X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্যুময় চিরহরিৎ

শুভ কিবরিয়া
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৭:৫৩আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৭:৫৭

শুভ কিবরিয়া আমরা জীবনের গল্প শুনতে ভালোবাসি, মৃত্যুর নয়। মৃত্যু জীবনবাদী কোনও বিষয় নয়। মৃত্যু মানে চির অবসান, মৃত্যু মানে পরিসমাপ্তি। ধর্মের হিসেবে পরকাল আছে কিন্তু তা তো ইহজাগতিকতা নয়। সেটা পারলৌকিকতা। কাজেই বাস্তবের জগৎ থেকে কেউ অকারণে হারিয়ে গেলে, তার ক্ষতি অপরিসীম। হিসাবের খাতা শূন্য করে হঠাৎ কেউ চলে গেলে, তা আমাদের বেদনামথিত করে। আমরা দুঃখ পাই, যন্ত্রণা সই। তার অভাব আর পূরণ হয় না।
কিন্তু যে মৃত্যু হিসাবের নয়, যা পরিসংখ্যানের অংককে বড় জায়গা দেয়, সেই মৃত্যুর বদলা আমরা কেমন করে নেব? যে মৃত্যু স্বাভাবিক নয়, যে মৃত্যু পরিণতি পাওয়ার আগেই সংঘটিত হয়, তাকে আমরা কেমন করে মেনে নেব? দেশে জঙ্গিবাদী হামলায় যে প্রাণ গেছে, তা আমাদের জাতীয় চিন্তাকে নাড়া দিয়ে গেছে। এই অসহ্য মৃত্যুময় যন্ত্রণাকে কিভাবে মোকাবিলা করা যায়, তার চেষ্টায় গোটা জাতি এখন উৎকণ্ঠিত।  সে কারণেই জঙ্গিবাদী প্রক্রিয়ার শেকড় উৎখাত করতে গোটা রাষ্ট্র মনোসংযোগ করছে। করা উচিত, কেননা আমরা জীবনকে চাই। সন্ত্রাসে, ব্রেনওয়াশে আমরা মানুষের মৃত্যু দেখতে চাই না। আমরা মানুষের জীবনের জয়গান চাই। অস্ত্রহাতে ভুলপথে অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাসে কারও জীবনহরণ আমরা দেখতে চাই না। জঙ্গিবাদী হিংসায় মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার এই মৃত্যুপরিণতি আমাদের কাঙ্ক্ষিত নয়।
দুই.
কিন্তু কিছু অবাঞ্চিত মৃত্যুর খবর কি আমরা রাখি? ২০১২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১০ হাজার লোক আত্মহত্যা করে। ২০১৫ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিসেবে এই আত্মহত্যার সংখ্যা বছরে ১৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৩ সালে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের গবেষকরা মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে জানতে পারেন, যারা আত্মহত্যা করেছেন তাদের ৫৫ শতাংশের পরিবারের মাসিক আয় ৪ হাজার টাকার নিচে। এদের মধ্যে ১৪ শতাংশের পরিবারের মাসিক আয় ২ হাজার টাকার নিচে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আত্মহননকারীদের বড় অংশ কৃষিকাজ বা পারিশ্রমিকবিহীন কাজের সঙ্গে যুক্ত। তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ নারী ও গৃহবধূ।
বছরওয়ারি আত্মহত্যার যে তথ্য মিলেছে তাতে দেখা যায়, বছর বছর এই প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী। পাঁচ বছরের এক ডাটা বলছে, ২০১১ সালে ৯ হাজার ৬৪২ জন, ২০১২ সালে ১০ হাজার ১০৮ জন, ২০১৩ সালে ১৬ হাজার ২৮৮ জন, ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৭১৭ জন, ২০১৫ সালে ১৭ হাজার ৬২৩ জন আত্মহত্যা করেছে। বাংলাদেশ পুলিশের তথ্যমতে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত পাঁচ বছরে এই আত্মহত্যার বাড় বেড়েছে শতকরা প্রায় ৮৩ শতাংশ। অঙ্কের হিসেবে এই মৃত্যুহার ভয়ঙ্কর। কী হচ্ছে এসব মানুষের মনে? কেন তারা জীবনসংহারের এই খেলায় নামছে? কেন তারা সম্ভাবনাময়  জীবনকেই ধ্বংস করছে স্বেচ্ছায়?

তিন.

মাঠ পর্যায়ের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে জেলাওয়ারি আত্মহত্যার পরিসংখ্যানে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ঝিনাইদহ। স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্যমতে, ২০১৫ সালে ঝিনাইদহ জেলায় যে ১ হাজার ৯৪৪ জন আত্মহত্যা করেছে, তার মধ্যে প্রায় ৬৪ শতাংশ নারী। ৩৬ শতাংশ পুরুষ। এই পরিসংখ্যান বলছে ঝিনাইদহ জেলার তুলনামূলক অস্বচ্ছল উপজেলায় এই আত্মহত্যার হার বেশি। কৃষক ও দরিদ্র পরিবারে এই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। উল্লেখ্য, এই আত্মহননের একটা বড় কারণ হয়ত দারিদ্র্য। উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাব হয়ত মানুষের মনে গভীরতর হতাশার জায়গা তৈরি করে। ঝিনাইদহ জেলায় আরেকটি প্রবণতাও লক্ষণীয়। জঙ্গিবাদী চরমপন্থী রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়েছে এখানকার মানুষ তুলনামূলক বেশি। জাসদের গণবাহিনী থেকে শুরু করে হালের ইসলামি চরমপন্থীদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে এই জেলার অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ। চরমপন্থী রাজনীতির প্রতি আগ্রহ সম্ভবত যে হতাশা থেকে, আত্মহত্যার প্রবণতা সেই রকম কোনও হতাশা থেকে আসছে কিনা, এই জেলার মানুষদের বিষয়ে সেটা একটা গবেষণার বিষয় হতে পারে মনোবিজ্ঞানীদের জন্য ।

চার.

মানুষ যখন গভীরতর হতাশায় পড়ে তখন সে বাঁচার জন্য আস্থাভাজন, নির্ভর করা যায়, এমন কাউকে খুঁজে পেতে চায়। ভরসা করতে চায়। বাঁচার আশাটিকে কোনও না কোনও নির্ভরতায় বাঁচিয়ে রাখতে চায়। আশেপাশে তেমন কাউকে না পেলে তার নির্ভরতার সম্ভাবনা শূন্যে নেমে আসে। নিজেকে তখন সে সমাজ বা পরিবারের বোঝা ভাবতে শুরু করে। সেটাও হয়তো তাকে এই মৃত্যুগহ্বরে ঠেলে দিতে বাধ্য করে। বৃদ্ধ, নারী বা গৃহবধূর ক্ষেত্রে এই প্রবণতা হয়তো ভীষণতর।

মাঠপর্যায়ের তথ্যানুযায়ী যাদের মাসিক আয় পরিবারপ্রতি ৪ হাজার কিংবা ২ হাজার টাকার নিচে, সেখানে পরিবারের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে সব চেয়ে বেশি ভিক্টিম তো নারীই। প্রান্তিক আয়ের মানুষদের মধ্যে আত্মহননের এই প্রবণতাকে স্বাস্থ্যগত সমস্যা বলে উপেক্ষা করা উচিত নয়।

পাঁচ.

কেন মানুষ নিজের সবচাইতে বড় সম্পদ তার জীবনকেই নিজের হাতে খুন করতে চাইছে? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর মেলা ভার। পৃথিবীর একেক জায়গায় এই আত্মহত্যার কারণ হয়তো এক নয়। ভূগোল, পরিবেশ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক সম্পর্কের ভেদে এই আত্মহত্যার কারণও হয়তো ভিন্ন ভিন্ন। তবে বাংলাদেশে এই আত্মহত্যার কারণ হিসেবে মনোবিজ্ঞানীরা চরম হতাশা, সামাজিক বঞ্চনা কিংবা দারিদ্র্যকেই বড় কারণ বলছেন। প্রান্তিক মানুষদের আত্মহত্যার ক্ষেত্রে আর্থিক অনিশ্চয়তা হয়তো বড় কারণ। জীবনের সামনে যখন আর কোনও আশা থাকছে না, দারিদ্র্যতার ক্লিষ্টতায়-পিষ্টতায় জীবনের সব স্বপ্ন যখন ধূলিস্যাৎ হয়ে উঠছে তখনই হয়তো প্রান্তিক মানুষরা হারিয়ে ফেলছেন জীবনের আশা। শুধু আশা হারানোই নয়, তাদের মনে বাসা বাঁধছে গভীরতর হতাশাও। সেই হতাশাই হয়তো এক সময় হাঁটিহাঁটি পা-পা করে জীবনকে ঠেলছে আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর গহ্বরে। তবে প্রান্তিক দরিদ্র মানুষের বাইরেও অনেক সচ্ছল সম্ভাবনাময় মানুষও আত্মহনন করছেন। জীবনের নানা পর্যায়ে নানারকম টানাপড়েন, বিচ্ছেদ কিংবা স্বপ্নভঙ্গ হয়তো অনেক সচ্ছল, শিক্ষিত মানুষকেও তার জীবনের প্রতি বিস্বাদ করে তুলছে। সেটাও তাকে প্ররোচিত করছে আত্মহত্যার দিকে।

ছয়.

আত্মহত্যা শুধুমাত্র বাংলাদেশের একটা স্থানিক সমস্যা নয়। এর একটি বৈশ্বিক আবহও আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ১৫-৪৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের একটি হচ্ছে আত্মহত্যা। এই সংস্থাটির পূর্বাভাস বলছে, ২০২০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ মানুষ আত্মঘাতী হবে। আত্মহত্যার চেষ্টা চালাবে এরও ১০ থেকে ২০ গুণ মানুষ। সে কারণেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিবছর একটি দিনকে ‘আর্ন্তজাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে নির্ধারণ করেছে।

বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ২৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করলেও নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে তেমন আলোড়ন ও আলোচনা নেই। নেই আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা। বিপুলতর সম্ভাবনাময় জীবনের এই অপচয় রোধ করতে  এই আত্মহননের প্রবৃত্তিগুলো আরও গভীরভাবে অনুসন্ধানের চেষ্টা চালানো প্রয়োজন। দরকার এ বিষয়ে চিন্তা ও প্রচেষ্টার বিনিয়োগ নিশ্চিত করা। আশা করি আমাদের সমাজ গবেষক, নীতি নির্ধারক আর দেশভাবুকরা এখন এই বিষয়ে অগ্রসর পদক্ষেপ নেবেন।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চকরিয়ার সেই সমাজসেবা কর্মকর্তা ও অফিস সহকারী বরখাস্ত
চকরিয়ার সেই সমাজসেবা কর্মকর্তা ও অফিস সহকারী বরখাস্ত
মুন্সীগঞ্জে ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ দুজনের মৃত্যু
মুন্সীগঞ্জে ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ দুজনের মৃত্যু
শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপের আহ্বান
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলটেবিলশ্রমিকের অধিকার সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপের আহ্বান
কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে শিলাবৃষ্টিতে ভেঙেছে ঘরবাড়ি, ধানের ক্ষতি
কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে শিলাবৃষ্টিতে ভেঙেছে ঘরবাড়ি, ধানের ক্ষতি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ