X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার করুণ কাহিনি: শাটডাউন, লকডাউন ও  ‘ব্রেকডাউন’

মাকসুদুল হক
০৪ জুলাই ২০২১, ১৫:২৭আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২১, ১৫:২৭

মাকসুদুল হক ‘গরিব গরিবই রবে, বড়লোক বড় হবে,
বুদ্ধিজীবীগণ থাকবেন বেঁচে
বুদ্ধিদীপ্ত কোনো ছদ্মবেশে’

গান: সামাজিক কোষ্ঠকাঠিন্য, ১৯৯৪
কথা: লেখক

১. সময় হারানো সময়:

বাংলাদেশে মহামারির দিন দেখতে দেখতে আমরা ১৫ মাস কাটিয়ে ১৬ মাসে পা রেখেছি। কতটা মূল্যবান সময় আমাদের শেষ হয়ে গেলো, কতটা বিষণ্ণতা, আয়-রোজগারের সকল পথ বন্ধ থেকে সময় কেটেছে বা কাটছে, এসব নিয়ে আমাদের অনেক দুঃখ থাকলেও একমাত্র সান্ত্বনা: আমরা একা নই — পৃথিবীর সকল প্রান্তে মানুষ এই একই দুর্দশায় ভুগছে, যেন এই সময় আর শেষ হওয়ার নয়।

যদি হতো এ কোনও দেশরক্ষার যুদ্ধ, যদি শত্রুকে আমরা শনাক্ত করতে পারতাম তাহলে ‘হাসিমুখে মৃত্যুবরণ’ করার জন্য লক্ষ লক্ষ লোক প্রস্তুত থাকতো। কিন্তু নিয়তির পরিহাস— পৃথিবীর ইতিহাসে এ-রকম ভুতুড়ে অদৃশ্য শত্রুর আগমন কি আগে কখনও ঘটেছিল, তা আমাদের অজানা। যে-বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা নেই— তা নিয়ে চিন্তাই-বা করি কী করে? এমনই এক ভাইরাসের সঙ্গে চলছে লড়াই যা শাশ্বত বিজ্ঞান সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে এখনও অক্ষম। তথাপি এই যুদ্ধে যারা ‘ফ্রন্টলাইন ফাইটারের’ ভূমিকায় নিঃসঙ্কোচে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, তারা প্রত্যেকেই ছিলেন ‘সুইসাইড স্কোয়াডের’ সদস্য। তাদের এই নিঃস্বার্থ আত্মহুতির কথা আমরা আগামীতে মনে রাখবো কি? তাদের নাম ইতিহাসের পাতায় ‘স্বর্ণাক্ষরে’ লেখা থাকবে তো?

২. অবিশ্বাসও এক ধরনের বিশ্বাস:

২০২০-এ মহামারির ভাইরাসের জন্মলগ্ন থেকে তার চারিত্রিক রূপ ও গঠন সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি— এখন নতুন নতুন সৃষ্ট ‘ভ্যারিয়েন্ট’ বা বৈভাষিক ভাষ্য আমাদের নতুন করে প্রতিদিনই দুর্ভাবনায় ফেলে দিচ্ছে। প্রকৃত অর্থে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বা বিশ্বের ধনী, প্রভাবশালী ও উন্নত দেশের ভাষ্য হয়তো আমরা ঠিকই শুনছি ও মেনে নিচ্ছি, কিন্তু একাগ্রচিত্তে কেউ তা বিশ্বাস করতে পারছি না। বিশ্বাস না করার কারণ — আমরা প্রতিনিয়ত যে তথ্যগুলোর মুখোমুখি হচ্ছি তাতে মনের গহীনে বিশাল বড় ধাক্কা ও খটকা লাগে, আমরা বারংবার হোঁচট খাচ্ছি। মহামারিকেন্দ্রিক তথ্য যা ঘণ্টায় ঘণ্টায় আপডেট পাচ্ছি, তা অধিকাংশ সময় অতিমাত্রায় অতিরঞ্জিত, অযৌক্তিক ও হিতাহিতজ্ঞান বহির্ভূত মনে হচ্ছে। স্বস্তির নিঃস্বাস— যাতে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম সারাটা জীবন, এখন কেউ নিতে পারছি না।

অস্বস্তির আরেক কারণ: বিশ্বের প্রতিটি দেশের সরকার জনগণের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো হয় উপেক্ষা করে পাশ কেটে যাচ্ছে, বা স্বেচ্ছায় তথ্য গোপন করছে। এমনকি কোন দেশে কতজনের মৃত্যু হয়েছে, তাও রহস্য থেকে যাচ্ছে। রাষ্ট্রগুলোর কাছে হয়তো এমন ‘সেনসিটিভ’ তথ্য আছে যা সাধারণে উন্মোচিত হলে ব্যাপক রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে। বরাবর এই কলামে আমি বলে এসেছি, এখন চলছে অঘোষিত ‘মনস্তাত্ত্বিক ও জীবতাত্ত্বিক বিশ্বযুদ্ধ’ এবং যে কোনও যুদ্ধে প্রথমে পরাজয় ঘটে সত্যের— মিথ্যার হয় বিজয়। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে জিহাদের সময় মিথ্যা বলা পাপ বা ‘গুনাহ’ বলে  বিবেচিত হয় না— বরং তা ‘জায়েজ’ বা অনুমোদনযোগ্য। যুদ্ধের সময় প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মিথ্যা বলা রণকৌশল ছাড়াও এক শক্তিশালী হাতিয়ার।

এসবের ওপরে দুশ্চিন্তার তালিকায় আছে ভৌগোলিক রাজনীতির ভয়াল থাবা। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, আগামী দিনগুলোতে এই মানব-বিধ্বংসী ভাইরাস ছাড়াও নেপথ্যে মানুষ মানুষকে ধ্বংস করার গর্হিত কাজকারবার এগিয়ে যাচ্ছে ক্ষিপ্রগতিতে। কারা এই কাজ করছে— তা আপাতত অনুক্ত থাকাটাই শ্রেয়।

৩. দুঃসময়ের বাংলাদেশ: 

একটু কি চিন্তা করা যায় আমরা নিজেরাই কী অদ্ভূত সময় কাটাচ্ছি? এই মুহূর্তে করোনা মহামারি না, বরং দূরদৃষ্টিতার অভাব ও হিতাহিত জ্ঞানের স্বল্পতা আমাদের সবচাইতে বড় শত্রু। কেবল রাষ্ট্র একা না— বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক এর জন্য সমানভাবে দায়ী। যেমন ধরা যাক — ২৫ জুন শুক্রবারে আরেক নতুন ইংরেজি শব্দের আগমনের ঘটনা:

সাধারণ ছুটির পর লকডাউন — এবার ‘শাটডাউন’ এবং  তা কার্যকর হবে ২৮ জুন সোমবার থেকে, মানে ৭২ ঘণ্টার ভেতরে। এই শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থটা আদৌ কী, তা বোঝার অনেক আগেই জনগণের মধ্যে এমন এক প্যানিক সৃষ্টি হলো যে পরের দিন অর্থাৎ ২৬ জুন শনিবার থেকেই এই শব্দের অর্থ খেটে-খাওয়া জনগণ সংশ্লেষে বুঝলো ‘বাড়িতে ভাগি’।

পুরোদস্তুর দুপুর থেকেই লক্ষ লক্ষ লোক যেভাবে ঈদে গ্রামে যায়— সেই একই চিত্র ভেসে উঠল সকল মিডিয়ার কল্যাণে। ঢাকাতে কেউ ঢুকতেও পারবে না বা বের হতে পারবে না তার বন্দোবস্ত সেই ২১ জুন থেকেই সরকার কার্যকর করে রেখেছে। মহাসড়কে মানুষের ঢল নামার দৃশ্য এক কথায় ছিল বিভীষিকাময় — বিশেষ করে উপচে-পড়া যাত্রী বোঝাই ফেরি পারাপারের সময়। আমাদের  সৌভাগ্য যে কোনও দুর্ঘটনা ছাড়াই নিরাপদে লোকজন বাড়ি ফিরতে পেরেছে।

৪. গরিবের প্রতি ‘দরদ’ ও সিদ্ধান্তহীনতার ক্ষতিপূরণ:

একের পর এক দ্রুত ঘটনা ঘটতে থাকল আর বহু প্রশ্ন, প্রশ্ন হিসাবেই থেকে গেলো— তার সদুত্তর কোনোদিনও পাবো না জেনেও  এক নগণ্য দেশপ্রেমী বাংলাদেশের নাগরিকের অধিকারের বলে, প্রশ্নগুলো করতে বাধ্য হচ্ছি।

প্রসঙ্গত, ২৬ জুন জানা গেলো, সোমবার ২৮ জুন না ‘থুক্কু’– বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে এক ‘কঠোর লকডাউন’ শুরু হবে— তা খুবই ভালো কথা।

প্রশ্নবাণ: আগের সিদ্ধান্তে সরকার নিজেই কেন ‘কঠোর’ থাকতে পারলো না? যেখানে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল তথ্য-প্রতিমন্ত্রী মহোদয় স্বয়ং এই ঘোষণা দিয়ে টেলিভিশনে দীর্ঘ ‘লাইভ’ সাক্ষাৎকার দিলেন — তা যদি ২৪ ঘণ্টার আগেই বাতিল হয়ে যায়, রাষ্ট্রের প্রেরিত তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা যে নিমেষে ম্লান হয়ে গেলো, এবং ভবিষ্যতে জনগণ যে অনাস্থা জ্ঞাপন করবে— এ নিয়ে কি কারও বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা বা ‘আন্তরিক দুশ্চিন্তা’ ছিল না?

কী কারণে এই ঘোষণাটি পাল্টানো হলো, তা শুধু সমন্বয়হীনতা বা মেসেজিং-এর ত্রুটি বলা যাবে না। এ ছিল বিশুদ্ধ মস্তিষ্ক ‘গিয়ারে’ হাত দেওয়ার আগেই মুখের এক্সেলেটরে চাপ দেওয়ার অভিপ্রায়। গাড়ি বিকট হুঁহুঁ করে শব্দই করলো— কিন্তু আর আগালো না। উল্টোটাও হতে পারে। যেমন, অনেক দৌড়বিদ স্টার্টলাইনে গুলির আওয়াজের আগেই দৌড় শুরু করে বা ‘জাম্পিং দ্য গান’, সে রকমই এক  বিতিকিচ্ছিরি ‘ফল্স্ স্টার্ট’। 

এখন আসা যাক বাড়তি ‘জনগণ স্পেসিফিক’ প্রশ্নে:

মানুষের গ্রামে ফেরার ভোগান্তি, বিকল্প পরিবহনে যাত্রার খরচ যা অন্য সময় থেকে ৩ বা ৪ গুণ বেশি, মাইল-কে-মাইল পুরা পরিবার নিয়ে হাঁটা, কোলে ছোট শিশু, হাতে বা মাথায় ভারী ব্যাগ, অসুস্থ ও বৃদ্ধ মানুষ দম ফেলতে পারছে না ইত্যাদি অমানবিক কষ্ট যে করলো শুধু রাষ্ট্রের ভুল সিদ্ধান্ত বা সিদ্ধান্তহীনতার কারণে, তার জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করা কি অযৌক্তিক হবে?

এত কিছু উন্নয়নের পর, এত পজিটিভ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচক থাকা সত্ত্বেও আজ ৫০ বছরেও আমরা কল্যাণরাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারিনি। যে দেশে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা নেই, বেকারত্বের ভাতা নেই, বেঁচে থাকার জন্য সবকিছুই ‘ভাগ্য’ ও নিয়তির ওপরে ছেড়ে দেওয়া হয়, সেখানে আইন ছাড়া কে-ই-বা আছে আমাদের পরিত্রাতা?

আমি নিশ্চিত হয়েই বলছি, প্রচলিত আইনে সে রকম ব্যবস্থা অবশ্যই আছে— তদপুরি ‘দিনে আনি দিনে খাই রাইতের কোনো খবর নাই’ দিনমজুরের পাক্কা ৪ দিনের রিজিকের ওপরে হাত দেওয়া হলো এসব হঠকারি সিদ্ধান্তের জন্য — তার কি কোনও বিচার হবে না?

মানসিক হয়রানি সে যে-ই করুক তা যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ— তা কি বিচারব্যবস্থা থেকে বাতিল ঘোষণা হয়েছে? মন্ত্রী, আমলা ইত্যাদি রাষ্ট্রের বেতনভোগী কর্মচারী তাদের কি জনগণের প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা নেই? তাদের অস্বচ্ছ কর্মকাণ্ড যা দ্বারা জনগণের শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা কি আইনের চোখে ক্ষমাযোগ্য?

আর মুখে ছুঁকছুঁক শব্দ করে এই যে আমরা যাদের ‘হতদরিদ্র, গরিব, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী’ বলি তারাই-বা কারা? যাদের নিয়ে আমাদের উটকো দরদের কূটিলতা, সেই ৮০ শতাংশ জনগণ দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর চালিকাশক্তি। এই মানুষগুলোর বিদেশে থেকে মরুভূমির তাপদাহে অমানবিক পরিশ্রম, নারী কর্মীদের যৌন নির্যাতনের পর হত্যা, গার্মেন্টসের কর্মীদের অত্যন্ত নিম্ন মজুরিতে ব্যবহার করে আমাদের বিদেশি মুদ্রা আয়, প্রমাণ করে আমাদের খেটে-খাওয়া মেহনতি মানুষ মোটেও দরিদ্র না।

‘মানসিক দরিদ্র্যতায়’ ভুগছি আমরা তথা শিক্ষিতজন, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক সহ আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদগণ।

আর রাষ্ট্রীয় ‘অনুদান’— এটাই-বা কি? কেবল দুর্যোগপূর্ণ সময়ে রাষ্ট্রের এই ‘ইজ্জত বাঁচানো’ খয়রাত দেওয়ার কর্মসূচি কোন যুক্তিতেই-বা দেওয়া হয়? খেটে-খাওয়া মানুষ তো খয়রাত চায় না, সে তো ভিক্ষার থালা নিয়ে আমাদের দ্বারপ্রান্তে আসে না— সে কেবল কর্ম ও ভবিষ্যতে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার সুনিশ্চিত রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ চায়। তদুপরি চায় এই দারিদ্র্য নামের ‘মানবসৃষ্ট’ অভিশাপ থেকে সারাজীবনের মুক্তি ও স্থায়ী সমাধান।

এসব না করে, আমরা রক্তচোষা ধনীদের আরও ধনী করছি ও দারিদ্র্য বিমোচন না করে যুগযুগ ধরে দারিদ্র্যের অণ্ডস্ফুটন করছি। এই অন্যায়, এই মহাপাপের জন্য আমাদের কি চড়া মূল্য কখনোই দিতে হবে না? গরিব আমাদের অর্থের ঋণ বা খয়রাতে অবাধ্য থাকতে বাধ্য না — কারণ সে জানে তাদের রক্তের ঋণ আমরা কখনোই পরিশোধ করতে পারব না।

৫. সামাজিক দূরত্ব কত ফিট আর মাস্কের যত লেয়ার:

রাজধানী থেকে পলায়নরত মানুষের আরেক ভয়াবহ চিত্র ছিল অধিকাংশ মানুষের মাস্ক নেই— আর “সামাজিক দূরত্ব” সেটাই-বা কি করে করা সম্ভব?

তর্কের খাতিরে ধরা যাক ১৬ কোটি ঘনবসতিপূর্ণ মানুষের দেশে যদি ৫ কোটি মানুষও এই তথাকথিত ৩ বা ৬ ফিট ‘শারীরিক দূরত্ব’ বজায় রাখতে আন্তরিক ভাবে চায়— তাহলে অবস্থাটা কী হবে?

আমাদের দেশের যে আয়তন তাতে একে অপরকে দূরে ঠেলতে ঠেলতে আমরা কি সবাই বঙ্গোপসাগরে নিক্ষিপ্ত  হবো? এসব বিষয়ে নেই কোনও আলাপ বা সিরিয়াস চিন্তা। রাষ্ট্র সহ মিডিয়া এই অবাস্তব ‘সামাজিক দূরত্ব’ বলে অহর্নিশি যে মুখের ফেনা তুলেছেন, তারা কেন জানি না বাংলাদেশকে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা বা আমেরিকার মতো বৃহৎ আয়তনের দেশের সঙ্গে মন থেকে তুলনা করেন।

বাঙালির মনের আয়তন আকাশ থেকে বৃহৎ হলেও তার মন্দ কপালের প্রাকৃতিক আয়তন ইঁদুরের গর্তের চেয়েও ছোট।

৬. মাস্ক ব্যবহারের ময়না তদন্ত:

‘মাস্ক মাস্ক ও মাস্ক’ বলে সরকারি প্রচারণা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়ে যে মুখ থুবড়ে পড়েছে তা এখন একেবারে সন্দেহাতীত। ১৫ মাসে দেশের বড়জোর ১৫ থেকে ২০ ভাগ লোককে আমরা এই অভ্যাসের আওতায় ‘হয়তো-বা’ নিয়ে আসতে পেরেছি — এটাই হলো বাস্তব চিত্র।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে মাস্কটাই এখন একমাত্র সহজ রক্ষাকবচ। আমরা না এর বিপক্ষে যেতে পারি, না এর ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করতে পারি। কিন্তু মাস্ক ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবো না এমন কোনও কথা কি আছে? মাস্ক পরিধান করছি বলে ঠিক ‘নাক অব্দি’ ক্ষীণদৃষ্টিচিন্তা করতে আমরা বাধ্য — এর বেশি চিন্তা করা যাবে না — তা মেনে নেওয়াটা খুবই ডিফিকাল্ট।

আমি নিজেও মাস্ক ব্যবহার করি কিন্তু সত্যি বলতে এ প্রচণ্ড ঝামেলাপূর্ণ এক কাজ। বড়জোর তা একটানা আধাঘণ্টা ব্যবহার করা যায় তারপর শাসকষ্ট, নাক থেকে ফসকে থুতনিতে আটকানো, কারো সাথে কথা বলতে গেলে বারংবার উপর-নিচ টানাটানি করা, চশমা ঘোলা হওয়া, ফোনে কথা বললে অপরপ্রান্তে লোক কথা না বোঝার বিড়ম্বনা ইত্যাদি তো আছেই — আর নিজের ও অন্য লোকের মাস্কসৃষ্ট মুখের দুর্গন্ধ? না ... থাক!

তবে বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করছি যে করোনার ভ্যারিয়েন্টের মতো মাস্কের ‘চরিত্র’ ও পরিধানের ‘আদেশ’ও দ্রুত পাল্টাচ্ছে। গত বছর বলা হয়েছিল একটা সার্জিকাল মাস্ক পরলে চলবে। ক’দিন যেতে না যেতে বলা হলো কাপড়ের মাস্ক পরলেও চলবে। আমরা তো মহা খুশি, কিন্তু আবার বলা হলো ‘না না না … তিন লেয়ারের (প্রলেপ) মাস্ক না পরলে মারা যাবেন’ — তাজ্জবের কথা! কী আর করার আছে?

ভীতু জনগণ তা-ই করলো। কিন্তু ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আসার পর বলা হচ্ছে ‘সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে ৭ লেয়ারের’ মাস্ক কেবল পরিধান করলেই চলবে না — দুটো মাস্ক একসাথে ব্যবহার করতে হবে! জান বাঁচানোর জন্য ‘১৪ শিকের জেলখানার’ ন্যায় আমাদের নাক ও মুখ কারারুদ্ধ থাকা এখন মনে হচ্ছে ‘অবশ্যক’।

তবে বাঁকা চোখে যদি বিষয়টা অনুধাবন করতে হয়— এমনকি হতে পারে যে নেপথ্যের কারবারিরা কোনও গোপন গবেষণার মহড়া শুরু করেছেন? তারা শুধু এটুকুই কি বুঝতে চাচ্ছে যে মানবপ্রাণী কতটা কম বা ‘সীমিত পরিসরে’ অক্সিজেন নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে? এমন দিন কি আসবে যেদিন এক লিটার কোমল পানীয়’র সাথে দুই-লিটার অক্সিজেনের বোতল আমরা দোকান সহ অনলাইনে ক্রয় করতে বাধ্য হবো? নাকি ভ্যাকসিনের ন্যায় কোন অক্সিজেনের ‘ব্র্যান্ড’-এর কতটা ‘কার্যক্ষমতা’ তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক করবো?

এ-সকল ‘করুণ বাস্তবতা’ না হয় আমরা মেনে নিলাম। কিন্তু আমরা নিজেরা এমন কি কোনও বিকল্প চিন্তা করছি যা দ্বারা আমাদের হতদরিদ্র জনগণ ও আমরা এই বৈদিক মেঘের ঘোর অন্ধকার ভেদ করে নিদেনপক্ষে কোনও আশার আলো দেখতে পাবো, যাতে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাটুকু বাড়বে?

সবকিছুই না হয় তথাকথিত ‘ভাগ্য’ নামের বস্তুর ওপরে ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু এই জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ‘পবিত্র দায়িত্ব’ কার?

যে মুহূর্তে একটি সরকার পবিত্র গ্রন্থ ধরে শপথ বাক্য পাঠ করে, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই তার আদেশ হয় স্রষ্টার আদেশ, তার সকল প্রশংসা হবে স্রষ্টার প্রশংসা, তার সকল কর্ম হবে স্রষ্টার কর্ম এবং অতিগুরুত্বপূর্ণ: তার সকল ধ্যান এবং চিন্তা হবে মানবকল্যাণের। অর্থাৎ জনগণের কল্যাণ হলো স্রষ্টার কল্যাণ। এসব কারণেই রাষ্ট্র পরিচালনা, সংবিধান ও সার্বভৌমত্বকে অটুট রাখাকে বলা হয় ‘পবিত্র দায়িত্ব’।

৬. ঐতিহাসিক পহেলা জুলাই:

২০২১: বাংলাদেশে লকডাউন শুরু হলো এবং শতরকম প্রতিকূলতার মাঝেও ‘কঠোরতার’ যথেষ্ট আলামত পাওয়া যাচ্ছে। খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে কোনও যানবাহনের কর্কশ শব্দে নয় — পাখি  ও কাকের ডাকে! ফেসবুকে সবাইকে ‘শুভ লকডাউন’ উইশ করেছি — কল্যাণকর শুভদিন না-আসা অব্দি এই উইশ বলবৎ থাকুক।

২০১৬: এই দিনে ধর্মীয় উগ্রবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীর আক্রমণে হলি আর্টিজান বেকারিতে বন্ধু ইশরাত আখন্দ সহ দেশি-বিদেশি ২২ জনের তাজা প্রাণ ঝরে যায়। তাদের বিনম্র শ্রদ্ধাভর চিত্তে স্মরণ করছি ও ভক্তি জানাচ্ছি।

১৯২১: এই দিনে আমার মাতৃশিক্ষায়তন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ সহ সকল যুগান্তকারী রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শত আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র, কেন্দ্রবিন্দু এবং সূতিকাগার এই পবিত্র প্রতিষ্ঠান। লক্ষ প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীর মতো আজ তাকে কৃতজ্ঞচিত্ত স্মরণ করছি। আমার জীবনে এ অব্দি যতটুকু সার্থকতা, তার ১৪ আনা কৃতিত্ব এই প্রতিষ্ঠানের। বাকি ২ আনা ব্যর্থতার দায়ভার আমার কাঁধে রেখে আজকের মতো লেখা শেষ করছি।

লেখক: সংগীতশিল্পী

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ