X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘আইলারে নয়া দামান’

ড. বিশ্বজিৎ রায়
০৬ মে ২০২১, ২০:১৫আপডেট : ০৬ মে ২০২১, ২০:১৫
ড. বিশ্বজিৎ রায় ক’দিন আগে ‘সর্বতো মঙ্গল রাধে’ ফেসবুক-ইউটিউবে মহা তোলপাড় হয়ে গেলো। তার রেশ কাটতে না কাটতেই ‘আইলারে নয়া দামান’ গানটি নিয়ে পত্রপত্রিকাসহ ফেসবুক-ইউটিউব তোলপাড় চলছে। এই গানটি নিয়ে আমার জানার আগ্রহটাও কম নয়, সত্য উন্মোচনে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। এই ধারাবাহিকতায় ‘বিকৃতির অতলে লোকগান’ শীর্ষক ২০টি জননন্দিত গান নিয়ে লেখা শেষ করেছি।

আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৭২ সালে। দেশ স্বাধীনের পরপরই সিলেটের আঞ্চলিক গানের রাজপুত্তুর নামে খ্যাত বিদিত লাল দাস একটি সংগীত দল গঠন করেন। নামকরণ করা হয় ‘বিদিতলাল দাস ও সঙ্গীরা’। যুক্ত ছিলেন শিল্পী সুবীর নন্দী, রামকানাই দাস, দুলাল ভৌমিক, হিমাংশু বিশ্বাস, এ কে আনাম, হিমাংশু গোস্বামী, আকরামুল ইসলাম, ফজল মাহমুদ এবং কবি গিয়াসউদ্দিন আহমদ প্রমুখ। ১৯৭৩ ও ৭৪ সালে পর পর দু’বছর বাংলাদেশ বেতার ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস আয়োজিত লোকগীতি উৎসবে এই দল অংশগ্রহণ করে। সেখানে ১৯৭৩-এর আয়োজনে প্রথমবারের মতো গীত হয় ‘সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী’ গানটি। যার সুর যোজনার রূপকার ছিলেন শ্রদ্ধেয় বিদিত লাল দাস। এই দলের প্রায় সকলেই ভিন্ন ভিন্ন স্থানে থাকলেও এখনও যোগাযোগ রাখেন হিমাংশু বিশ্বাস (সিলেট), আকরামুল ইসলাম (ঢাকা), দুলাল ভৌমিক (নিউ ইয়র্ক) ও হিমাংশু গোস্বামী (লন্ডন) পরস্পরের সঙ্গে। ‘সাধের লাউ’ গানটির রূপায়ণের মিথ্যাচারে তারা সবাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং মিথ্যাচারী ব্যক্তিকে সিলেটের সংস্কৃতিকর্মীরা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিলেন। এবং তাঁর রচিত ‘আমার জীবন ও সঙ্গীত’ গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করার জন্য কোর্টে মামলাও হয়েছিল। সেই ব্যক্তির প্রয়াণের দীর্ঘদিন পর আবার নতুন বিতর্কে তিনি জড়িয়ে পড়লেন। ‘আইলারে নয়া দামান আসমানের তেরা’ গানটিকে কেন্দ্র করে।

উক্ত গানটি হাসপাতালের করিডোরে তিন ডাক্তার কর্তৃক নাচের সঙ্গে ভাইরাল হবার পর, বিতর্ক উসকে দিলেন ওই প্রয়াত ব্যক্তির কন্যা ও পুত্র নিউ ইয়র্ক থেকে। তাদের দাবি, গানটি তাদের ঠাকুরমা দিব্যময়ী দাশের রচনা ও সুর যোজনা। তাদের বক্তব্য, ‘দিব্যময়ী দাশ এই গানটি শ্রদ্ধেয় শিল্পী ইয়ারুন্নেসা খানমকে শিখিয়েছিলেন এবং তিনি প্রথমবার এ গান রেডিওতে গেয়েছিলেন। দিব্যময়ী দাশ রেডিওর এনলিস্টেড গীতিকার না হওয়ায় সেই সময় উনার নাম রেডিওতে আসেনি। পরবর্তীতে দিব্যময়ী দাশের পুত্র পণ্ডিত রামকানাই দাশ এ গান প্রথম রেকর্ড করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত তাঁর একক অ্যালবাম ‘অসময়ে ধরলাম পাড়ি’তে’ (ফেসবুক থেকে)। পাশাপাশি দিব্যময়ী দাশের কন্যা একুশে পদকপ্রাপ্ত শিল্পী শ্রদ্ধেয় সুষমা দাশের বক্তব্য, ‘প্রিয় দর্শক-শ্রোতা, আমার কাছ থাইক্যা আইলরে নয়া দামান আসমানের তারা, কেউ পাইলরে নয়া দামান আসমানের তেরা এই গানটার জন্য অনেকেই আমারে ফোন দেয়। আমি একটি কথা বারবার বলি, আমার ১৫/১৬ বছরে বিয়া অইয়া গেছে। আমার মা (দিব্যময়ী দাশ) তো বড় গায়ক ছিল ইডা তো আর মিথ্যা কতা না। তবে মায় লেখলে লেখতা পারইন, তবে আমি আমার শ্বশুরালয়ে শ্বশুরের সংসার এটা সম্বন্ধে জানবো আমার ভাইয়ে, জানবো আমার ভাই-বৌয়ে, জানবো আমার ভাইপুতে। তবে আমি জানি ইয়ারুন্নেছা ওই টিলাগড় যাইতো গান শিখবার লাগি। আমার মায় একটা গান দিছলা, তোরা শুনগো নীরব হইয়া/ দেখ গো বাহির হইয়া/ কি সুন্দর বাঁশিটি যায় বাজাইয়া।’ তবে ইয়ারুন্নেছা আরও অনেক গান আনছে। মা তো ভালো গায়ক আছিল ইডা তো অবিশ্বাসের কিচ্ছু না। দেখলে তো দেখতা পারইন।’ শ্রদ্ধেয় সুষমা দাশ অত্যন্ত সততার আশ্রয়ে থেকে তিনি বলেছেন, ‘মায় লেখলে লেখতায় পারইন।’ এই গানটি জনপ্রিয়তার কমপক্ষে ৪৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। একমাত্র শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত রামকানাই দাশ ছাড়া কেউ বলেননি এটা তাঁর মায়ের গান। তিনি আরও কিছু গানকে নিজের গান বলে দাবি করেছিলেন। যেমন– ‘বিনোদিনী গো তোর বৃন্দাবন কারে দিয়ে যাবি’, একখান পান চাইলাম পান দিলি না এবং ‘সজনী গুয়া গাছো ট্যাক্স লাগিলনি’ ইত্যাদি। বিতর্কের বেড়াজালে পণ্ডিত রামকানাই দাশ জড়িয়ে পড়েছেন।

উল্লেখ্য, গানটি ১৯৭৪ সালে ‘বিদিতলাল দাস ও সঙ্গীরা’ কর্তৃক বাংলাদেশ টেলিভিশনে নওয়াজেশ আলী খানের প্রযোজনায় ও শহীদুল ইসলামের সঞ্চালনায় ‘বর্ণালী’ অনুষ্ঠানে বিয়ের গান হিসেবে গীত হয়। উক্ত চার জনের সঙ্গে কথা বলে যতদূর জানা যায়, সেখানে দুটি গান ছিল। একটি বর আগমনের গান এবং অন্যটি কন্যা বিদায়ের গান। গান দু’টি চিত্রায়িত অংশে ছিলেন দুলাল আহমেদ (জামাই) ও কনে হিসেবে ছিলেন কণ্ঠশিল্পী শুভ্র দেবের বড় বোন। হিমাংশু বিশ্বাস ও হিমাংশু গোস্বামীর বক্তব্য– গান দু’টির রচয়িতা প্রখ্যাত গীতিকবি গিয়াসউদ্দিন আহমদ। দুলাল ভৌমিক বললেন– আমি এই প্রোগ্রামের সময় পূর্ব থেকেই ঢাকায় অবস্থান করি। তবে কনে বিদায়ের গানটি ‘গিয়াসউদ্দিন গীতি সমগ্রে’ থাকলেও বর আগমনের এই গানটি নেই। প্রকৃত অর্থে এই গানটির সুর যোজনা ধামাইল অঙ্গের নয়। যেমন, ‘লীলা বালি লীলা বালি’ গানটি। এই গানটিতে পুঁথি পাঠের সুর ব্যবহার করে বাণীগুলোকে পরিস্ফুট করার চেষ্টা পরিলক্ষিত। মুসলিম বিয়ের গীতে এই সুরটি লক্ষ করা যায়। আমি মনে করি, গানটি প্রচলিত লোকগান। এছাড়া শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত রামকানাই দাশের গীতরূপের শেষ অংশটি আরোপিত বলে আমার মনে হয়।

(রামকানাই দাশের গীত গান)

 আইলোরে নুয়া জামাই আসমানের তারা
বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের ন্যাড়া
জামাই বও জামাই বও
আইলোরে জামাইয়ের ভাই বও দেখতে বটের গাইল
উঠতে বইতে ছয় মাস লাগে করইন আইন চাইন
জামাই বও জামাই বও
আইলোরে জামাইয়ের বইন হিজলের মুড়া

টুকনি দিলে ফ্যাদা পড়ে ষাইট সত্তুর বুড়া
জামাই বও জামাই বও
আইলোরে জামাইয়ের ভাই আসমানের চাঁন
যাইবার লাগি কওরে যদি কাইট্টা রাখমু কান
জামাই বও জামাই বও
কুঞ্জের ভিতরে জামাই বইছে গো সাজিয়া
পাড়ার লোকে দেখতো আইছে দিব্যময়ীর বিয়া
জামাই বও জামাই বও

(ভাইরাল হওয়া গান)

আইলারে নয়া দামান আসমানের তেরা
বিছানা বিছাইয়া দিলাম শাইল ধানের নেড়া
দামান বও দামান বও
ও দামান কওরে কতা খাওরে বাটার পান
যাইবার কতা কও যদি কাইট্টা রাখমু কান
দামান বও দামান বও
আইলারে দামানের ভাই হিজলের মুড়া
ঠুনকি দিলে মাটিত পরইন ষাইট/সত্তইরের বুড়া
দামান বও দামান বও
আইলারে দামানের বইন কইবা একখান কতা
কইনার ভাইর ছে’রা দেইখা হইয়া গেলা বোবা
দামান বও দামান বও
আইলারে দামানের ভাই বও দেখতে বটের গাইল
উঠতে বইতে ছয় মাস লাগে করইন আইন চাইন
দামান বও দামান বও

পরিশেষে বলতে চাই, পণ্ডিত রামকানাই দাশ একুশে পদকপ্রাপ্ত শুধু উচ্চাঙ্গ সংগীতের নয়, লোকসংগীতের এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব। এই সম্মানীয় শিল্পীর নামের সঙ্গে বিতর্ক-সমালোচনা যুক্ত থাকা কখনোই কাম্য নয়। আমরা চাই, লোকগানকে বিকৃতির হাত থেকে বাঁচাতে এবং নিজের গান বলে অযৌক্তিক দাবির হাত থেকে লোকগানকে রক্ষা করতে।

                                                                               
লেখক: লোকসংগীত গবেষক, শিল্পী ও সংগঠক
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ