X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

সৌদি মেয়েটিকে অভিনন্দন

তসলিমা নাসরিন
১৪ আগস্ট ২০১৬, ১৬:৪২আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০১৬, ১৬:৪৬

তসলিমা নাসরিন কী চমৎকার দৃশ্য এটি। করিমন আবুলজাদায়েল দৌড়োচ্ছেন অলিম্পিকের দৌড় প্রতিযোগিতায়। তিনিই প্রথম সৌদি আরবের মেয়ে যিনি এই অলিম্পিকের ১০০ মিটার দৌড়ে অংশগ্রহণ করেছেন। অন্য দৌড় প্রতিযোগিদের মতো কিন্তু তিনি দেখতে নন। তিনিই একমাত্র প্রতিযোগী, যিনি হিজাব পরেছেন, সারা শরীর ঢেকেছেন কালো কাপড়ে। অন্যরা যত হালকা করা যায় শরীর করেছেন, যত কম পোশাক পরা যায় পরেছেন, কারণ এটিই নিয়ম। ভালো দৌড়োতে গেলে শরীরে খুব বেশি পোশাক চাপাতে হয় না। ২০১২ তে সারা আত্তার নামে একজন সৌদি মেয়ে অলিম্পিকের  ৮০০ মিটার দৌড়ে অংশ নিয়েছিলেন। সারাও সারা শরীর কাপড়ে ঢেকে দৌড়েছিলেন। সারার পর এলেন করিমন। করিমন একশ’ মিটার দৌড় শেষ করেছেন ১৪.৬১ সেকেন্ডে। বিশ্ব রেকর্ড ১০.৪৯ সেকেন্ডের। অলিম্পিকের ফাইনালে দৌড়োবার সুযোগ হারিয়েছেন করিমন। কিন্তু চেষ্টা যে করেছেন, এ-ই অনেক।
অস্ট্রেলিয়ার দৌড়বিদ ক্যাথি ফ্রিম্যানও কিন্তু দৌড়ের সময় সারা শরীর ঢাকে এমন পোশাক পরে নিতেন। কোনও ধর্মের কারণে তিনি ওই পোশাক পরেননি। করিমন মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে রাখছেন ধর্মের কারণে। তাঁর দেশে এভাবেই বেঁচে থাকতে হয়। ঘর থেকে বাইরে বের হলে বোরখায় আপাদমস্তক ঢাকতে হয়। শুধু চোখ আর হাত অনুমতি পায় বোরখার বাইরে থাকার। অলিম্পিকে অন্তত করিমনের, সারার এবং সৌদি আরবের আরও দু’একজন হিজাবি মেয়ের মুখমণ্ডল আমরা দেখতে পেলাম। সারা আত্তার থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। ওখানেই জন্ম সারার। সৌদি আরব এবং যুক্তরাষ্ট্র– দু’দেশের নাগরিক তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে সারা বোরখা বা হিজাব পরেন না। কিন্তু অলিম্পিকে হিজাব পরে আসতে হলো, কারণ সৌদি সরকার জানিয়ে দিয়েছে, যে মেয়েরা সৌদি আরবের হয়ে অলিম্পিকে অংশ নেবেন, সবাইকে ওরকম গা ঢাকা পোশাক পরতে হবে। ওয়েবসাইট থেকেও ডিলিট করে দিতে হবে ওদের বোরখাহিজাবহীন ছবি। কী অদ্ভুত দেশ! এমন একটি দেশ পৃথিবীতে বহাল তবিয়তে টিকে আছে, ভাবলে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
সৌদি আরব মেয়েদের অলিম্পিকে যেতে দেয়নি এতকাল। ২০১২ সালে সবে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়েছে। নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই সৌদি মেয়েরা অলিম্পিকে আসছেন। করিমনের ১০০ মিটার দৌড়ের সময় জামা উঠে গিয়ে পেটের খানিকটা দেখা যাচ্ছিল। তা দেখে, শুনেছি মানুষ আশংকা করছে, এ কারণে সৌদি আরবে করিমনের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হবে না তো! তাকে চাবুক মারা হবে না তো!  পাথর ছুড়ে হত্যা করা হবে না তো! আশংকাগুলো যে একেবারেই অমূলক তা বলবো না। ধর্ষিতা মেয়েদেরই তো জেলে ভরা হয়, চাবুক মারা হয়।
সৌদি আরব দেশটি মেয়েদের জন্য ভীষণ ভয়ংকর। মেয়েদের জন্য তো বটেই, যে কোনও মুক্তচিন্তকের জন্যেও। সৌদি আরবের মুক্তচিন্তক রাইফ বাদাভি’র সৌদি স্ত্রী এনসাফ হাইদার এখন ছেলেমেয়ে নিয়ে কানাডায় আছেন। তিনি পরেন সার্ট আর শর্টস। সৌদি আরব থেকে বের হয়ে অধিকার সচেতন সৌদি মেয়েরা প্রথমেই বোরখা খুলে ফেলেন এবং যত কম পোশাক সম্ভব পরে নেন। মেয়েরা মনে হয় হাফ ছেড়ে বাঁচেন। এনসাফের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, কানাডা তাঁর কাছে জান্নাতের মতো। সৌদি আরব থেকে কত মেয়েই যে বেরোতে চান! যদি সুযোগ থাকতো, আমার মনে হয় না খুব বেশি মেয়ে সৌদি আরবের স্বাধীনতাহীন জীবনে পড়ে থাকেতেন! প্রায় সকলে বেরিয়ে আসতেন। মাঝে মাঝে আমি অবাক হই কিছু জরিপের ফল দেখে। জরিপে দেখা যায়, অধিকাংশ সৌদি মেয়েই মেয়েদের গাড়ি চালানোর বিরুদ্ধে, অধিকাংশ মেয়েই পুরুষ অভিভাবকের অধীনে বাস করতে আগ্রহী। জরিপগুলো সঠিক জরিপ কী না কে জানে।

সৌদি আরব থেকে যারা অলিম্পিকের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন, তাদের প্রায় সবার ট্রেনিং হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। নিশ্চয়ই সেখানে কেউই হিজাব পরে ট্রেনিং করেননি। ট্যাংক টপ আর শর্টস পরেই করেছেন। শুধু সৌদি আরবের ভয়ে হিজাব পরে নিয়েছেন। হিজাব না পরার শাস্তি ভয়াবহ হবে বলেই পরে নিয়েছেন। আমার বড় বিস্ময় জাগে, সৌদি আরবের মতো একটি দেশের সঙ্গে পৃথিবীর পশ্চিমা দেশগুলোর এত মাখামাখি কেন! শরিয়া আইনের কারণে মেয়েরা সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত। আত্মীয় নয় এমন কোনও পুরুষের সঙ্গে কোথাও যাওয়া চলবে না, কথা বলা চলবে না, অর্থাৎ নারীপুরুষের মেলামেলা নিষিদ্ধ। ধরা পড়লে মৃত্যুদণ্ড-- এমন ফতোয়াই দিয়েছেন সৌদির ধর্মগুরু শেখ আবদুল রহমান আল বারাক। নারী পুরুষ মেলামেশা না করলে নারী পুরুষের মধ্যে প্রেম কী করে হয় ওদেশে! নাকি দেশটিতে প্রেম নিষিদ্ধ। যে দেশে প্রেম নিষিদ্ধ, সে দেশটি কী রকম বর্বর—তা অনুমান করতে পারি। সৌদি আরবই পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যে দেশে মেয়েদের গাড়ি চালানো নিষেধ। ১৪৫টি দেশের মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্যে সৌদি আরব ১৩৪তম।

সৌদি আরবের আইনে মেয়েদের একা থাকা, একা চলা চলবে না। একজন পুরুষ অভিভাবক মাস্ট। পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া, বিয়ে করা, তালাক দেওয়া, দেশের বাইরে যাওয়া, পড়াশোনা করা, চাকরি বাকরি করা, ব্যবসা বাণিজ্য করা, ব্যাংক একাউন্ট খোলা, শরীরে অস্ত্রোপাচার করা- সব হারাম, নিষিদ্ধ। ওই ভয়ংকর নারী বিদ্বেষী দেশটি থেকে এসে করিমন দৌড়েছেন। পৃথিবীর সবাই দেখেছে করিমন দৌড়োচ্ছেন। তিনি এই পৃথিবীর মেয়ে, তারও দৌড়োনোর অধিকার আছে। প্রতিযোগিতায় হেরেছেন তিনি, কিন্তু নিজের দৌড়োনোর অধিকারকে তো প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই বা কম কী।

ধীরে ধীরে তীব্র সমালোচনার কারণেই হয়তো সৌদি সরকার মেয়েদের বন্দিত্ব শিথিল করছে। মেয়েরা নাকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভোট দিতে পারবে। রাজতন্ত্রে আবার ভোট! কিন্তু তারপরও যদি মেয়েরা রাজনীতি করার, ভোট দেওয়ার কোনও রকম অধিকার পায়, তবে আশা করা যায় ধীরে ধীরে মেয়েরা তাদের আরও অধিকার ফেরত পাবে। প্রাক-ইসলাম যুগে মেয়েদের যে স্বাধীনতা ছিল সেই স্বাধীনতাটুকু ফেরত পেলে তো অনেক পাওয়া হয়। আরবে ইসলাম আসার আগে মেয়েদের অধিকার যে এখনকার চেয়ে অনেক বেশি ছিল, তা মহানবী (স.)-এর প্রথম স্ত্রীর জীবন কাহিনী পড়লেই জানা যায়। তিনি নিজে ব্যবসায়ী  ছিলেন, সহায় সম্পত্তি নিজের নামে ছিল, বাবা এবং স্বামীর মৃত্যুর পর তাদের সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন, নিজে শিক্ষিত ছিলেন, নিজের পছন্দে বিয়ে করেছেন। আজকের যুগে সৌদি আরবের কোনও মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয় তার মতো অধিকার এবং স্বাধীনতা ভোগ করা।

সৌদি আরব কোনওদিন নিজেকে শোধরোতে চেষ্টা করবে না যদি না মানুষ এর আইনের এবং নারীবিরোধের নিন্দা না করে। নিন্দা চলুক। অসভ্য দেশটির সঙ্গে যে সভ্য দেশগুলো মাখামাখি সে দেশগুলোকেও ধিক জানানো হোক। করিমনরা অলিম্পিকে অংশ নিতে থাক। আজ করিমনরা হিজাব পরে অলিম্পিকে দৌড়োচ্ছে, একসময় করিমনদের হিজাব পরে দৌড়োতে হবে না। স্বপ্ন দেখি সৌদি আরব সভ্য হয়েছে, সৌদি মেয়েরা সমানাধিকার পাচ্ছে। এমন দিন আসবে বলে অনেকে বিশ্বাস করে না, কিন্তু এমন দিনকে আসতেই হবে। অত্যাচার, নির্যাতন, বর্বরতা, অসভ্যতার একটা সীমা আছে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন আর সমানাধিকারে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, মানুষ সুশিক্ষা পাচ্ছে, সচেতন হচ্ছে, মুক্তচিন্তাকে সমর্থন করছে। নারীকে যৌনবস্তু ভাবার দিন শেষ হবেই। যেদিন শেষ হবে, সেদিনই হবে নারীবিদ্বেষী মানুষের বিরুদ্ধে সমানাধিকারে বিশ্বাসী মানুষরে জয়। সভ্যতার জয় হবেই।

সৌদি আরবে রাইফ বাদাভিদের সংখ্যা বাড়বে। আজ রাইফ বাদাভি একজন। একজন জেলে। একজন চাবুকের মার খাচ্ছে। সৌদি আরবে জেলের সেলের সংখ্যার চেয়ে, চাবুকের সংখ্যার চেয়ে মুক্তচিন্তক রাইফ বাদাভিদের সংখ্যা বেশি হবে। একদিন শরিয়া আইন বদলে সৌদি আরবে সভ্য আইন আসবে। একদিন মেয়েরা রাস্তাঘাটে প্রেম করবে, যে পোশাক পরতে তাদের ইচ্ছে করে, সে পোশাকই পরবে। মেয়েদের হেনস্তা করার জন্য কোনও ধর্ম পুলিশ বলে কিছু থাকবে না কোথাও। দিনটি আসতে যদি দেরি হয় হোক, তবু দিনটি আসুক। 

লেখক: কলামিস্ট

আরও পড়তে পারেন: জাতির জনকের স্মৃতি ও সংগ্রামমুখর দিনগুলো

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছেলেবেলার ক্লাবের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন রোনালদো
ছেলেবেলার ক্লাবের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন রোনালদো
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে নাটকীয় উন্নতি হয়েছে: ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে নাটকীয় উন্নতি হয়েছে: ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
মুক্তিযোদ্ধাকে মারধর, আ.লীগ নেতার ভাগনে কারাগারে
মুক্তিযোদ্ধাকে মারধর, আ.লীগ নেতার ভাগনে কারাগারে
ইন্দোনেশিয়ার রুয়াং আগ্নেয়গিরিতে আবারও অগ্ন্যুৎপাত,সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি
ইন্দোনেশিয়ার রুয়াং আগ্নেয়গিরিতে আবারও অগ্ন্যুৎপাত,সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ