X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যতটুকু জানি ততটুকুই কি মানি?

রেজানুর রহমান
১১ মার্চ ২০২১, ১৬:৩৫আপডেট : ১১ মার্চ ২০২১, ১৬:৩৫

রেজানুর রহমান
আমরা যারা বেঁচে আছি তারা অনেক ভাগ্যবান। তরুণ প্রজন্মের কথা বলছি না। আমাদের যাদের একটু বয়স হয়েছে তাদের কথা বলছি। একটি স্বাধীন দেশের সুবর্ণজয়ন্তী অর্থাৎ ৫০ বছর দেখতে পাওয়া অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। পাশাপাশি একই বছরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পালনের গৌরবকে ছুঁতে পারছি এ যেন জীবনের এক পরম পাওয়া। এমন আনন্দ ও গৌরবের অংশীদার সবাই হতে পারে না। এজন্য ‘ভাগ্য’ শব্দটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা এই ভাগ্যবানেরা দেশের জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কে কতটুকু ভূমিকা পালন করছি? অনেকেই হয়তো পালটা প্রশ্ন ছুঁড়বেন, ‘আমি সাধারণ মানুষ, আমার কি-ই বা করার আছে? যা করার রাষ্ট্র করবে। বিনীতভাবে বলতে চাই, এটি একটি ভুল ধারণা। নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রের অনেক কিছুই করার আছে। পাশাপাশি একজন নাগরিক হিসেবে সবারই কিছু না কিছু দায়িত্ব আছে অথবা দায়িত্ব থাকে। সৎ ও নিষ্ঠাবান হওয়া, দুর্নীতি না করা, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা, জাতীয় পর্যায়ের নেতানেত্রীর প্রতি সম্মান দেখানো রাষ্ট্রের বিশেষ বিশেষ দিবস পালনে আন্তরিক থাকা যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব তেমনই ব্যক্তিরও দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে। আমরা এ ব্যাপারে কে কতটুকু দায়িত্ব পালন করছি?

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের কথাই ধরা যাক। আমরা আজকে এই যে স্বাধীন দেশে গৌরব ও অহংকার নিয়ে বসবাস করছি, তার উৎসমুখই ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘জাতির পিতার এই ভাষণ প্রকৃত অর্থেই স্বাধীনতার ঘোষণা’। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘ এবার ৬টি ভাষায় বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ পুস্তক আকারে প্রকাশ করেছে। এবার একটি ছোট্ট প্রশ্ন করি। বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণ কেন শুধু ৭ মার্চের দিনে আলোচিত হয়? কেন বছরের অন্যান্য দিনে আলোচনায় থাকে না? যে ভাষণ একটি দেশের স্বাধীনতার মূল প্রেরণা হয়ে দেখা দিয়েছিল সেটি এতদিনে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হতে পারতো না? যারা স্কুলে-কলেজে পড়ান শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দও কি এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে পারতেন না?

ক’জন শিক্ষক অথবা শিক্ষিকা বলতে পারবেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের ব্যাপ্তি কত ছিল? অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু সেদিন কতক্ষণ ভাষণ দিয়েছেন? তাঁর ভাষণে বাক্য সংখ্যা কত ছিল? নির্দেশ রয়েছে, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক আলাদা কর্নার থাকতে হবে। অদ্যাবধি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই নির্দেশ পালন করা হয়নি। আবার কোথাও কোথাও নামমাত্র বঙ্গবন্ধু কর্নার চালু হয়েছে। কেন এই বঙ্গবন্ধু কর্নার খোদ শিক্ষক-শিক্ষিকা অনেকেই ভালোভাবে জানেন না। আবার জানলেও প্রকৃত অর্থে শ্রদ্ধা জানানোর কাজটি করেন না। কিছু দিন আগে মানিকগঞ্জের অদূরে একটি নামকরা স্কুলে গিয়েছিলাম। প্রধান শিক্ষকের কক্ষে দুটি আলমারির সামনে লিখে রাখা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’। দেখে মনে হলো অনেক দিন লাইব্রেরি দুটির তালা খোলা হয়নি। এই যদি হয় বঙ্গবন্ধু কর্নারের অবস্থা তাহলে কাজের কাজ তো কিছুই হবে না।

বইয়ের লাইব্রেরির কথা যখন উঠলোই তখন একটু বলি। এই করোনাকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের প্রকাশনা জগৎ। একসময় দৈনিক পত্রিকা পড়াও তো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কী এক ধুয়া উঠলো যে পত্রিকা পড়লে করোনা হয়। পরে এর সপক্ষে কোনও প্রমাণ মেলেনি। ততদিনে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। বর্তমানে পত্রিকা পড়ার আগ্রহ একটু বাড়লেও বই পড়ার আগ্রহ বাড়েনি। অথচ একথা সত্য, একটি ভালো বই একজন ভালো বন্ধুর ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বই পড়ার অভ্যাস যেন আমরা হারিয়ে ফেলছি। অনেক পরিবারে দেখি ড্রয়িং অথবা পড়ার ঘরে বিশাল বিশাল আলমারিতে ঠাসা ঠাসা বই। আলমারিতে ঝোলে বিশাল সাইজের তালা। অর্থাৎ কবে কোন দিন এই তালা খোলা হয়েছিল তা সহজেই কেউ বলতে পারবে না। বই ঘরের শোভাবর্ধনের জন্য নয়। বই পড়ার জন্য। আলমারি বন্ধ থাকলে বইয়ের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। এক অর্থে বইয়েরও জীবন আছে। পাঠক যখন বই পড়ে তখন বইখানি নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পায়। কাজেই বই আলমারিতে বন্ধ করে রাখবেন না। বই পড়ুন। অবশ্যই জীবনের প্রকৃত আনন্দ খুঁজে পাবেন!

দেশে করোনার টিকা আসায় ধারণা করা হয়েছিল অচিরেই একটা স্বস্তির জায়গা তৈরি হবে। করোনার সংক্রমণ কমতে থাকায় স্বস্তির জায়গা ক্রমান্বয়ে বড় হচ্ছিল। কিন্তু দেশে করোনার সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করেছে। সেই তুলনায় সতর্কতায় জায়গাটা পরিষ্কার নয়। আমরা হয়তো একে অন্যকে করোনা সতর্কতায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে যারা বলছি তারাই অনেকে মানছি না। এটা মোটেই শুভ লক্ষণ নয়।

কয়েকদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও চিত্র দেখে যারপরনাই অবাক হলাম। ভিডিওটি পুরনো। কিন্তু এখনও যেন সমসাময়িক। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের কয়েকজন ছাত্রছাত্রীকে শহীদ দিবস, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। শতকরা ৯০ জন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস এটা অনেকেই জানে। কিন্তু বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের ব্যাপারে প্রায় সকলেই ভুল উত্তর দিয়েছে। ১৬ ডিসেম্বরকে বলেছে স্বাধীনতা দিবস। আবার ২৬ মার্চকে বলেছে বিজয় দিবস। ভুল উত্তর দিয়েও কেউ কেউ হাসছিল। এতটুকু উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নেই চেহারায়। এটাও শুভ লক্ষণ নয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বছরে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা ভাতা পান। মাসিক সম্মানী ও বিভিন্ন ভাতা পাওয়া ১ লাখ ৯৩ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম গত বছরের অক্টোবরে একটি সফটওয়্যারে যুক্ত করার পরপরই হঠাৎ সংখ্যাটি ২১ হাজার কমে যায়। শেষ খবরে জানা গেছে, তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ১৩ হাজার ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ তাদের নামে বছরের পর বছর মুক্তিযোদ্ধা ভাতার অর্থ ছাড় করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের অনেকে বলেছেন, এই ১৩ হাজার ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাদের মন্তব্য, এত বছর ওই ব্যক্তিরা যে সুবিধা নিয়েছেন তাতে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা!

মশা মারতে কামান দাগানোর উপমা সম্পর্কে সকলেই অবগত। মশকমুক্ত ঢাকা শহর চাই এই দাবি ঢাকা শহরের সকল মানুষের। যারা মেয়র পদে প্রার্থী হন তারাও জোরেশোরে মশকমুক্ত ঢাকা শহর গড়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের মেয়র ক্ষমতা গ্রহণের পর তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ধারণা করা হয়েছিল এবার ঢাকা শহর অবশ্যই মশকমুক্ত হবে। কিন্তু ঘটেছে তার উল্টোটা! মশার প্রজনন ক্ষেত্রে পানিতে ওষুধ ডুবিয়ে রেখেছিল ডিএনসিসি। উদ্দেশ্য ছিল লার্ভা নষ্ট করে মশার বংশ বৃদ্ধি ঠেকানো। কিন্তু ওই ওষুধে কাজ হয়নি। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার মশার বংশ বৃদ্ধি হয়েছে বেশি। শুধু দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের চার বছরে মশার পেছনে ব্যয় হয়েছে ৭৬ কোটি টাকা। অথচ কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মশার দাপট চলছে সমান তালে।

আর মাত্র এক মাস পর শুরু হবে পবিত্র রমজান মাস। এরপরই পবিত্র ঈদ। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে উৎসব-পার্বণ উপলক্ষে দ্রব্যমূল্যের দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের দেশে ঘটে তার উল্টোটা। ঈদ-সহ যেকোনও উৎসব-পার্বণ এলে ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। বাসের ভাড়া বাড়ে। ব্যাপারটা যেন স্বাভাবিক। উৎসব-পার্বণে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়বেই। কিন্তু কেন বাড়বে এর কোনও উত্তর নেই।

একথা সকলেই মানবেন, দেশ উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সগৌরবে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু দিনের মধ্যেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হবে। রাজধানীতে মেট্রোরেলের কাজ চলছে জোরেশোরে। জাপান থেকে মেট্রোরেলের বগি বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে পানিপথে রওনা দিয়েছে। একটা ব্যাপক পজিটিভ পরিবর্তন হবে দেশের। সেই তুলনায় আমরা কি দেশের সাধারণ মানুষকে প্রস্তুত করতে পারছি? পদ্মা সেতু চালু হলেই ঢাকা শহরে আগের তুলনায় শতকরা ২৫/৩০ ভাগ মানুষের আনাগোনা বাড়বে। ঢাকা শহর কি সেজন্য প্রস্তুত? এজন্য আছে ভবিষ্যৎ কোনও পরিকল্পনা? মেট্রোরেল চালু হলে টিকিট পাঞ্চ করে রেলের বগিতে উঠতে হবে। এ বিষয়েও এখন থেকেই একটা ক্যাম্পেইন প্রয়োজন।

অনেকে হয়তো বলবেন, আরে ভাই আমরা তো এসব জানি! হ্যাঁ, আপনার জানার ব্যাপারটা ঠিক আছে। কিন্তু যা জানি তার সবটাই মানি কি?

লেখাটি শেষ করার আগে ছোট্ট একটি ঘটনা তুলে ধরতে চাই। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ পালনের দিনে ঠাকুরগাঁওয়ের একটি এলাকায় একটি থানার উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা সভা শেষে উন্মাতাল অশ্লীল নৃত্যগীতের আয়োজন করা হয়েছিল। ৭ মার্চ পালনের অনুষ্ঠান কেমন হওয়া দরকার আমরা বোধকরি সবাই জানি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে মানি কি? ৭ মার্চের আলোচনা অনুষ্ঠানে হিন্দি গান বাজবে কেন? অশ্লীল নৃত্যই বা হবে কেন? এর জবাব কী?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক: আনন্দ আলো

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে আন্তরিক অভ্যর্থনা
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে আন্তরিক অভ্যর্থনা
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ