X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

জনপ্রতিনিধি ও জনপ্রশাসক

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২৫ আগস্ট ২০২১, ১৭:৫৩আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২১, ১৮:৫০

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

বরিশালে সমঝোতা হয়েছে। ওসি আর ইউএনও বদলি হয়েছেন। কেন্দ্রে সচিবালয়ের সদরে সবচেয়ে বড় আমলা মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলে দিয়েছেন, এ ঘটনায় বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সমিতি যে বিবৃতি দিয়েছে তা সচিবরা পছন্দ করেননি। অথচ এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন একজন সচিব এবং যেসব সচিব এটা পছন্দ করেননি তারা কোনও দৃশ্যমান উদ্যোগ নেননি এই বিবৃতি প্রত্যাহারের বা তাৎক্ষণিক কোনও প্রতিক্রিয়া দিতে।  

তবু স্বস্তি যে সমঝোতা হয়েছে। এবং এটাই কাঙ্ক্ষিত। তবে এসব কথাবার্তা উপরিতলের চিত্র। শাসন প্রণালির গভীরে এর রেখাপাত কতটা আঘাত রেখে গেছে তার হিসাব হয়তো একদিন হলেও হতে পারে। বরিশালের ঘটনা মিইয়ে যেতে না যেতেই আরেক সচিবের খবর এখন আলোচনায়। গণমাধ্যম রিপোর্ট করছে, করোনা আক্রান্ত হয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের করোনা ইউনিটে ভর্তি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক মাহমুদের মায়ের সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন এক উপ-সচিবসহ ২৪ কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের লিখিত নির্দেশনা দিয়ে তিন দিনের জন্য চার শিফটে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। ২৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্ব সমন্বয় করছেন সচিবের একান্ত সচিব আজিজুল ইসলাম। নির্দেশনায় বলা হয়, সচিবের মায়ের সার্বিক অবস্থা সার্বক্ষণিক জানাতে হবে পিএসকে, চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ, টেস্ট করানোর ও তা দ্রুত সংগ্রহ করা এবং হোয়াটসঅ্যাপে সচিবের পিএসকে রিপোর্টের কপি পাঠাতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে থাকতে হবে রোগীর কাছাকাছি, রোগীর অ্যাটেন্ডেনের কাছে জানান দিতে হবে কর্মকর্তাদের উপস্থিতি।

সচিব অস্বীকার করছেন। তবে বিষয়টি চমৎকার। আমরা জানি, সচিব যদি নাও বলে থাকেন, সরকারি বড় কর্তাদের বেলায় এমনটা হয়। কিছু মানুষ জানতে পারে, কিছু পারে না। তবে দেখে ভালো লাগল যে সচিবকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন খোদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম। তিনি বলেছেন, সচিবের করোনায় আক্রান্ত মাকে সহানুভূতি ও আবেগের জায়গা থেকে দেখতে গেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। মন্ত্রী সচিবের এমন বোঝাপড়া নিশ্চয়ই আমাদের উজ্জীবিত করে।

যদি প্রশ্ন করা হয়, সরকারি কর্মীর কর্তব্য কী? অ্যাকাডেমিক উত্তর হবে- দেশের মানুষের সেবা। বাস্তবে কাজটি সহজ নয়। সেবা বলে কোনও কিছু সরকারি দফতরের অভিধানে আছে বলে মানুষ এখন মনে করে না। গণতন্ত্রে মন্ত্রী, এমপি, মেয়র বা চেয়ারম্যানরা দেশবাসীর প্রতিনিধি। তাদের পরামর্শদান ও নির্দেশ পালনও সরকারি কর্মীদের কাজ। প্রশ্নটা হলো কে সরকারের প্রতিনিধিত্ব কীভাবে করে সেটা। সরকারি কর্মকর্তারা যখন একটা এলাকায় যান দায়িত্ব পালন করতে তখন তাদের মনোজগতে একটা ধারণা থাকে যে তারা সরকারের হয়ে কাজটা করতে যাচ্ছেন। কিন্তু সরকারটা যে পরিচালিত হয় জনগণের রায়ে (কেন্দ্র এবং প্রান্ত উভয় স্তরে) তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে, সেটা খুব কমই আচরণগতভাবে প্রকাশিত হয়।

সুশাসন মানে হলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে নির্ভয় ও নির্লোভ হয়ে কাজ করবেন আমলারা। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের কথা যেমন শুনবেন, তেমনি তাদের ভ্রান্ত যুক্তি ও অস্বচ্ছ চিন্তাকে প্রশ্ন করবেন তারা। জনপ্রতিনিধিদের সত্য কথাটি শোনাতে সরকারি কর্মীরা যেন দ্বিধা না করেন। এক কথায়, সরকারি কর্মী যেন কর্তব্য বিস্মৃত না হন।

আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দলও প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশে। সব প্রকার নির্দেশ বাস্তবায়িত হয় সরকারি কর্মীদের দ্বারা। কিন্তু কখন সমস্যা হয়, সেটা আমরা জানি। রাজনৈতিক নেতারা যদি নিজেদের মধ্যে বিবাদে ব্যস্ত থাকেন, যদি রাজনৈতিক চর্চার বাইরে অতিমাত্রায় ক্ষমতার চর্চা করেন, যদি বিশেষ বিশেষ সুবিধা আদায়ে আমলাদের ব্যবহার করেন, তাহলে আমলারাও নিজেদের জনগণের সেবক ভাবার পরিবর্তে রাষ্ট্রের মালিক ভাবতে শুরু করতে পারেন।  

জনগণের কল্যাণের দায়িত্ব যেহেতু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, তাই নীতি প্রণয়নের দায়িত্বও তাদের। বরিশালের মেয়র একজন স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি। যে ইউএও’র সঙ্গে এত ঘটনা ঘটলো, তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের একজন কর্মী। স্থানীয় সরকারের প্রান্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু নয়, খোদ রাজধানীতেও সিটি করপোরেশনকে কাজ করতে কেন্দ্রীয় সরকারের শত শত সংস্থার দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। এর বাইরে প্রতিটি জনপদে আছে এমপি বনাম মেয়র বা চেয়ারম্যান, চেয়ারম্যান বনাম ভাইস-চেয়ারম্যান, শাসক দলের নেতৃত্বের সংঘাত। এমন সংঘাতময় পরিস্থিতিতে আমলাদের যেমন কাজ করতে গিয়ে সমস্যাসংকুল চলতে হয়, রাজনৈতিক নেতৃত্বও জনগণের হয়ে নিজেকে আমলাতন্ত্রের সামনে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়।

সংকট হয় সেখান থেকে। বিরোধিতা করলে শুধু বিরাগভাজন হতে হবে এমন নয়, পেশাদারিত্ব নিয়েও প্রশ্ন ওঠে, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নেতারা জনগণকে মিথ্যা আশ্বাস দিলে জনসমক্ষে তার বিরোধিতা করার ক্ষমতা কতজন আমলার আছে? অনেক আমলাই বলেন, এমনকি ন্যায়বহির্ভূত, আইনবিরোধী নির্দেশও মান্য করতে বাধ্য হতে হয় সরকারি কর্মীদের। পদস্থ আমলাকে নিজের কর্তব্য করবার জন্য তিরস্কৃত বা পদচ্যুত হবার ঘটনাও কম নয়।  

আবার এমন অনেক কথাও জানি, যেখানে জনপ্রতিনিধিরা নিয়মিত উপেক্ষিত ও অপমানিত হচ্ছেন আমলাদের দ্বারা। আমলাতন্ত্রের অচলায়তন কীভাবে জনপ্রতিনিধিদের ভালো ভালো উদ্যোগ নস্যাৎ করে সেটাও জানা সবার। বাইরে আনুগত্যের অভিনয় করে কার্যত সরকারি প্রক্রিয়ার জটিলতার ফাঁদে জনপ্রতিনিধিদের আটকাতে আমলাদের জুড়ি নেই। ক্ষমতার দম্ভে নাগরিকের প্রতি সরকারি কর্মীর দুর্ব্যবহার এবং উদাসীনতার দৃষ্টান্তও ভূরি ভূরি।

তবু দিন শেষে নীতি ও সেবা-পরিষেবার জন্য সরকারি কর্মীর ওপরেই নির্ভর করতে হয়। তার সততা, দক্ষতা ও সাহস গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড। ক্ষমতার নিকট তিনি ঝুঁকে পড়লে দেশ দাঁড়াতে পারে না। সরকারি দফতরগুলোর অভ্যন্তরে নৈতিক জোরটি বজায় না রাখলে গণতন্ত্র দুর্বল হবে। এ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে পরিচালিত সৎ ও দক্ষ আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। এভাবেই গড়ে উঠতে পারে ‘জনপ্রতিনিধি’র অধীনে ‘জনপ্রশাসক’।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
উপজেলা নির্বাচন: ওসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
উপজেলা নির্বাচন: ওসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ