X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার বিতর্ক কি চলতেই থাকবে?

আমীন আল রশীদ
১৯ মার্চ ২০২১, ১৮:৫৮আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২১, ১৯:৪৭

আমীন আল রশীদ ১৪ মার্চ বাংলা ট্রিবিউনের একটি সংবাদ শিরোনাম: ‘চার বছর ধরে জামুকা-মন্ত্রণালয়ে ছোটাছুটি করছেন মুজিব বাহিনীর হেফজুল।’ খবরে বলা হয়, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু করা যাচাই-বাছাইয়ে বাদ দেওয়া হয় মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা এএফএম হেফজুল বারীকে। কিন্তু আপিলের পর চার বছর ধরে ছোটাছুটি করছেন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে। বারবার সংশ্লিষ্টদের কাছে ধরনা দিয়েও কোনও প্রতিকার পাচ্ছেন না তিনি।

এর কয়েকদিন আগে গণমাধ্যমে প্রকাশিত আরেকটি সংবাদ এরকম: মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ায় নওগাঁয় সাহার আলী নামে ৮০ বছরের এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) নতুন তালিকা প্রকাশ করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। ওইদিনই সাহার আলী জানতে পারেন, তালিকা থেকে তার নাম বাদ পড়েছে। এ খবর শুনে স্ট্রোক করেন এবং মৃত্যুবরণ করেন। সাহার আলীর ছেলে দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, তার বাবা একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু জামুকার যাচাই-বাছাই প্রতিবেদনে বাতিল তালিকায় তার নাম থাকার কথা শুনে তিনি স্ট্রোক করে মারা যান।

২০২১ সালটি বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে একটি মাইলফলক বা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী এবং একইসাথে স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। অর্থাৎ সব মিলিয়ে একটি মাহেন্দ্রক্ষণ। অথচ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসেও কে মুক্তিযোদ্ধা কে রাজাকার কিংবা স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি— তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। চলছে শুধু নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাড়ছেও।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন, আগামী ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাইকৃত পূর্ণাঙ্গ তালিকা এবং বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে,অর্থাৎ ১৬ই ডিসেম্বর রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। প্রশ্ন হলো, ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশের পরে সারা দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, পুরো বিষয়টি যেভাবে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল, সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে সরকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা এবং সরকার এ বিষয়ে কতটা সিরিয়াস এবং এই তালিকায় কাদের নাম থাকবে?

অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে ঘৃণিত শব্দ হচ্ছে ‘রাজাকার’। অথচ এই শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহারও আমরা দেখছি। একাত্তর সালে যিনি ছিলেন শিশু, তাকেও শুধু রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে ‘রাজাকার’ বলে গালি দেওয়ার প্রবণতা আছে। অথচ ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পরামর্শ দিয়েছিলেন, অপরাধ প্রমাণিত হবার আগে কাউকে যেন ‘রাজাকার’ বলা না হয়। নওগাঁ এবং জয়পুরহাট জেলায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত তিন জনের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তদন্ত দল এবং প্রসিকিউটরদের পক্ষ থেকে আবেদন দেওয়া হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক প্যানেল এই পরামর্শ দেন। তদন্ত দলের চিঠিতে অভিযুক্তদের নামের আগে ‘রাজাকার’ শব্দটি উল্লেখ থাকায় অভিযুক্তদের আইনজীবী এ নিয়ে আপত্তি তোলেন (বিবিসি, ৩০ এপ্রিল ২০১৭)।

প্রশ্ন হলো, জাতীয় জীবনে সবচেয়ে ঘৃণিত এই শব্দটি আইনগতভাবে যাদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে, ১৯৭১ সালে সেই লোকগুলোর অপরাধের বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের কাজটি কতটা নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্তভাবে হচ্ছে? কারণ, এরকম একটি সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ তালিকা করতে গিয়ে পুরো প্রক্রিয়ার ভেতরে কিছু লোকও যদি ব্যক্তিগত, পারিবারিক, রাজনৈতিক বা আর্থিকভাবে প্রভাবিত হয়ে যান, তাহলে নিরপরাধ অনেক লোকের নামও তালিকায় ঢুকে যেতে পারে। আর পুরো তালিকায় একজন নিরপরাধ লোকের নামও যদি থাকে, তাহলেও পুরো তালিকাটি আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। মানুষের অবিশ্বাস তৈরি হবে। সেই সুযোগে প্রকৃত রাজাকাররাও এই তালিকার সমালোচনা করার সুযোগ পাবে।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশের পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম হয় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ দেখা দেয়। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করা হলেও তা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ওঠায় শেষ পর্যন্ত সরকার সেটি স্থগিত করে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও ওই তালিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকেও তালিকাটি সরিয়ে ফেলা হয়।

তার মানে এত বড় একটি কাজের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন, তারা কাজটি সঠিকভাবে করেননি অথবা এই পুরো প্রক্রিয়ার ভেতরে এমন কেউ ছিলেন, যিনি বা যারা চেয়েছেন তালিকাটি প্রশ্নবিদ্ধ হোক। কারণ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, শহীদ—ইত্যাদি শব্দ বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ হলে খুশি হন—এমন মানুষের সংখ্যা কম নয় এবং তাদের অনেকে যে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, তাও অস্বীকার করা যাবে না। সুতরাং, আগামী ১৬ ডিসেম্বর যে তালিকা প্রকাশিত হবে বলে সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, সেই কাজটি কতটা নিরপেক্ষভাবে এবং সিরিয়াসলি হচ্ছে—সেটি বিরাট প্রশ্ন।

কারা রাজাকার, ১৯৭১ সালে কোন কোন ভূমিকার জন্য তাদের রাজাকার বলা হবে এবং কোন স্তরের অপরাধী হলে তার নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অপরাধের বিষয়ে প্রত্যক্ষ সাক্ষী ও তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাবে কিনা, না পাওয়া গেলে শুধু মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা যে তালিকা দেবেন, সেটিই সরকার গ্রহণ করবে নাকি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির সম্পর্কে গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা নিরপেক্ষ তদন্ত করবেন—সেটিও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

এসব প্রশ্নের উত্তর থাকতে হবে রাজাকারের তালিকা প্রকাশে সরকার আইনের যে খসড়া করেছে, সেটি চূড়ান্ত হলে এবং শুধু তা-ই নয়, আইনের আলোকে বিধিমালায়ও সব বিষয় পরিষ্কার থাকতে হবে। না হলে স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা নিয়ে নতুন ধরনের সংকট তৈরি হবে। সেই সংকট যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি সামাজিক। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে এসে দেশের আপামর জনসাধারণ তো বটেই, দলমত নির্বিশেষে কারোরই এরকম সামাজিক সংকট নিশ্চয়ই কাম্য নয়।

ধরা যাক, ১৯৭১ সালে পরিস্থিতির চাপে কেউ রাজাকার বা শান্তি কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। কেউ হয়তো তার পরিবার ও এলাকাবাসীকে বাঁচানোর জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সখ্য রেখেছেন, যাতে এক ধরনের ক্যামোফ্লাজ তৈরি করা যায়—তাকেও কি রাজাকার বলা হবে? নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘১৯৭১’ নাটকে এরকম একটি চরিত্রের নাম রফিক—যার সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর সখ্য ছিল এবং তিনি মূলত প্রতিটি অপারেশনের খবর জেনে আগেভাগে সেই এলাকা থেকে মানুষদের, বিশেষ করে হিন্দু ও নারীদের সরিয়ে দিতেন। সুতরাং, খুন-ধর্ষণের মতো অপরাধের সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কারও নাম রাজাকারের তালিকায় ঢুকিয়ে দেওয়া হলে সেটি অনেক বড় অবিচার হবে। কারণ, ওই ব্যক্তি জীবিত থাকুন বা না থাকুন, এই তালিকায় নাম উঠে যাওয়ার ফলে তারা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ভীষণ চাপে পড়বেন।

অভিযোগ আছে, ২০১০-১২ সালে জেলায় জেলায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ স্থানীয়ভাবে রাজাকারদের একটি তালিকা করেছিল। যেখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে অনেক লোকের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক জায়গায় তালিকায় নাম ঢুকিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের বাণিজ্য হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে।

সুতরাং, আগামী ১৬ ডিসেম্বর যে তালিকা প্রকাশিত হবে বলে সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, সেই তালিকায় যদি সত্যি সত্যিই এমন কারো নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যিনি আসলে রাজাকার ছিলেন না, অর্থাৎ তিনি যে রাজাকার ছিলেন বা তিনি যে মানুষের ক্ষতি করেছেন—এরকম তথ্যপ্রমাণ না থাকে, তাহলে তিনি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে যে অসম্মানের শিকার হবেন, সেই ক্ষতি তিনি বা তার পরিবার কী করে পোষাবেন? ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে ওই তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে—এমন দাবি করে তিনি কি আদালতে যাবেন বা আদালতে যাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা কি তার থাকবে? তার মানে, মুক্তিযোদ্ধার সঠিক তালিকা করা যতটা না ঝুঁকির তার চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ রাজাকারের তালিকা।

উল্লেখ্য, রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের তালিকা প্রকাশের বিধান যুক্ত করে ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন’ নামে একটি নতুন আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সুতরাং এই আইনের আলোকে রাজাকারের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট করা এবং কোন কোন অপরাধের সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ থাকলে তাদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে; কারা তালিকা করবেন এবং কোন প্রক্রিয়ায় তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই হবে—তার সবকিছু আইনে অন্তর্ভুক্ত করা এবং পুরো কাজটি সুচারুরূপে সম্পাদনের জন্য আইনটি পাসের দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিধিমালা করে ফেলতে হবে। স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির জনকের জন্মশতবর্ষে এসে যদি মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটানো যায়—সেটি পুরো জাতির জন্য একটি বড় কাজ হবে।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
স্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভস্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
বৈশাখী মেলায় গানের আয়োজন, কমিটির সঙ্গে দর্শকদের সংঘর্ষে নিহত ১
বৈশাখী মেলায় গানের আয়োজন, কমিটির সঙ্গে দর্শকদের সংঘর্ষে নিহত ১
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ