X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চলচ্চিত্রে একাকার একান্ত বেদনা

জয়া আহসান
২১ জুলাই ২০২১, ১১:৪৯আপডেট : ২১ জুলাই ২০২১, ১৬:০১

জয়া আহসান জীবনের পুরো অহং কি আদৌ পার হওয়া সম্ভব? তাহলে তো নির্বাণ লাভ করেই ফেলতাম আমরা। ব্যক্তিগত আবেগের চাপই পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রবল। মানুষকে সহযোগিতার পথ, শিল্পকলার পথ কিংবা ভালোবাসার পথ হয়তো নিজের অহং ত্যাগ করে অন্যের কাছে পৌঁছানোর একটা উপায় করে দেয়। নিজের একান্ত গণ্ডি থেকে বৃহত্তর একটা জগতে আমাদের মুক্তি এনে দেয়।

আমার অভিনয় জীবনেরই একটা গল্প এই সূত্রে বলা যায় হয়তো বা।

কলকাতায় আমার প্রথম ছবি আবর্ত-এর কাজ শুরু হবে। মাসখানেক টানা শুটিং চলবে কলকাতায়, কিন্তু পুরো আনন্দটা মনে নিতে পারছি না। বাবা অসম্ভব অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। ছোট বোন কান্তার দায়িত্বে বাবাকে রেখে মাকে নিয়ে রওনা দিলাম কলকাতায়। মনটা মেঘলা হয়ে রইলো।

এ ছবিতে আমার চরিত্রের নাম চারু। ছবিতে ওর বাড়িটি দেখানোর জন্য নতুন তোলা একটি দালানের ১৯ তলার ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া হয়েছে। সেই ফ্ল্যাটটি তৈরি করে নেওয়া হয়েছে চারুর ফ্ল্যাটটি যে রকম দেখাতে পারে, সে রকম করে। নতুন সেই অ্যাপার্টমেন্ট হাউজে লিফট পুরোপুরি চালু হয়নি। প্রায়ই আমাদের হেঁটে হেঁটে ওপরে উঠতে হয়।

বাবার খোঁজ-খবর নিই। ছবির কাজও করি। বাবাকে নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো খবর পাই না। তাঁর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যেই ছবির কাজ আস্তে আস্তে শেষ দিকে চলে এলো।

একদিন শেষ দৃশ্যের শুটিং চলছে। আমি শট দিতে ব্যস্ত। এরমধ্যে কে একজন এসে আমার হাতে ফোন ধরিয়ে দিলো। খুবই নাকি জরুরি। ফোনটা ধরতেই কান্তার কান্না। কান্নার দমকে সে কথা বলতে পারছে না। কোনোমতে শুধু বললো, ‘জয়া আপু, বাবা নেই।’

শুনে আমার মাথা শূন্য হয়ে গেল। আমার শুটিংয়ের মধ্যেই বাবাকে চলে যেতে হলো? তাঁকে শেষ দেখাও দেখতে পারলাম না? মাকে এ খবর দেবো কী করে? বাবার কাছে তো আমাকে যেতেই হবে। কিন্তু এই ছবি? আমার চিন্তার খেই হারিয়ে যেতে লাগলো।

শুটিং স্পটেও ততক্ষণে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ছবি নিয়েও নিশ্চয়ই উদ্বেগে ভরে উঠেছে সবার মন। পরিচালক অরিন্দম শীল কাছে এসে খুব কোমল গলায় বললেন, ‘কিচ্ছু ভেবো না, জয়া। ছবির কাজ পরে দেখা যাবে। তুমি বাবার কাছে যাও।’

আমি ড্রেসিংরুমে গিয়ে আড়াল খুঁজছি। বুক ফেটে যাচ্ছে আমার। একা একা হাউমাউ করে কাঁদছি। মনের মধ্যে অলক্ষে অন্য একটা ভাবনাও কাজ করছে। আমি চলে গেলে এই ফ্ল্যাটটিও তো ছেড়ে দিতে হবে। আমি ফিরে আসার পর আবার ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিতে হবে। সবকিছু তৈরি করতে হবে নতুন করে। কত টাকাই বা বাজেট একটা বাংলা ছবির! প্রযোজক-পরিচালকের নাগালের বাইরে চলে যাবে তখন ছবিটা।

ধীরে ধীরে সামলে নিলাম নিজেকে। পরিচালককে এসে বললাম, অরিন্দমদা, শটটা কি আমি একবার দেওয়ার চেষ্টা করে দেখবো? বাবার মৃত্যুর ভার বুকে চেপে রেখে ক্যামেরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ক্যামেরায় ধরা পড়লো ছবির শেষ শট।

আমার ব্যক্তিগত আবেগ একাকার হয়ে গেলো একটি চলচ্চিত্রের দৃশ্যে।

শুরুতে যেমনটা বলছিলাম, নিজের অহংটাই তো বেশিরভাগ সময় ঘিরে রাখে আমাদের। অহংয়ের দেয়ালটা যত উঁচু হয়, ততই অন্যের সঙ্গে বড় হতে থাকে ব্যবধান। অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রধান পথটাই তখন হয়ে ওঠে অহং বৃত্তটাকে ছিঁড়ে ফেলা। এ বড় কঠিন কাজ। কিন্তু অহংটাকে ঝেরে ফেলার চেয়ে বড় ত্যাগ বা কোরবান বা স্যাক্রিফাইস আর কী হতে পারে! কথাটা বলা সহজ, কিন্তু নিজেকে পার হয়ে যাওয়াই কঠিনতম সাধনা এই মানব-জীবনে।

লেখক: অভিনেত্রী ও প্রযোজক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
স্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভস্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
বৈশাখী মেলায় গানের আয়োজন, কমিটির সঙ্গে দর্শকদের সংঘর্ষে নিহত ১
বৈশাখী মেলায় গানের আয়োজন, কমিটির সঙ্গে দর্শকদের সংঘর্ষে নিহত ১
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ