পরিবারতন্ত্রের অমোঘ অনুশাসনগুলো নিজে থেকেই যেন কাজ করে। হয়তো পরিবারের প্রধানরা নিজেরাও তা জানতে পারেন না। পরিবারের সদস্যরা কী এক অদ্ভুত কারণে প্রধান ব্যক্তির ন্যায়-অন্যায় সব সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। আমাদের দেশের প্রধান দলগুলোরও তেমন পারিবারিক মালিকানা আছে। পরিবারের প্রধান ব্যক্তির মতো এ দলগুলোতেও প্রধান ব্যক্তি যুগপৎ কূটকৌশল ও দৃঢ়চিত্ততার পরিচয় দিয়ে দলে এবং দলের বাইরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ক্রমশ কুপোকাত করে রাখেন। এই সংস্কৃতি অনেক দিনের লালিত।
এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টির সাম্প্রতিক ঘটনাবলী আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে দলের মালিকানা আসলে দিনশেষে প্রধান ব্যক্তি আর তার পরিবারের হাতে, বাকিরা কর্মচারী মাত্র।
আরেক বড় দল বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে, আসছে মার্চ মাসে কাউন্সিল হবে, নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে। নতুন নেতৃত্ব মানে বেগম খালেদা জিয়া এবং তার পুত্র তারেক রহমান ছাড়া ভাবতে হবে। ভারপ্রাপ্তের ভার সরে গিয়ে আপাতত দলের পূর্ণকালীন মহাসচিব হতে পারেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কিন্তু দলে যা গঠনতন্ত্র, তাতে খালেদা জিয়ার এক কলমের খোঁচায় চলে যেতে পারে যে কারও পদ।
আওয়ামী লীগেও শেখ হাসিনার সুস্পষ্ট আধিপত্য আছে। তবে তার গঠনতন্ত্রে দলীয় প্রধানকে বিএনপি, জাতীয় পার্টির মতো একচেটিয়া ক্ষমতা দেওয়া নেই।
আমরা প্রায়ই শুনি দলগুলো বলছে, দলকে মানুষের কাছাকাছি নিতে হবে। কিন্তু তা করার জন্য সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কাজকর্ম নিয়ে দলের বাইরের মানুষজনকে কি প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হয় আমাদের দেশে? হয় না। প্রায় প্রতিটি দলের প্রচার সেল আছে, প্রকাশনা আছে। কিন্তু সেসবে সাধারণ নাগরিক এবং দলের বাইরের মানুষের অংশগ্রহণ কোথায়?
সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কাজকর্ম শুধু নয়, দলের তাত্ত্বিক ভিত্তি, আদর্শ নিয়ে কোনও অপ্রিয় প্রশ্নের উত্তর দিতে চায় না আমাদের দলগুলো। চিত্তের এমন দারিদ্র্য যে শুধু ক্ষমতালিপ্সু বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের তা নয়, যারা বাম রাজনীতি করেন, দিনভর অন্যদের গালমন্দ করেন, তারাও দেন না এমন উত্তর। সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে তত্ত্ব আজও আমাদের বামেরা দিয়ে চলেছেন তার প্রতি কতটা আগ্রহ মানুষের, তা তারা জানতে চেয়েছেন কোনওদিন? এমনকি বাংলাদেশের একটি বড় বাম দলেও একই পরিবারের বহুজন আছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে।
প্রশ্ন হলো পরিবারতন্ত্র মানেই কি খারাপ? বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলি বা ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায় সে দেশের কোনও এক রাজনৈতিক নেতা আপন যোগ্যতায় সে দেশের জনগণের কাছে নেতা হিসাবে স্বীকৃতি পেলে তার সন্তান সেরকম না হলেও কিছুটা যোগ্যতা থাকলে তাকেও জনগণ নেতা মেনে নেয়। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশে শেখ হাসিনা, কিংবা খালেদা জিয়া তাদের স্ব স্ব দলের কর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তাদের জনভিত্তি কতটা শক্তিশালী, তাও এদেশের মানুষ দেখেছে ১/১১ এর সময়।
আলোচনাটা শুরু হয়েছিল এরশাদ দিয়ে, সেখানেই রাখতে চাই। এরশাদের জাতীয় পার্টিতে তিনিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, কারণ এই দলের জন্ম দিয়েছেন তিনি, লালন পালন করছেন তিনি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এরশাদ জীবিত থাকতেই মালিকানার অতিরিক্ত প্রকাশ এই দলকে উপহার দিয়েছে কয়েকদফা ভাঙন। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় দলটি। ১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে এরশাদ যখন চারদলীয় জোট গঠনের জন্য বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে যোগ দেন, তখন জাপার একাংশ একই নাম নিয়ে একটি স্বতন্ত্র দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আবার নীতি নির্ধারণে মতানৈক্যের কারণে ২০০১ সালে নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে এরশাদ নেতৃত্বাধীন অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) আত্মপ্রকাশ করে এবং বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোটের সঙ্গে থেকে যায়। সেখানেই শেষ নয়- ২০১৪ সালে আবার এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির একটি ভগ্নাংশ কাজী জাফরের নেতৃত্বে নবজন্ম লাভ করে এবং ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। আছে আনোয়ার হুসেইন মঞ্জুর নেতৃত্বে আরও একটি অংশ।
বহুধাবিভক্ত শাখা-প্রশাখাগুলো বাদ দিলেও, দলের সাম্প্রতিক টানাপড়েন যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে মনে হবে, এই দলে, আওয়ামী লীগপন্থী গ্রুপ আছে, বিএনপিপন্থী আছে, জাতীয় পার্টিপন্থী হয়তো একমাত্র এরশাদই। সহোদর ভাই এবং নিজের স্ত্রীর মধ্যকার নিত্যনতুন দ্বন্দ্ব মেটাতে পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদের মেধা কর্ষিত হয় অনেক বেশি সময় ধরে। আওয়ামী লীগের গত টার্মে এরশাদের ভাই জি এম কাদের ছিলেন মন্ত্রিসভায়। তখন মনে হতো বেগম রওশান এরশাদ অনেক বেশি প্রো-খালেদা, এখন যেটা এরশাদ বা জি এম কাদেরকে মনে হয়। কারণ এখন রওশন এরশাদ সরকারি আনুকূল্যে সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী।
দলের মালিকানা নিয়ে পারিবারিক কলহের এ পর্যায়ে রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীরা চাইছেন জাতীয় পার্টির মূল ক্ষমতার সুতাটা নিজের হাতে রেখে সরকারের কাছে থাকতে। আর জিএম কাদের চাইছেন জাতীয় পার্টির নিয়ন্ত্রণ এবং পরবর্তীতে উত্তরাধিকার তার হাতে রেখে দিতে। আর এজন্য তিনি ভাইকে দিয়ে রওশন এরশাদসহ তার দলের মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের বের করে আনতে। তবে একটি বড় কাগজে জি এম কাদেরের সাক্ষাৎকার পড়ে মনে হলো মন্ত্রিত্ব দিলে তিনিও না করবেন না।
জাতীয় পার্টির পরস্পরবিরোধী অংশ দুটোর এই ঠাণ্ডা লড়াই সরকার কেন্দ্রিকই। এরশাদ একটা কথা বারবার বলছেন, সত্যিকারের বিরোধী দল হতে চায় তার দল। তা যদি তিনি আসলেই চান তাহলে তাকে রাজনৈতিক হঠকারিতা থেকে সরে আসতে হবে। অন্যের দ্বারা প্ররোচিত না হয়ে, জাতীয় পার্টির অস্তিত্বের স্বার্থে দলকে ঢেলে সাজাতে চাইলে নিশ্চয়ই তিনি কিছুটা ফল পেতে পারেন। তবে রাজনৈতিক স্টান্টবাজি করলে জীবদ্দশায় হয়তো এ দলের হারিয়ে যাওয়া দেখবেন এরশাদ। পরাস্ত, ক্লান্ত, বিভ্রান্ত বিএনপির স্থলে বহুধাবিভক্ত দ্বন্দ্বমুখর জাতীয় পার্টি সত্যিকারের বিরোধী দলের আসন পাবে না যা এরশাদ চিৎকার করে বলছেন।
লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টেলিভিশন