X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যবিত্তের ভয়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২২ জুন ২০১৬, ১২:২৬আপডেট : ২২ জুন ২০১৬, ১২:৩৬

ইশতিয়াক রেজাবাঙালির ড্রয়িং রুমে এখনকার আলোচনা ক্রসফায়ার। পরপর দু’দুটি ঘটনায় আলোচনা তুঙ্গে এখন টেলিভিশনের পর্দায়ও। আর সামাজিক মাধ্যমে ঝড়। এ পর্যন্তই। তারপর নতুন বিষয় আসলে এটা ভুলে যাওয়া হবে। চক্রাকারে এমন চলতে থাকে। কাজের কাজ কী হয় তা তারাও জানেন না।
মধ্যবিত্ত শান্তি, স্থিতি আর সৌজন্যতা চায় সমাজে। সেজন্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সে অংশ নেয়, ভোট দেয়, মিছিল করে, কথা বলে। এসব পুরোনো কথা। এখন আর এমন করে ভাবা হয় না। কারণ প্রশ্ন উঠছে দিন শেষে এসব ভূমিকার মূল্য আছে কি আদৌ? যে মধ্যবিত্ত সাহসের কথা জোর দিয়ে বলতে পারতো, সে আজ ভয়ে থাকে। গণতন্ত্র আনতে লড়াই করেছে ঐক্যবদ্ধ হয়ে। স্বৈরাচার পতনের পর গণতন্ত্রের জামানা শুরু হওয়ার পর থেকে মধ্যবিত্ত কেবল বিভাজিত হচ্ছে। আর যত সে ভাঙছে, ততই তার ভয় বাড়ছে।
মধ্যবিত্ত এখন ভয় পায় ক্রসফায়ারকে, চাপাতিকে। কিন্তু তারচেয়ে বেশি ভয় পায় খোলা মনোভাব প্রকাশে। তবে কি মানুষ আসলে গণতন্ত্রকেই ভয় পেতে শুরু করেছে? গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থায় নেতা নির্বাচন থেকে শাসন ব্যবস্থার ধরন সব মানুষের মন মতো হয় না। তবুও এতেই আস্থা থাকে মানুষের। মধ্যবিত্ত সব রাজনীতিই করেছে, কিন্তু কখনোই এই সমাজ অতি ডান কিংবা অতি বাম, কোনওটিকেই ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেনি।
আজ যারা কোপাকোপির রাজনীতি করছে তারা জয়ী হবে না ঠিকই, কিন্তু সমাজে ভয়ের সংস্কৃতিকে প্রসারিত করছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি প্রসারিত করছে বিভাজনকে। এবং আরও বেশি নামিয়ে আনছে রুচিবোধকে। যে বাঙালি মধ্যবিত্ত আজীবন সেক্যুলার সংগঠন করেছে, মাঠঘাট দাপিয়ে বেরিয়েছে, তার মুখে আজ চরম সাম্প্রদায়িক উক্তি। যে মানুষ মানবাধিকার নিয়ে সবসময় উচ্চকিত থেকেছে, সে আজ ‘বন্দুকযুদ্ধের গল্প’কে বিশ্বাস করে।

কারণ হলো ভয়। সে ভয় পায় মৃত্যুকে। তার চেয়ে বেশি পায় তার আরামকে। কোনও না কোনওভাবে অর্থ সংগ্রের মাধ্যমে সে এখন আরাম প্রিয় শ্রেণি।

গণতন্ত্র আসার পর যে প্রত্যাশা ছিল তা বাস্তবায়িত হয়নি। একটি নির্বাচিত সরকার এসেছে আর আমাদের রাজনীতি ও প্রশাসন বেশি করে দুর্নীতি আর অন্যায়প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। মধ্যবিত্তের যে অংশটি এই নতুন প্রথার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে নিতে পেরেছে ততই তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আরাম বেড়েছে আর তার মূল্যবোধ ততই দূরে চলে গেছে।

ক্ষমতা ও পেশি শক্তির ওপর রাজনীতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় নির্বাচনি ব্যবস্থায়ই এখন রক্তাক্ত। এই রাজনীতির কৌশলটা খুব অদ্ভুত। তার এখন কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী লাগে না। আড়ম্বর, লোক দেখানো ধুমধাম, সামন্ত-সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে চলে নিজের লোককেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলবার আয়োজন। এ সবই আসলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে লুকোনো গভীর দ্বন্দ্ব।

আমাদের গণতন্ত্র যেমন এক দিকে ব্যক্তিস্বাধীনতা, পারিবারিক শাসন ও সামন্ত সংস্কৃতি, আর অন্য দিকে আধুনিকতার স্বপ্ন, আধুনিক জীবনযাপনের ইচ্ছা, প্রযুক্তি ইত্যাদির মধ্যে দ্বন্দ্বের মঞ্চ, ঠিক তেমনই, সাধারণের মাঝে ভয় ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পিত আয়োজন। উদ্দেশ্য সব অন্যায় বিনা বাধায় করে নেওয়া।

একটা অদ্ভূত অবস্থা তৈরি হয়েছে। দ্রুত গতিতে রাজনীতিতে অজ্ঞাত অর্থ ঢুকছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির কাঠামোটি ভেঙে অর্থ নির্ভর হয়ে পড়েছে সবকিছু। এই টাকার বেশির ভাগটাই দুর্নীতি-প্রসূত অর্থ। নেতাদের পকেটে এই টাকা ঢুকছে মানে রাজনীতির মধ্যে একটা মেকি ফাঁপানো সাচ্ছল্য তৈরি করা হচ্ছে, বাস্তবের থেকে অনেক গুন ফাঁপানো! রাজনৈতিক নেতারা এবং তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ, সকলে মিলে এই অজ্ঞাতকুলশীল অর্থভাণ্ডারে পুষ্ট হচ্ছে, এবং এই ভাণ্ডারের জোরেই নেতাদের বাড়ি গাড়ি হচ্ছে বিদেশের মাটিতে। দলের সমর্থন-ভিত্তির মধ্যে যে বিশালাকার মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং ক্ষমতালোভী কর্মী-সমর্থকের দল, সকলের জন্যই এই কৌশল শেষ পর্যন্ত বেশ ফলপ্রসূ। মধ্যবিত্তের একটা অংশও এই অর্থের ভাগ পেয়ে এখন অন্যরকম দিশেহারা। সুবিধা নেওয়ার চরিত্র হলো সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকা।

বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ প্রগতিশীল কিংবা লিবারাল ভাবধারার বাহক। এটাই জানা ছিল। কিন্তু অর্থ আর পেশিমক্তি রাজনীতি তা সরিয়ে নিয়েছে। এদেশের গণতন্ত্রের মধ্যে যে গভীরচারী দ্বন্দ্ব, যেখানে সামন্ত সংস্কৃতির অপার মোহ ও আধুনিক জীবনযাপনের অদম্য আকর্ষণ, এই দুই-এর দ্বন্দ্বের উৎস কিন্তু এই শ্রেণির মধ্যেই। এদের দিকে তাকিয়েই এই নতুন রাজনৈতিক কৌশল নির্মাণ। এদেরই হাতে সেই নব্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভরণপোষণের সমস্ত ভার, যেখানে হত্যার বদলাতো হত্যাই হয়, বিচার নয়।  

গণতন্ত্র আসলে রাজনীতি একদিন সমাজকে উত্তরণের পথে নিয়ে যাবে, মানুষের কিছু পরিবর্তন আনবে, এমনই ভাবা  হয়েছিল। কিন্তু এই নতুন ধারা স্পষ্ট দেখিয়ে দিচ্ছে, আমাদের রাজনীতিতে আসলে ঘটছে উল্টোটাই। রাজনীতি কথাটির আসল অর্থ হচ্ছে ‘চুপ করে থাকো, বিচার চাও কেন?’ কলেজ ছাত্রী তনুর মাকেও সেই শাসনই করছে রাজনীতি।  

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি    

আরও পড়তে পারেন: ক্রসফায়ার এক, গ্রেফতার এক, বাকি চারজনের অবস্থান কোথায়

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানাতে গিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ
ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানাতে গিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ
শান্ত-লিটনদের ব্যাটিং দেখে ভয় হচ্ছে বিসিবি সভাপতির
শান্ত-লিটনদের ব্যাটিং দেখে ভয় হচ্ছে বিসিবি সভাপতির
প্লে অফের দিন বেছে নিতে দুই ক্লাবকে চিঠি
প্লে অফের দিন বেছে নিতে দুই ক্লাবকে চিঠি
সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রাজনৈতিক মামলা
অরাজনৈতিক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশসিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রাজনৈতিক মামলা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ