X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিশুদের বুক-পিঠের ওপর দিয়ে নির্দয়ভাবে হাঁটা কেন?

ফজলুল বারী
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১২:৪৭আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১২:৫২

ফজলুল বারী চাঁদপুরের হাইমচরের নীলকমল স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তথাকথিত ‘মানব প্রাচীর’, ‘প্রতীকী পদ্মা সেতু’র নামে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পিঠের ওপর দিয়ে জুতো পায়ে নিষ্ঠুর হেঁটে যান এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় ইউনিট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূর হোসেন পাটোয়ারী। ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই এলাকা থেকে একজন নিষ্ঠুর ছবিটি পাঠান ফেসবুকের ইনবক্সে। ছবিটি দেখেই চমকে যাই। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। অমানবিক ও নিষ্ঠুর ছবিটি নিয়ে তাৎক্ষণিক এক ফেসবুক পোস্টে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল বাংলাদেশের কোনও আদালত নিষ্ঠুর ওই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত জনপ্রতিনিধিকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেবেন কিনা। আওয়ামী লীগ তাদের এমন একজন নিষ্ঠুর স্থানীয় নেতাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেবে কিনা। এই নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কিনা শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ফেসবুকের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হাতের কাছে থাকাতে তাৎক্ষণিক এভাবে নিজের কথাগুলো বলা যায়। যে কোনও ঘটনায়- দেখায় বিবেক যা বলে তা বলা যায় অকপটে।
কিন্তু অনেক ঘটনার মতো এ ঘটনার পোস্টেও নানান প্রতিক্রিয়া আসে। অনেকে ঘটনা নিয়ে নিজেদের ক্ষোভ জানান। অনেকে নানান প্রশ্নও তোলেন! আজকালকার সাদা চোখে দেখা অনেক ঘটনায় আপনার বিবেক যা সায় দেবে তা অকপটে লেখার বিপদও অনেক। সাদাকালো ঘটনাগুলো নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলেন তাদের অনেকে স্রেফ দলকানা। কোনটায় তাদের দলের ভালো হচ্ছে নাকি ক্ষতি হচ্ছে তা এরা ভাবেন না বা সে সামর্থ্যেরও তাদের ঘাটতি আছে। যেমন এ লেখার প্রতিক্রিয়ায় কিছু লোকজন বলার চেষ্টা করেন নূর হোসেন পাটোয়ারী যেহেতু একজন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, সে কারণে তিনি এক ধরনের অপপ্রচারের টার্গেট হয়েছেন কিনা। এ ধরনের ঘটনা ওই স্কুলে এটি প্রথম না। এর আগে এলাকার ইউএনও একইভাবে সেখানে ছাত্রদের পিঠের ওপর দিয়ে হেঁটে গেছেন। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের একজন নেতা এভাবে হাঁটায় সমালোচনা হচ্ছে। অথচ ওই চেয়ারম্যান স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকদের জোরাজুরিতে এভাবে হেঁটেছেন। এরপর আবার ছাত্রদের তিনি বকশিস হিসাবে পাঁচ হাজার টাকাও দিয়েছেন। আর এটাতো সেখানে প্রতীকী পদ্মা সেতু বানানো হয়েছিল। পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের উদ্যোগ নেতৃত্বে হচ্ছে বলে যারা হিংসুটে-সহ্য করতে পারছে না তারাই ঘটনাটির বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত, ইত্যাদি!



শিশুদের বুক-পিঠের ওপর দিয়ে নির্দয়ভাবে হাঁটা কেন? আমাকে একজন লিখেন স্কাউটিং সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নেই। তিনি স্কাউটিং’এ এই করেছেন সেই করেছেন! যুদ্ধের সময় ভেঙে পড়া বা ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতুর জায়গায় মানুষ পারাপারে স্কাউটদের দিয়ে এমন মানবসেতু বানানো হয়। নীল কমল স্কুলের স্কাউটরাই এমন করেছেন! অস্ট্রেলিয়ায় নাকি স্কুলের বাচ্চাদের দিয়ে স্থানীয় নেতাদের এমনভাবে অভ্যর্থনা করা হয়! আমি অস্ট্রেলিয়ায় থেকেও এসব জানি না এভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণও করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখির এমন ইতিবাচক-নেতিবাচক নানান দিক আছে। নেতিবাচক হলো মনমতো না হলে অনেকে ইচ্ছামতো গালিগালাজ করেন। বিনামূল্যে প্রচুর জ্ঞান দেন। আমার সময় কম। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসবের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করি না। এসবের জবাব দিতে বসলে পড়ালেখা, কাজকর্মের সব শিঁকেয় উঠবে। এর মাঝের জামালপুরের মেলান্দহের এক স্কুলের জমিদাতা সে স্কুলের ছাত্রদের বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার ছবিও ভাইরাল হয়।





হাইমচরের উনি কোমলমতি ছাত্রদের পিঠের ওপর দিয়ে হেঁটেছেন! আর জামালপুরের ইনি হেঁটেছেন বুকের ওপর দিয়ে! কী ভয়ংকর সব ফলোআপ! ঘটনাগুলো আরও ভয় বাড়ায় স্থানীয় কিছু সাংবাদিকের কর্মকাণ্ডে! তারা তাদের পত্রিকায় রিপোর্ট লিখেন বা তাদের দিয়ে লেখানো হয় এই নিষ্ঠুরযজ্ঞই নাকি ওই স্কুলের ঐতিহ্য! বহুবছর ধরে নাকি এমন সেখানে চলে আসছে! আমাদের শৈশবে স্কুলে পড়া না পারলে কথা না শুনলে বাচ্চাদের বেত হাতে বেদম পেটানো হতো। হাঁটু গেড়ে নিলডাউন করিয়ে বা সূর্যের দিকে তাকাতে বাধ্য করে দাঁড় করিয়ে রেখে দেওয়া হতো শাস্তি! এখন এই একবিংশ শতাব্দিতে এসে কি তা ভাবা যায়? স্কাউটিং’এর অভিজ্ঞতা আমাদেরও ছিল। প্রথম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় যুদ্ধকালীন কিশোর-তরুণদের মানবিক দায়িত্বে কাজে লাগাতে স্যার ব্যাডনপাওয়েল গড়ে তোলেন স্কাউট আন্দোলন। প্রথমে গড়া হয় বয়েজ স্কাউট, পরবর্তিতে গার্লস গাইড গড়া হয়। আমাদের সময়ে স্কাউটদের বন্যার্তদের সহায়তায়, ট্রাফিক সপ্তাহে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ সহ নানাকাজে লাগানো হতো। আর এখন সব বাদ দিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান বা স্কুলের জমিদাতাকে বিনোদন দিতে কোমলমতি ছাত্রদের বুক বা পিঠের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার ব্যবস্থা করা! আর এই নিষ্ঠুরযজ্ঞকে জায়েজ করা আজকের দিনের কারও কারও সাংবাদিকতার দায়িত্ব!

শিশুদের বুক-পিঠের ওপর দিয়ে নির্দয়ভাবে হাঁটা কেন? ভালো খবর হচ্ছে শাসকদল এই নিষ্ঠুর ঘটনাগুলোকে জায়েজ করার চেষ্টা করেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল ঘটনাটিকে আমলে নিয়ে ওই উপজেলা চেয়ারম্যানকে এরমাঝে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঘোষণাটি দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন ঘটনা তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে তার মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। কারণ আমার ধারণা এমন একটু নিষ্ঠুর যজ্ঞের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে ওই চেয়ারম্যান পদে থাকার নৈতিক যোগ্যতা হারিয়েছেন। মেলান্দহের ঘটনায় জড়িতের বিরুদ্ধে তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় জেলা প্রশাসন। তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফৌজদারী আইনে শিশু নির্যাতনের দায়ে তার বিরুদ্ধেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের সম্ভব। এখনও নেওয়া হয়নি নিষ্ঠুরতার শিকার কোমলমতি ছাত্রদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার উদ্যোগ। যে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা দুটি ঘটেছে এর অভিজ্ঞতায় শুধু এসবের বিরুদ্ধে না, আমাদের দেশে এখনও অমুক অমুককে সম্বর্ধনার নামে কোমলমতি স্কুল ছাত্রছাত্রীদের যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয় তাও নিষিদ্ধ করতে হবে।

শিশুদের বুক-পিঠের ওপর দিয়ে নির্দয়ভাবে হাঁটা কেন? এখন এসব নিষ্ঠুর ঘটনা জায়েজ করতে কেউ কেউ যে অস্ট্রেলিয়া সহ নানা দেশের উদাহরণ ভুলমতো দেন তাদের উদ্দেশে- আমি অস্ট্রেলিয়ায় থাকি বলে এদেশটাকে চিনি-জানি। এদেশটায় প্রাইমারি-হাইস্কুলের পড়াশুনার সঙ্গে খেলাধুলাটা খুব বেশি জড়িত। প্রাইমারি স্কুলে বলা চলে খেলার ফাঁকে পড়ানো হয়। আর বাচ্চাদের পার্কে নেবে না সাঁতারে নেবে সবকিছুর আগে অভিভাবক থেকে লিখিত অনুমতি নিতে হবে। এমনকি হাইস্কুলের ছাত্রকে ক্লাসে বিশেষ কোনও একটা সিনেমা দেখানোর আগেও লিখিত অনুমতি নেওয়া হয় অভিভাবকের। এমন একটা দেশে বাচ্চাদের বুক-পিঠের ওপর দিয়ে কাউকে অবিশ্বাস্য হেঁটে যেতে দেওয়া হবে এমন ভাবাটা কি বেশি বেশি কল্পনাপ্রসূত হয়ে গেলো না? দলকে যারা ভালোবাসেন তাদের বলছি এমন অপরাধ-অপরাধীকে প্রশ্রয় দিলে দল উপকৃত হয় না, গর্তে পড়ে। প্রতীকী পদ্মাসেতু বানিয়ে কাউকে সম্মান দেখাবেন? সে সম্মানের উপযুক্ত মানুষতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। স্কুলের বাচ্চাদের বুক পিঠের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে কি শেখ হাসিনা বা ওবায়দুল কাদেরকে রাজি করাতে পারবেন? অবশ্যই না। তবে কেন নিষ্ঠুর নূর হোসেন পাটোয়ারীদের পক্ষ নেওয়া? গুদামের পচা আলু ফেলে না দিলে কী ঘটে? অবশ্য নূর হোসেন পাটোয়ারীকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তে তার মতোদের পক্ষে থেমে গেছে দূতিয়ালি। তার মতোরা সাবধান হও। হাইমচর, মেলান্দহে নিষ্ঠুর আচরণের শিকার কোমলমতি ছাত্রদের প্রতি সহানুভূতি। এই ছেলেদের চিকিৎসা বা কোনও কাজে লাগতে পারলে সুযোগটি নেবো।

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পুরস্কার পেলেন কুবির চার শিক্ষার্থী
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পুরস্কার পেলেন কুবির চার শিক্ষার্থী
গরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ