X
বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্যমন্ত্রী, আপনি দয়া করে চুপ থাকুন!

রুমিন ফারহানা
১১ জুলাই ২০২১, ১৯:১৬আপডেট : ১১ জুলাই ২০২১, ১৯:১৬

রুমিন ফারহানা শনির দশা চলছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর। এখন করোনাকাল বলে সব মনোযোগ গেছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ওপর। না হলে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের অবস্থা যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চাইতে ভিন্ন কিছু, তেমনটি ভাবার কোনও কারণ নেই।
 
গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, সবার সমালোচনা ছাপিয়ে এবার সংসদও গরম ছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে নিয়ে। সে কারণেই সম্ভবত জনগণের টাকা খরচ করে বিশাল আকারের বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে নিজেকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা চালিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। যেকোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানেরই অধিকার আছে নিজের বক্তব্য তুলে ধরার, নিজেকে ডিফেন্ড করার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নিজের বক্তব্য তো স্বাস্থ্যমন্ত্রী/মন্ত্রণালয় সংবাদ সম্মেলন করেই দিতে পারতেন। জনগণের করের টাকা খরচ করে এত বড় বিজ্ঞাপন কেন?

করোনার শুরু থেকেই আমরা লক্ষ করেছি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে খুব ভয় পায়। শুরু থেকেই তাদের প্রচেষ্টা ছিল যতটা সম্ভব কম তথ্য মানুষের সামনে আসে সেই চেষ্টা করা। সংসদে যখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, বরাদ্দ ব্যয় করতে না পারা ইত্যাদি নিয়ে বিরোধী শিবির সোচ্চার ছিল,তখনও সেটার কোনও যৌক্তিক জবাব মন্ত্রীর তরফ থেকে দেওয়া হয়নি। এমনকি অস্বীকার ছাড়া কোনও উত্তর তার কাছে ছিল না। বিজ্ঞাপন মন্ত্রীকে অন্তত সরাসরি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া থেকে বাঁচিয়েছে।

 
ওনার এই বিজ্ঞাপন প্রকাশ হতে না হতেই সর্বমহলে সমালোচনা শুরু হয়েছে। টিকার সংখ্যা ও দাম, কোভিড পরীক্ষা, হাসপাতালের খরচ সবকিছু নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বিজ্ঞজনেরা। বিজ্ঞাপনে ডাক্তার, নার্স, হেলথ টেকনোলজিস্টসহ স্বাস্থ্য বিভাগের নানা কর্মীদের নিরলস সেবা দেওয়া, করোনায় আক্রান্ত হওয়া এবং অনেকের মৃত্যুবরণ করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন  (বিএমএ)-এর সাম্প্রতিকতম তথ্য মতে, দেশে দুই হাজার ৯৫৪ জন চিকিৎসক, দুই হাজার ২৩ জন নার্সসহ ৮ হাজার ২৮৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। করোনার শুরু থেকে চলতি বছরের ৬ জুলাই পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে এবং লক্ষণ-উপসর্গ নিয়ে মোট ১৬২ জন চিকিৎসক মারা গেছেন। এরমধ্যে প্রতিশ্রুত অর্থ পেয়েছেন করোনায় মৃত্যুবরণকারী কেবল একজন চিকিৎসকের পরিবার। শুধু তা-ই না, করোনার সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালনকারী সরকারি ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ প্রণোদনার অর্থ এক বছরের বেশি সময় পরে ছাড় করা শুরু হয়েছে। এই অর্থও প্রাপ্য অর্থের এক অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র।

করোনার সময়েও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়নের হার সার্বিক এডিপি বাস্তবায়নের মাত্র অর্ধেক। এটা নিয়ে সংসদে এবং সংসদের বাইরে তুমুল সমালোচনা হয়েছে। এর জবাব দিতেই বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয়েছে, যদি বিদেশ থেকে চুক্তি অনুযায়ী টিকা আসতো তাহলে এডিপি বাস্তবায়ন ৮৫ শতাংশ হতো। করোনার মতো অতি জরুরি সময়ে টিকা দিয়ে এডিপি বাস্তবায়ন করতে হবে? যতদূর জানি ১০ হাজার কোটি টাকা তো বরাদ্দ রাখা হয়েছিল টিকার খরচ বাবদ। অথচ এখন আমরা দেখছি দেশের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ নেই, কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা নেই, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা নেই, রেমডিসিভির ইনজেকশন নেই, নেই অন্যান্য আরও চিকিৎসা উপকরণ। এসব খাতে মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর মতো ব্যবস্থা নিলে গত অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ করা এডিপি’র দ্বিগুণের বেশি অর্থ প্রয়োজন হতো। এর প্রভাব আমরা দেখতে পেতাম সম্পূরক বাজেটে তার বাজেট বাড়ানোর জোর দাবির মধ্য দিয়ে।

বিজ্ঞাপন অনুযায়ী বাংলাদেশে করোনার টিকা কেনা হয়েছে ১ কোটি ১ লাখ ৫০ হাজার ডোজ। প্রতি ডোজ কেনা হয়েছে ৩ হাজার টাকা করে, মোট ব্যয় ৩ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। ওই বিজ্ঞাপনে জানানো হয়নি দেশে আসা কোন দেশের টিকা কত দামে কেনা হয়েছে। তাছাড়া ১ কোটি ১ লাখ ৫০ হাজার ডোজ টিকা কেনার কথা বলা হলেও দেশে ক্রয় করা টিকা এসেছে মোট ৯০ লাখ ডোজ (৭০ লাখ সেরাম ইনস্টিটিউটের কোভিশিল্ড, আর ২০ লাখ সিনোফার্মের টিকা)। সরকারের অতি প্রভাবশালী এক ব্যক্তির কোম্পানিকে প্রতি টিকায় এক ডলার করে কমিশন দেওয়ার পরও অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রতি ডোজ টিকার সরকার স্বীকৃত দাম ৫ ডলার বা ৪২৫ টাকা। সেই হিসাবে সেরামের টিকা কিনতে মোট ব্যয় হয়েছে ২৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

সেরামের টিকা বাদ দিলে সরকারি হিসাবে আরও ৩১ লাখ ৫০ হাজার টিকা কেনা হয়েছে। এর জন্য ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৭৪৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তাতে প্রতি ডোজের দাম পড়েছে ৮ হাজার ৭২২ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ডোজ ১০২ মার্কিন ডলারে কিনেছে বাংলাদেশ। সেরামের টিকা বাদে বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে কেনা টিকা এসেছে ২০ লাখ (বাকি টিকা উপহার বা কোভ্যাক্স প্রকল্পের আওতায়)। সেই ২০ লাখ টিকা কেনা হয়েছে চীন থেকে। সেই হিসাবে চীন থেকে কেনা টিকার প্রতি ডোজের মূল্য হবে ১৩ হাজার ৭৩৭ টাকা বা ১৬১ ডলার।

অথচ কিছু দিন আগে চীনের সিনোফার্ম টিকার দাম প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল। সরকারের জনৈক অতিরিক্ত সচিবের বলা তথ্য অনুযায়ী সেটা ১০ ডলার বা ৮৫০ টাকা। এই দাম প্রকাশিত হয়ে পড়ায় চীন নাকি ক্ষিপ্ত হয়েছে, তাতে আগের দামে টিকা নাকি পাওয়া নাও যেতে পারে। তাহলে কি এখন বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে উপরোল্লিখিত দামে অর্থাৎ ১৬১ ডলার দিয়ে টিকা কিনছে? বলে রাখি, চীন শ্রীলংকার কাছে ১৪ আর ইন্দোনেশিয়ার কাছে ১৭ ডলারে টিকা বিক্রি করছে। টেস্টের খরচ নিয়ে যা বলা হয়েছে তাও বাস্তবতা বিবর্জিত, অতিরঞ্জিত। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, হাসপাতালে ১ লাখ রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন নাকি রোগীপ্রতি ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে এবং এই খাতে সর্বমোট ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। একটা হিসাব করে দেখা যাক। সরকারি পর্যায়ে অত্যন্ত অপ্রতুল সংখ্যার আইসিউতে মাত্র কয়েক হাজার রোগীর সেবা দেওয়া হয়েছে। আইসিইউর চিকিৎসা ব্যয়বহুল, তাই এই কয়েক হাজার রোগীর পেছনে সরকারি পর্যায়ে মাথাপিছু দৈনিক ২০ হাজার টাকা ব্যয় হতে পারে। দামি ওষুধ রেমডিসিভিরও দেওয়া হয়েছে মূলত আইসিইউতে থাকা রোগীদের। এটার সাপ্লাইও ছিল অপ্রতুল।

তাহলে অন্য রোগীদের পেছনে খরচ কত? এখানে খুব জরুরি বিষয় হচ্ছে ডাক্তারসহ সব চিকিৎসাকর্মীর বেতনসহ সরকারি হাসপাতালের পুরো পরিচলন ব্যয় এক্ষেত্রে ফিক্সড কস্ট। করোনার রোগী থাকুক বা না থাকুক এই ব্যয় সরকারকে বহন করতেই হতো। আইসিইউতে ভর্তি ছাড়া অন্যান্য করোনার রোগীদের চিকিৎসা বলতে অক্সিজেন দেওয়া আর কিছু ওষুধ, যার মূল্য খুবই কম। এতে মাথাপিছু দৈনিক ২০ হাজার দূরেই থাকুক, ২ হাজার টাকা অতিরিক্ত লেগেছে কিনা সন্দেহ। এই উদ্ভট হিসাবের একটাই ব্যাখ্যা– স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘অতি চালাক’ আমলারা একটি পাঁচ-তারকা হোটেলের মতো হাসপাতালের কেবিনে থেকে চিকিৎসার ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করে এই অঙ্ক দাঁড় করিয়েছেন।

শুরু থেকেই সব বিতর্ক, প্রশ্ন আলোচনা-সমালোচনা এড়াবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এমনকি সংসদে ওঠা নানা সমালোচনার একটাই জবাব ছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর, আর সেটা হলো ‘অস্বীকার’। আর তাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই বিজ্ঞাপন কিছু মানুষকে বিস্মিত করলেও আমার মনে হয়েছে, সব প্রশ্ন এড়ানোর এর চেয়ে ভালো আর কোনও উপায় ওনার হাতে ছিল না।

স্থায়ীভাবে দেশের সবচেয়ে বড় জুটমিল আদমজী বন্ধ করে দেওয়ার আগে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি হয়েছিল, কারখানাটি বন্ধ থাকলে যত লোকসান হতো, চালু থাকলে লোকসান হতো আরও বেশি। বন্ধ থাকলে শুধু কর্মীদের বেতন আর রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ খরচ হতো, কিন্তু চালু থাকলে কাঁচামাল এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য জিনিস ব্যবহার করে, বিদ্যুৎ খরচ করে তৈরি করা পণ্য বিক্রি করতে হতো বড় লোকসান দিয়ে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বর্তমান পরিস্থিতিকে আদমজী পাটকল পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা যায়। যাবতীয় সমালোচনার মধ্যে তিনি চুপ করে থাকাটা কোনোভাবেই ভালো না। এটা তার জন্য লস, নিশ্চিত। কিন্তু তিনি সমালোচনার জবাবে যখন কথা বলতে শুরু করেন, তখন কখনও ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করা একটা ফ্যাশন’ জাতীয় কথা বলে সবার আরও বেশি তোপের মুখে পড়েন। আর এবার তো জনগণের টাকার শ্রাদ্ধ করে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জবাব দিতে গিয়ে যা করেছেন, কথ্য ভাষায় এটাকে বলে ‘লেজেগোবরে করা’। তাই বলছি ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী আপনি দয়া করে চুপ থাকুন’ তাতে সমস্যা কমবে বৈ বাড়বে না। 

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলায় বিজয়ী হলেন যারা
কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলায় বিজয়ী হলেন যারা
কদমতলীতে গলায় ফাঁস লেগে দশ বছরের শিশুর মৃত্যু
কদমতলীতে গলায় ফাঁস লেগে দশ বছরের শিশুর মৃত্যু
জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত উৎসব শুরু আজ থেকে
জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত উৎসব শুরু আজ থেকে
আজিজ মোহাম্মদসহ ৯ জনের মৃত্যুদণ্ড চায় রাষ্ট্রপক্ষ, খালাসের দাবি আসামিপক্ষের
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাআজিজ মোহাম্মদসহ ৯ জনের মৃত্যুদণ্ড চায় রাষ্ট্রপক্ষ, খালাসের দাবি আসামিপক্ষের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ