X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

হুজুরের শিক্ষা বলো না মিথ্যা...

রেজানুর রহমান
২৩ এপ্রিল ২০২১, ২২:১৫আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২১, ২২:১৫
রেজানুর রহমান ছোটবেলায় রাত জেগে অনেক ওয়াজ শুনেছি। হুজুরদের ওয়াজ। কী মায়াময় কণ্ঠ। ধর্মীয় বিধান তুলে ধরে কী চমৎকারভাবেই না সবকিছু বুঝিয়ে বলতেন। বয়স কম ছিল। সম্মানিত হুজুরদের সব কথাই যে বুঝতাম তা কিন্তু নয়। কিন্তু তাদের কথার মধ্যে হুমকি ধমকি থাকতো না বলে সব কথাই মনের ভেতর গেঁথে যেত। মনে আছে, ছোটবেলায় একবার গ্রামে আমার চাচার সঙ্গে সারা রাত নামকরা এক হুজুরের ওয়াজ শুনেছিলাম। তিনি শিশু-কিশোরদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “তোমরা বাবা-মাকে কখনও কষ্ট দিবে না। সব সময় বড়দের শ্রদ্ধা করবে। বাবা-মা ও শিক্ষকদের আদেশ-নির্দেশ মেনে চলবে”। সত্যি কথা বলতে কী, সম্মানিত সেই হুজুরের কথা ছোটবেলাতেই আমাকে খুব আকর্ষণ করেছিল। সেই থেকে সম্মানিত হুজুরদের প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা। কিন্তু বড়বেলায় এসে শ্রদ্ধার জায়গাটা যেন একটু একটু করে নড়বড়ে হতে শুরু করলো। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে ওয়াজের নামে সম্মানিত হুজুরদের কারও কারও শারীরিক অঙ্গভক্তি ও জটিল, কঠোর, ভীতিকর শব্দ প্রয়োগ কোনোভাবেই সমর্থন করতে পারছি না। সম্মানিত হুজুরদের কেউ কেউ ওয়াজ করার সময় এতটাই যুদ্ধংদেহি হয়ে ওঠেন যে মনে হবে প্রতিপক্ষকে সামনে পেলে সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করে ফেলবেন। এই প্রবণতার ভবিষ্যৎ কী? যে কথা শান্ত, কোমল কণ্ঠে বলা যায় সেই কথায় কেন ভয়ভীতি ছড়ানো হচ্ছে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্কিত এই কথাগুলোই ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফলে ধর্মীয় নেতা ও শিক্ষাগুরুদের সম্পর্কে জনমনে একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হচ্ছে।

আমাদের পবিত্র ধর্ম ইসলামে মিথ্যাচারের কোনও সুযোগ নেই। একই সঙ্গে নারীকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়ার কথাও বলা আছে আমাদের পবিত্র ধর্মে! এই বিষয়গুলোতে ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা অনেক বেশি। কারণ, ধর্মীয় নেতাদের মুখের কথা, তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, আচার-আচরণ, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বহুলাংশে প্রভাব ফেলে সাধারণ মানুষের ওপর। হতে চাই তার মতো! অর্থাৎ জনপ্রিয় ধর্মীয় নেতা অথবা শিক্ষাগুরুর আদর্শকে ভালোবেসে অনেকেই তাঁর বা তাঁদের মতো হতে চায়। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতি কী বলে?

একজন বহুল বিতর্কিত ধর্মীয় নেতা শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন। প্রকাশ্যে তিনি মিথ্যাচার করেছেন। ধর্মীয় বিধান অমান্য করে একাধিক নারীর সঙ্গে তিনি শারীরিক সম্পর্ক গড়েছেন। সরকার পতনের হুমকি দিয়েছেন। এ কথা জানার পরও রাজপথে যখন তার নামে স্লোগান ওঠে, ভীতিকর বিক্ষোভ মিছিল বের হয়, তখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে এই প্রবণতার ভবিষ্যৎ কী?

হেফাজত নেতা মামুনুল হক নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টে একজন নারীকে নিয়ে উঠেছিলেন। আপত্তি উঠলো ওই নারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে। ঘটনার একে পর্যায়ে মামুনুল হকের বৈধ স্ত্রীর সঙ্গে তার ফোনালাপ প্রকাশ হলো। তাতে বোঝা গেলো, যে মহিলাকে নিয়ে তিনি ওই রিসোর্টে উঠেছিলেন তিনি তার বৈধ স্ত্রী নন। অথচ এই ফোনালাপকে মিথ্যা অর্থাৎ তথ্য প্রযুক্তির কারসাজি আখ্যা দিয়ে মামুনুল হকের ভক্তরা দেশব্যাপী অরাজকতা সৃষ্টি করলো। রিসোর্টে ভাঙচুর করা হলো। রুহানি পুত্রের পরিচয় দিয়ে বেশ কয়েকজন তরুণ ফেসবুক লাইভ এতটাই ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য প্রচার করলো যে, তাদের দাবি অনুযায়ী সরকার অর্থাৎ রাষ্ট্র মামুনুলের বিরুদ্ধে মারাত্মক অন্যায় আচরণ করেছে।

অথচ শেষ পর্যন্ত মামুনুল হক নিজেই স্বীকার করেছেন রিসোর্টকাণ্ডের ওই নারী তার বৈধ স্ত্রী নয়। চুক্তিভিত্তিক বিয়ের সম্পর্ক রয়েছে তাদের মধ্যে। শুধু রিসোর্টকাণ্ডের ওই নারী নয়, আরও একাধিক নারীর সঙ্গে তার চুক্তিভিত্তিক বৈবাহিক সম্পর্ক রয়েছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছেন তিনি। চুক্তিভিত্তিক বিবাহ ইসলাম ধর্মে জায়েজ অর্থাৎ স্বীকৃত নয়। অথচ একজন ধর্মীয় নেতা স্বয়ং এই অন্যায়, নীতিহীন কর্মে জড়িত। উদ্বেগজনক হলেও সত্য, এতকিছু জানার পরও ‘আমরা সবাই মামনুল হবো’ এই স্লোগান তুলেছে কিছু উগ্রবাদী মোল্লা এবং মাদ্রাসা ছাত্রদের কেউ কেউ। এটাই বা কীসের আলামত?

মামুনুল হক হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব হলেও সংগঠনের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা তিনি। তার প্রভাব বলয়ের কারণ খুঁজতে শুরু করেছেন সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী। শুরু থেকেই হেফাজতে দুটি ধারা ছিল। এক ধারার নেতারা মহান আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর তরিকা অনুযায়ী নিরিবিলি জীবনযাপনে অভ্যস্ত। কোনও প্রকার নাশকতা ও উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডের বিরোধী তারা। আরেক ধারার নেতারা সম্পূর্ণ বিপরীত। পরিস্থিতি বুঝে ধর্মের অপব্যাখ্যা করা ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে নেতাকর্মীদের মাঝে উত্তেজনা ছড়ানোই এই অংশের মূল লক্ষ্য। মামুনুল হক এই অংশের আলোচিত নেতা। নানা সময়ে তিনি সরকারবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেছেন। মহানবী (সা.) ঠোঁট নাড়ানো নিয়েও বিভ্রান্তকর ভঙ্গি করেছেন। গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেছেন, কর্মীদের মাঝে জোশ অর্থাৎ তাকদ সৃষ্টির জন্য তিনি এসব করেছেন। যাতে করে যেকোনও সময় যেকোনও আহ্বান জানানো মাত্রই তারা যেন দুর্বার গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

প্রিয় পাঠক, ভাবুন একবার ধর্মীয় লেবাসে কী এক দুরভিসন্ধি! দেশের বিরুদ্ধে এ এক গভীর ষড়যন্ত্র। সব দেশপ্রেমিক মানুষ, সৎ ও নিষ্ঠাবান ধর্মীয় নেতা এবং ধর্মীয় শিক্ষাগুরুদের উচিত এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিতর্কিত ইসলামিক নেতা মামুনুল হক নিজ মুখে তার অপকর্মের কথা স্বীকার করলেও তার দল এখন পর্যন্ত তার ব্যাপারে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই। তাকে সমর্থন জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এসবই বা কীসের আলামত?

লেখাটি শেষ করি। তার আগে একটি জরুরি প্রসঙ্গ তুলতে চাই। দেশের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত। হেফাজতসহ বিভিন্ন সংগঠন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের দেশের বিদ্যমান অন্যান্য শিক্ষা ব্যবস্থার শিক্ষার্থীদের প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টিতে প্রতিনিয়ত উসকানি দিয়ে চলেছে। নানা ধরনের অপকর্মে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদেরই সুচতুরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার একটা বিপরীতমুখী অবস্থান দিনে দিনে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। এই বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া দরকার। শিক্ষার প্রতিটি স্তরে সমতার পরিবেশ সৃষ্টি করা সময়ের দাবি।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার; সম্পাদক, আনন্দ আলো
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উত্তরাসহ দেশের চার পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান
উত্তরাসহ দেশের চার পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান
রনির ব্যাটে প্রাইম ব্যাংককে হারালো মোহামেডান
রনির ব্যাটে প্রাইম ব্যাংককে হারালো মোহামেডান
কুড়িগ্রামে বৃষ্টির জন্য নামাজ, এপ্রিলে সম্ভাবনা নেই বললো আবহাওয়া বিভাগ
কুড়িগ্রামে বৃষ্টির জন্য নামাজ, এপ্রিলে সম্ভাবনা নেই বললো আবহাওয়া বিভাগ
‘উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে’
‘উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ