X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বোঝা না বোঝার সংকটে নারীবাদ

সাদিয়া নাসরিন
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৬:২৯আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৬:৩২

সাদিয়া নাসরিন ‘নারীবাদীরা কেন পুরুষবিদ্বেষী? নারীবাদীরা কেন শুধু নারীর অধিকারের কথা বলে? নারীবাদীরা কেন মানবতাবাদী হতে পারেনা?’—সম্প্রতি আমার নারীবাদী গ্রন্থের প্রচারণায় এই প্রশ্নগুলোই ঘুরেফিরে এসেছে গণমাধ্যমে। বিষয়টা আমার জন্য অপ্রত্যাশিত ছিল না। কারণ আমি জানি, যে সমাজ নারীর নিজের গর্ভ ও গর্ভজাত সন্তানের উত্তরাধিকারের অধিকার পর্যন্ত স্বীকার করে না, যে ব্যবস্থায় বিয়ে নামক চুক্তির পাতায় ‘নারী কুমারী কিনা’ লেখা থাকে অথচ পুরুষের কৌমার্যের কোনও প্রশ্ন থাকে না, সে সমাজ ব্যবস্থা সংসার সুখী হওয়ার সমস্ত দায় নারীর কাঁধে চাপিয়ে দেয়, যে সমাজে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পাঠ্যপুস্তকে লিঙ্গবৈষম্যের পাঠ থাকে, সেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ভেতরে থেকে নারীবাদকে বোঝা সহজ নয় মোটেও। নারীর জন্য তো নয়ই, পুরুষের জন্যও না।
পুরুষতন্ত্রের রাজনীতিটাই এমন। মেয়েরা নিজের অধিকার আদায় করার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে, কিংবা পুরুষরা পুরুষতান্ত্রিক আচরণ ও সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করছে এই ব্যাপারটি খুব ভয়ঙ্কর পুরুষতন্ত্রে। পুরুষতন্ত্রের রাজনীতি খুব ভালো করেই জানে যে, নারীবাদই একমাত্র মতবাদ যা সুখী সংসারের পুরুষতান্ত্রিক মিথকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।  এ অবস্থায় পুরুষ নিয়ন্ত্রিত এই সমাজে নারীবাদ চর্চাকে আরও বহুকাল অন্ধকার মোকাবিলা করেই এগুতে হবে। তাই গত ৩০/৪০ বছরের নারী আন্দোলন ও প্রচারের ফলে বাংলাদেশে নারীরা (কিছু পুরুষ ও) যখন নারীবাদকে বুঝতে চাইছে, কথা বলছে, চর্চা করতে চাইছে, তখন পুরুষশাসিত প্রচার মাধ্যম, শিক্ষা বা গবেষণায় এমন উদ্দেশ্যমূলক বিতর্ক তৈরি করছে যে, নারীবাদ বলতে কেউ পুরুষবিদ্বেষ মনে করেন, কেউ শ্রেণিবৈষম্য খোঁজেন, এনজিও-জার্গাম এর গন্ধ খোঁজেন।  
সিমেন দ্য বেভ্যোয়ার নারীবাদী সাংবাদিক অ্যালিসের সঙ্গে আলাপকালে বলেছিলেন, ‘‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে ‘নিচু জাত’, বলে প্রতিষ্টিত করা হয়েছে। ‘জাত’ বলতে এমন একটি গোষ্ঠীকে বোঝায়, যেখানে কেউ জন্মালে আর ওই গোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে আসা যায় না।... অর্থনৈতিক, সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক জীবনে মেয়েরা এমন সব আচরণ পেয়েছে,  যা তাদের সত্যি ‘নিচু জাতে’ পরিণত করেছে।’’ এখন এই ‘নিচুজাত’ নারী ‘উঁচুজাত’ পুরুষের সমান অধিকার দাবি করবে—এমন ক্ষেত্র পুরুষতন্ত্র তৈরি করবে না, এটাই স্বাভাবিক। তাই নারীবাদ নিয়ে এত বিভক্তি, বিতর্ক আর সংস্কার পুরুষতন্ত্র তৈরি করেছে যে, নারীবাদের মতো একটি চ্যালেঞ্জিং মতবাদকে বোঝা নারীদের জন্য তো বটেই, পুরুষের পক্ষেও প্রায় অসম্ভব।
মজার বিষয় হলো, অধিকাংশ পুরুষই কিন্তু নারীবাদ বোঝে কিন্তু স্বীকার করে না। কারণ নারীবাদ যে স্বাধীনতার কথা বলে, তা নারী না বুঝলেও স্বাধীনতা ভোগ করে অভ্যস্ত পুরুষ ঠিকই বুঝতে পারে। তাই পুরুষ ধর্ম বোঝে, রাজনীতি বোঝে, অর্থনীতি বোঝে, পুঁজিবাদ বোঝে, সমাজতন্ত্র বোঝে, অথচ নারী পুরুষের সম অধিকারের মতো স্বাভাবিক একটা বিষয়ে কথা বললেই অহেতুক বিতর্ক তৈরি করে, সন্দেহ করে, হেসে উড়িয়ে দেয়, প্রোপাগান্ডা চালায়। কারণ, পুরুষতন্ত্রকে আরও হাজার বছর টিকিয়ে রাখার জন্য নারীবাদের  মতো গতিশীল একটি মতবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো ভালো অস্ত্র আর নেই পুরুষের হাতে। সুতরাং পুরুষরা নিজেদের সুবিধামতো জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনের চর্চায় অগ্রসর হয়ে যেখানে পৌঁছে গেছে, সেখানে নারীদের জন্য আলাদা করে একটা মতবাদ বোঝার জন্য বা চর্চা করার জন্য কোনও ক্ষেত্র অনায়াস করে রাখেনি।

তাই আমরা দেখি, বাংলাদেশে নারীর সমান অধিকারের আন্দোলনে এখনও নারীদের বড় একটা অংশের কোনও সম্পৃক্ততা তো নেই-ই, ন্যূনতম কৌতূহল পর্যন্ত নেই।  পুরুষতন্ত্র নারীর মনোজগৎ ও নির্মাণ করেছে নিজেদের মতো করে। অধিকাংশ নারীই সমান অধিকারে বিশ্বাস করে না। তারা জানে পুরুষ এটা পছন্দ করে না। তাছাড়া, নারীর সমান অধিকার আন্দোলন নিয়ে বিরক্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এমন শিক্ষা-দীক্ষা, প্রথা-প্রচারণা চালিয়ে এসেছে, যেন নারী নিজের অস্তিত্ব, স্বকীয়তা, স্বাধীনতা ইত্যাদি মৌলিক মানবিক বিষয়ে ভাবার সুযোগ না পায়। নারীরাও তাই নারীবাদ নিয়ে বিভিন্ন রকম বিতর্ক তৈরি করে, সন্দেহ করে।

আবার নারীবাদ বোঝা বা চর্চার বিষয়টি অনেক নারীর কাছে ও যথেষ্ট বিরক্তিকর।  নারীবাদ সেই নারীদের আচরণকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে, যারা পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করে। নারীদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বাস ও আচরণ, পুরুষসুলভ নিপীড়ন এবং ক্ষমতালোভের উৎসগুলোকে ও নারীবাদ চ্যালেঞ্জ করে। অন্যদিকে একজন নারী যখনই পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং আধিপত্যের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে, তখন অনিবার্যভাবেই নিজের বাবা-ভাই-বন্ধু-স্বামী-পুত্র-বন্ধু-সহকর্মীদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। তারা সেই পুরুষ, যাদের কাছে নারী প্রাথমিকভাবে পুরুষতান্ত্রিক আচরণের শিকার হয়। সুতরাং একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোর ভেতরে থেকে পুরুষতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করা, পুরুষাধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা এবং এর মধ্যেই পারিবারিক ও সামাজিকভাবে একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক নির্মাণ করার চাপটা অধিকাংশ নারীই নিতে পারে না বা চায়ও না।

পুরুষতন্ত্রের শিকার এই নারী-পুরুষদের মূল ভয় কিন্তু নারীবাদ শব্দটিকে নয়, এই ভয় নারীবাদের অ্যাকশনে। পুরুষতন্ত্রের বানানো ট্যাবু ভেঙে, নারীবাদকে পুরোপুরি বোঝা এবং স্বীকার করার মানেই হচ্ছে পুরুষের তৈরি অসম নিয়ম, ভাষা, আইন, মিথ ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ করা এবং প্রতিরোধ করার কাজে লেগে যাওয়া। নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দর্শক হিসেবে থাকার সুযোগ নারীবাদ চর্চায় নেই। আবার নারীবাদকে স্বীকার করে তা চর্চার জন্য যে মনোবল, উদ্যম এবং ঝুঁকি নিতে হয় তাও এই নারীরা নিতে চান না বা পারেন না।  নারীবাদকে স্বীকার করলে বা কাজ করলে নারীরা ট্যাগড হয়ে যায় ‘যৌন-স্বাধিনতাকামী’, ‘খারাপ’ মেয়ে হিসেবে; এমনকি নারীবাদ বুঝতে চাওয়া পুরুষরাও পুরুষতন্ত্রের আক্রমণ থেকে রেহাই পান না।

তবু, দিনশেষে নারীবাদ নারী-পুরুষ উভয়কেই লাভবান করে। নারীবাদ পুরুষতন্ত্রের যাঁতাকল থেকে পুরুষের মুক্তির কথাও বলে। তাই পুরুষতন্ত্রের লক্ষণরেখা পেরিয়ে নারী-পুরুষ উভয়কেই নারীবাদ জানতে হবে, বুঝতে হবে। নারীবাদ না জানলে কোনোভাবেই জানা হবে না মানবতাবাদকে। নারীবাদ বা না জানলে জানা হবে না আমাদের মায়েদের উদায়স্ত বিনামজুরি শ্রম আর দাসজীবনের আর্তি; জীবন্ত কবর দেওয়া কন্যাদের, সহমরণের চিতায় পোড়ানো নারীদের, সতিচ্ছেদ আর ভঙ্গাঙ্কুর কাটা কিশোরীদের আর্তচিৎকারের ইতিহাস। নারীবাদ না বুঝলে আপনি বুঝবেন না ধর্ষিত মেয়েদের গ্লানি, অপমান, এসিডে ঝলসে যাওয়া মুখগুলোর আমৃত্যু যন্ত্রণার ভাষা। কন্যা সন্তান জন্মের ভয়ে গর্ভপাত করতে বাধ্য হওয়া মায়ের নীরব কান্নার দহন, গর্ভজাত সন্তানের অধিকার বঞ্চিত মায়ের অসম্মান আর বঞ্চনা আপনি বুঝতে পারবেন না, যদি নারীবাদ না বোঝেন। উন্নয়নের চাকা ঘোরানো নারীশ্রমিকের ন্যায্য মজুরির অধিকারের পক্ষে আপনি দাঁড়াতে পারবেন না, যদি নারীবাদের পক্ষে না দাঁড়ান। নারীবাদের পক্ষে না দাঁড়ালে অজান্তেই আপনি অবস্থান নিবেন যৌনপল্লীতে যৌনসেবা দিতে বাধ্য হওয়া দশ বছরের মেয়েটির বিপক্ষে।

নারীবাদকে বুঝলে আপনি বুঝবেন, বন্য পুরুষের উন্মুক্ত চাপাতির আঘাতে রাজপথে লুটিয়ে পড়া খাদিজার রক্তের ঋণ এই নারীবাদ, হিংস্র পুরুষের বিকৃত যৌনতায় শতছিন্ন যোনিপথ নিয়ে কাঁতারনো পূজা নামের শিশুটির জীবনের দাম এই নারীবাদ। আইসিস নামক ভয়ঙ্কর ধর্মদানবের যৌনদাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি থাকা, ভোগ করা শেষে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা ইয়াজিদি নারী অথবা সৌদি বাদশার হেরেমে আটকে থাকা হাজার হাজার যৌনদাসীর মুক্তির সুর বাজে যে গানে, সেই সঙ্গীতের নাম নারীবাদ।

সেই সুর আপনি গাইবেন কিনা, সিদ্ধান্ত আপনার।

লেখক: কলামিস্ট ও প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ।

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ