য মানুষের উপর জবরদস্তি করবে?” (সূরা ইউনুস: ৯৯) অন্যত্র বলা হয়েছে, “দীনের ব্যাপারে কোনও জবরদস্তি নেই।” (সুরা বাকারা: ২৫৬) ইসলামে অন্য ধর্মের উপাস্যকে গালি দিতেও নিষেধ করে বলা হয়েছে, “আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে তারা ডাকে, তাদেরকে তোমরা গালি দিও না…” (সূরা আনআম: ১০৮) ইসলামে ধর্মীয় স্বাধীনতা কেবল ধর্ম-বিশ্বাস লালন-পালন করার স্বাধীনতা নয় বরং ধর্ম না করার বা ধর্ম বর্জন করার স্বাধীনতাও এই স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, “তুমি বলো, তোমার প্রতিপালক-প্রভুর পক্ষ থেকে পূর্ণ সত্য সমাগত, অতএব যার ইচ্ছা সে ঈমান আনুক আর যার ইচ্ছা সে অস্বীকার করুক”। (সুরা কাহাফ, আয়াত: ২৮) কিছু বক্তা অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে এমনভাবে বিষোদগার-উপহাস করেন যা সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রবাদকে উসকে দেয়। এটি কুরআন ও হাদিস পরিপন্থী।

ওয়াজ মাহফিলে কোনও কোনও বক্তা ভীষণভাবে বিদ্বেষ ও অনৈক্যের ভাইরাস ছড়াচ্ছেন, যা ইসলাম পরিপন্থী। বাংলাদেশের মুসলমানদের ওয়াজের নামে ভয়ংকরভাবে বিভক্ত করা হচ্ছে। মহান রব ইসলামের অনুসারীদের পরিচয় দিয়েছেন মুসলমান হিসাবে আর বক্তারা তাদের ভাগ করছেন বিভিন্ন গ্রুপের নামে। এরুপ দলে দলে বিভক্ত হওয়া কি ইসলাম সমর্থন করে? অবশ্যই না। ঐক্যবদ্ধ থাকা ফরজ, আর যে কোনও ভিত্তিতেই ইসলামে দল তৈরি করে বিভক্ত হওয়া নিষেধ। আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর ঐক্যবদ্ধভাবে এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।…”। (সুরা আল ইমরান: ১০৩)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, “তোমরা ওই মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত হয়ো না, যারা দ্বীনকে টুকরা টুকরা করে ফেলেছে এবং যারা দলে দলে বিভক্ত হয়েছে, প্রত্যেক দল তাদের কাছে যা ছিল তাই নিয়েই খুশি। (সূরা রূম: ৩১-৩২)। এখানে মুশরিকদের সাথে তুলনা করা হয়েছে যারা ধর্মে মতভেদ সৃষ্টি করে এবং নিজের মত নিয়ে উল্লাস করে। বিভক্তি সৃষ্টির ওয়াজ অবশ্যই ইসলাম পরিপন্থী। আল্লাহ রাসূল(সা.)কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “নিশ্চয় যারা স্বীয় ধর্মকে খন্ড-বিখন্ড করেছে এবং অনেক দল হয়ে গেছে, তাদের সাথে আপনার কোনও সম্পর্ক নেই। তাদের ব্যাপার আল্লাহ তা’আয়ালার নিকট সমর্পিত। অতঃপর তিনি (আল্লাহ) বলে দেবেন যা কিছু তারা করে থাকে।” (সূরা-আনআম: ১৫৯) যার সাথে রাসূল (সা.) কোনও সম্পর্ক নেই সে কি মুসলিম? রাসুল (সা.) এর সাথে সম্পর্কহীন ব্যক্তি কি জান্নাতে যেতে পারবেন? রাসূল (সা.) এর সাথে সম্পর্কহীন যে ওয়াজ মানুষের মধ্যে বিভক্তি ছড়ায় তা ইসলাম পরিপন্থী। কিছুদিন যাবত লক্ষ করছি বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে এক বক্তা আরেক বক্তাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করছেন। অধিকংশই অশ্লীলতার মানদণ্ডে লেখায় উল্লেখের অযোগ্য। নমুনা হিসাবে অপেক্ষাকৃত মডারেট কয়েকটা উল্লেখ করছি– ‘তুই মোনাফেক’, ‘তুই কুকুরের বাচ্চা’, ‘তুই একটা লুচ্চা’, ‘তুই কুত্তার জাত’, ‘তুই নাস্তিক’, ‘তোর মুখে জুতা মারি’, ‘তুই বেজন্মার বাচ্চা’, তুই শয়তানের বাচ্চা’, ‘তুই জারজ সন্তান’, তুই নারীখোর, ‘ওহাবী মানে চোর, জেনাখোর’, ‘শালার পো শালা তোগরে কোপাইয়া মাইরা ফালামু’, ‘তুই অপবিত্র কুলাঙ্গার’, ‘জালেমের বাচ্চা’, ‘জাহান্নামের কুকুর’, ‘এই দাজ্জালকে কতল করা ফরজ’ ইত্যাদি। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, মুমিন কটুভাষী হতে পারে না, লা’নতকারী হতে পারে না এবং অশ্লীল ও অশালীন কথা বলতে পারে না। (আল আদাবুল মুফরাদ, ৩১২; জামে তিরমিযী, ১৯৭৭) অশ্লীল ও অশালীন কথা ঈমানের ও মু’মিনের বৈশিষ্টের পরিপন্থী। মুমিনের কর্তব্য, এগুলো থেকে নিজেকে পবিত্র রাখা। (মা’আরিফুল হাদীস, খ. ১, হিস্যা. ১, পৃ. ১০২) আবু বারযা আল আসলামী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘হে ঐ সকল লোক, যারা মুখে ঈমান এনেছে, অথচ ঈমান এখনো তাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি, তোমরা মুসলমানদের গীবত করো না, তাদের অপ্রকাশিত দোষ-ত্রুটির অনুসন্ধান করো না, কেননা যে ব্যক্তি তাদের দোষ অনুসন্ধান করবে, আল্লাহ তার দোষ অনুসন্ধান করবেন। আর আল্লাহ যার দোষ অনুসন্ধান করবেন তাকে তো তিনি তার ঘরে লাঞ্ছিত করবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ, ১৯৭৭৬; আবু দাউদ, ৪৮৮০) এই হাদীস থেকে এটা স্পষ্ট যে, কোনো মুসলমানের গীবত করা, তার দোষ-দুর্বলতা প্রকাশে উৎসুক হওয়া প্রকৃতপক্ষে এমন এক মুনাফিকী কর্ম, যা শুধু ঐ লোকদের থেকেই প্রকাশিত হতে পারে যারা মুখে তো মুসলমান কিন্তু ঈমান এখনো তাদের অন্তরে স্থান করে নিতে পারেনি। (মা’আরিফুল হাদীস, খ. ১, হিস্যা. ২, পৃ. ১৬৩) হারেছা বিন ওহাব (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘অশ্লীলভাষী ও উগ্র মেজাজি লোক জান্নাতে যাবে না।’ (আবু দাউদ, ৪১৬৮) তর্ক বা ঝগড়ায় অশ্লীল বাক্য উচ্চারণকে ইসলাম খাঁটি মুনাফিকের আলামত হিসেবে গণ্য করে। আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন: ‘চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকে সে খাঁটি মুনাফিক।’ এর একটি হলো ‘বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীল গালি দেওয়া।’ (বুখারি, মুসলিম, নাসাঈ, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ)। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্থানে অবস্থান করবে।” (সুরা নিসা: ১৪৫)

কোনও কোনও বক্তা মাহফিলে রাজনীতির বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয় নিয়ে রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কথা বলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কিংবা স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিকৃত করে ওয়াজ করেন। উদাহরণস্বরুপ, একজন বক্তা বলেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আল্লাহর নি’য়ামত। কোনও দল, কোনও গোষ্ঠী বা কোনও দেশের সহযোগিতায় এ দেশ স্বাধীন হয়নি। এটি ডাহা মিথ্যা ও ইসলাম পরিপন্থী। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে ‘পোশাক আল্লাহর নি’য়ামত’ (সুরা আরাফ: ২৬) প্রশ্ন হলো, পোশাকের জন্য যদি মানুষ সুতা তৈরি না করতো, সুতা থেকে কাপড় তৈরি না করা হতো, কাপড় কেটে, সেলাই করে যদি শরীরের উপযোগী পোশাক তৈরি করা না হতো, তৈরি করা পোশাক যদি গায়ে চাপানো না হতো তাহলে কী আল্লাহর নেয়ামত পোশাক নিজে থেকেই গায়ে পরিধান হয়ে যেতো? নেয়ামত ভোগের জন্য অবশ্যই মানুষকে উদ্যোগী হতে হবে। তেমনি আল্লাহর নেয়ামত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কোনও ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠী বা দেশের সহযোগিতা ও প্রচেষ্টা আবশ্যিক। আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ অবশ্যই কোনও জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজের অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।” (সুরা রাদ: ১১)

ওয়াজ মাহফিল কোন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান কিংবা রাজনৈতিক সভা নয়; এটি কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সঠিক পথ প্রদর্শনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তাই হাস্যরস কিংবা বিনোদন নয়, এর ভাবগাম্ভীর্যতা রক্ষা অপরিহার্য। বিদ্বেষ ছড়ানো, অন্যদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা কিংবা উগ্রবাদ উসকে দেওয়া নয়, ওয়াজ মাহফিল হোক পরিপূর্ণ ভাবে ধর্মীয় রীতিনীতি ও ভাবধারায় ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম। বাংলাদেশের সংবিধানের ২(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। ইসলাম ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা করা এবং সঠিক প্রচার নিশ্চিত করা সরকারের অবশ্য পালনীয় সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। ওয়াজ রাজনৈতিক মিশন নয়, এটি দাওয়াতী মিশন। ওয়াজে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য শুনে মানুষ যাতে বিভ্রান্ত ও বিদ্বেষে বিষাক্ত না হয়, উগ্রবাদ ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজে লিপ্ত না হয় এজন্য আলেম-ওলামাদের সাথে আলোচনা করে ইসলাম পরিপন্থী ওয়াজ নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। একটি পরিসংখ্যান বলছে প্রতিবছর বাংলাদেশে ৬ লক্ষাধিক ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, ধর্ষণ, বলাৎকার, পর্নোছবি দেখা, কিশোর গ্যাংস্টার ইত্যাদি বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক একটি জরিপ বলছে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। এ সবই সাক্ষ্য দিচ্ছে মানুষের হিদায়াত ও সংশোধনের লক্ষে যে ওয়াজ মাহফিল সমাজে তার প্রভাব খুব আশাব্যাঞ্জক নয়। ওয়াজ মাহফিলের সীমাবদ্ধতা নিয়ে তাই আলেম সমাজকেও নতুন করে ভাবতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অবশেষে মুক্তির বার্তা
অবশেষে মুক্তির বার্তা
এমপিপুত্র প্রার্থী হওয়ায় ‘আগুন জ্বলছে’ সেলিম প্রধানের গায়ে
এমপিপুত্র প্রার্থী হওয়ায় ‘আগুন জ্বলছে’ সেলিম প্রধানের গায়ে
ব্রাজিলিয়ানের গোলে আবাহনীতে স্বস্তি
ব্রাজিলিয়ানের গোলে আবাহনীতে স্বস্তি
স্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভস্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ