X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়মের আওতায় আনা জরুরি

লীনা পারভীন
১৪ মার্চ ২০২১, ১৫:২২আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২১, ১৫:২২

লীনা পারভীন
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আজকাল অনেক কিছু নিয়েই লেখালেখি চলে। কিছু ঘটনার প্রতিবাদ পৌঁছে যায় নীতিনির্ধারকদের কাছেও। কিন্তু কোনও এক কারণে মাদ্রাসায় চলতে থাকা শিশু নির্যাতন-নিপীড়ন, ধর্ষণ ও হত্যার বিষয়টি ঠিক তেমন আলোচনায় আসছে না। এর সঠিক কারণ কী জানি না। হয় আমরা বিষয়টি উপেক্ষা করে যাচ্ছি, আর না হয় জেনে-বুঝে চুপ থাকছি। অথচ চুপ থাকার মতো পরিস্থিতি কি আমাদের আছে?

আমরা সবাই জানি যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অনেক ধারায় বিভক্ত। এরমধ্যে অন্যতম একটি ধারা হচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। ধর্মীয় শিক্ষাভিত্তিক কারিক্যুলামে পরিচালিত এই ধারাটি সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই স্বচ্ছ ধারণা নেই। কেন নেই? কারণ, এই ধারাটি বরাবরই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। অথচ দেশের একটি বৃহৎ অংশের সন্তানেরা এই শিক্ষাব্যবস্থার অংশ। সারাদেশে এই মুহূর্তে কতগুলো মাদ্রাসা রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান দেওয়া মুশকিল। কারণ, নিবন্ধিত মাদ্রাসার বাইরেও প্রচুর মাদ্রাসা রয়েছে, যেগুলো স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠেছে এবং পরিচালিত হচ্ছে।

এসব মাদ্রাসায় কী পরিমাণ শিক্ষার্থী রয়েছে সেটিও রয়ে যায় হিসাবের বাইরে। কেবল নিবন্ধিত মাদ্রাসাগুলোর হিসাবই আমাদের সামনে আসে, তাও আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে। মাদ্রাসার সংখ্যা কিন্তু বেড়েই চলেছে। আমি এ বিষয়ের কোনও বিশেষজ্ঞ নই। প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে আমার লেখার উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য আর কিছু না। দুদিন পরপরই আমাদের সামনে আলোচনায় চলে আসে মাদ্রাসায় পড়তে যাওয়া শিশুদের ওপর চলতে থাকা পাশবিক অত্যাচার-নিপীড়নের চিত্র। ধর্ষণের ঘটনাতো অনেক দিন ধরেই আলোচনার বিষয়। একদম সম্প্রতি আরেকটি ঘটনা আমাদের নতুন করে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। হাটহাজারী সদরের মারকাযুল ইসলামিক অ্যাকাডেমির একটি ছোট শিশুকে যেভাবে প্রহার করা হয়েছে সেটা দেখে যেকোনও বিবেকবান মানুষকেই ভাবতে বাধ্য করবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই নৃশংস ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে এখনও।

আমি একজন মা, একজন নাগরিক, একজন বিবেকবান মানুষ। মাদ্রাসাগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষের সন্তানেরাই পড়তে যায়। কেন যায়? এর কারণ নিয়ে কোনও গবেষণার ফলাফল আমার সামনে নেই, কিন্তু ধারণা থেকে দুটি কারণ বলা যায়। একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক, আরেকটি ধর্মীয়। নিম্ন আয়ের মানুষগুলো তাদের সন্তানদের উচ্চহারের ফি দিয়ে পড়াতে সমর্থ হয় না। মাদ্রাসাগুলোতে এই জায়গাটি তুলনামূলক কম টাকায় থাকা-খাওয়ার একটি ব্যবস্থা করা যায়। আবার সন্তানদের ধর্মের পথে দিয়ে পরকালের জন্য যদি সওয়াব পাওয়া যায় সেটাও একটা বড় উদ্দেশ্য। এটা নিয়ে আমার কোনও আপত্তি নেই। এটি পিতামাতা কিংবা অভিভাবকদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।

আধুনিক যুগে ছাত্রদের গায়ে হাত দেওয়া একটি অপরাধের বিষয় হিসাবে পরিগণিত। আমাদের বাংলা বা অন্যান্য ধারার স্কুলগুলোতেও একই নিয়ম প্রযোজ্য করা হয়েছে। তাহলে মাদ্রাসা কি এর বাইরে থাকবে? মাদ্রাসা শিক্ষা কি দেশের আইনের বাইরে? সেখানে কী পড়ানো হচ্ছে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী শিখছে, কেমন করে শিখছে, সেখানে যারা শিক্ষক হিসাবে কাজ করছেন তাদের যোগ্যতা কী? নিয়োগের প্রক্রিয়া কী? এক বিষয় নিয়ে কি সরকার বা সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার তদারকির সুযোগ আছে?

দেশে কিছু কিছু ইংরেজি মাধ্যমের মাদ্রাসাও তৈরি হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় শিক্ষিত উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের সন্তানরাও পড়তে যাচ্ছে। মাদ্রাসা বলতে আমরা সাধারণত ধর্মীয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠানকেই বুঝে থাকি। এটি একটি আদি ধারা আমাদের এই অঞ্চলে। আগে কেবল ধর্মীয় বুনিয়াদি শিক্ষার জন্যই মাদ্রাসায় পাঠাতো বাচ্চাদের। পরবর্তীতে সেখানে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এসেছে বাণিজ্যিক বিষয়ও। এখন সেখানে একদম ফ্রিতে কত পার্সেন্ট শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতে পারে সেটিও জানা দরকার। মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে একটি তুলনামূলক গবেষণা হওয়া এখন জরুরি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে না পাঠিয়ে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। শহর অঞ্চলেও অনেক সামর্থ্যবান পিতামাতা তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় পাঠায় পড়াশোনা করতে। এই মনস্তত্ত্বটিকে উপেক্ষা করবো কেমন করে? এই পরিবর্তনের বিষয়গুলো পুরোটাই সাংস্কৃতিক এবং পারিবারিক। এই জায়গাটি প্রভাবিত করছে আমাদের জাতীয় জীবনকেও।

তাই মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করার আর সুযোগ নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এ বিষয়টিকে উপলব্ধি করেছেন এবং তিনি যথাযথ ব্যবস্থার কথাও বলেছেন নানা সময়ে। আমরা সেটি প্রতিফলন দেখতে চাই একটি সামগ্রিক পরিকল্পনার মাধ্যমে। সেই পরিকল্পনাতে যুক্ত থাকবে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়ম-কানুন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য নির্দেশিকা, শিক্ষার্থীদের কেমন করে কোন কোন বিষয়ে পাঠদান করা হবে সেটির বিষয়ে। শিশুরা প্রহার, নির্যাতন-নিপীড়ন ও ধর্ষণের শিকার হলে এর বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকতে হবে, শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য প্রণয়ন করতে হবে একটি সুচিন্তিত নীতিমালা অথবা এটিকেও আমাদের শিক্ষানীতির আওতাধীন নিয়ে আসা যেতে পারে। সেটি যদি নাও করা যায় অন্তত একটি নীতিমালা তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। একটি বিশাল খাতকে এভাবে নজরের বাইরে রেখে দেশের ‘মেরুদণ্ড’ মেরামত করা যাবে না। এক কোটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পরিকল্পনার বাইরে রাখাটা অত্যন্ত বিপজ্জনক।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই দেশকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সোনার বাংলা গড়ার পথে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে অত্যন্ত ভেবেচিন্তে ও পরিকল্পনার মাধ্যমে। মাদ্রাসা শিক্ষাকেও তাই নিয়ে আসতে হবে সেই ‘চেতনার’ আলোতে।

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ