X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

হন্তারক ‘মা’: পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন নয় তো?

সৈয়দা আখতার জাহান
১৫ জুন ২০১৭, ১৬:৪২আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:২১

সৈয়দা আখতার জাহান ২০০১ সাল, জুনের এক সুন্দর সকাল। হিউস্টনের পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ৯১১-তে একটা ফোন কল আসে। আন্দ্রেয়া ইয়েটস নামের এক ভদ্র মহিলা খুব ঠান্ডা কণ্ঠে একজন পুলিশ অফিসার চেয়ে পাঠান। ফোন অপারেটরের সব প্রশ্নের বার বার একই উত্তর দিচ্ছিলেন তিনি, ‘আমার একজন পুলিশ অফিসার লাগবে’। পরবর্তী ফোন কলটি যায় ভদ্রমহিলার স্বামীর অফিসে যিনি ‘নাসা’তে কর্মরত, ‘এক্ষুনি বাসায় চলে আসো’। আমেরিকাতে পুলিশি সাহায্য চেয়ে কল করলে, সাহায্য পেতে মিনিট দুই-তিনের বেশি সময় লাগে না। ভদ্রলোক বাসায় ফিরে দেখেন পুরো বাড়ি পুলিশ, চিকিৎসক এবং সরকারি অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারিতে ভরে গেছে। মূল ফটকে নিজের পরিচয় দিয়ে ভেতরে কী ঘটেছে প্রশ্ন করলে ভদ্রলোককে জানানো হয়, তার পাঁচ সন্তান খুন হয়েছে। এবং খুন করেছেন সন্তানদের মা। যিনি নিজে এই হত্যাকাণ্ডের কথা শিকার করেছেন। বাথটাবের পানিতে চুবিয়ে একে একে খুন করা হয় বিভিন্ন বয়সের বাচ্চাদেরকে। যার মধ্যে সব থেকে ছোট বাচ্চাটার বয়স ছিল ছয় মাস। কেন এই হত্যাকাণ্ড? প্রথমেই মাথায় আসে দাম্পত্য কলহের কথা। না তেমন সম্পর্ক তাদের ছিল না। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক? নাহ তেমনটাও নয়। নিশ্চয় সন্তানদেরকে স্নেহ করতেন না! আন্দ্রিয়া ইয়েটস সন্তানদেরকে ভীষণ ভালোবাসতেন। তবে? এই তবে’র উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হয়ে কয়েক বছর। মামলাটি আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় শুরু থেকেই তার পাশে ছিলেন তার স্বামী রাস্টি ইয়েটস। মিডিয়া পুরো ঘটনায় নিজেদের মতো করে একটা ইতি টানার চেষ্টা করেন, তাদের ভাষ্যমতে আসল খুনি নাকি রাস্টি ইয়েটস। তাই তিনি তার স্ত্রীকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। রাস্টি যদি নাই খুন করবেন তবে মিডিয়ার সামনে এক সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলছেন কিভাবে! না হলে, কেন’ই বা তিনি একজন খুনি স্ত্রীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন? পুরো আমেরিকা তখন আন্ড্রেয়ার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ঐক্যমত পোষণ করেন। আদালত বেশ গুরুত্বের সাথে মামলাটি পরিচালনা করেন। আন্দ্রেয়া মানসিক ভাবে অসুস্থ ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন পোস্টপার্টাম সিনড্রোমে ভুগছিলেন। আগে দুই বার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন। আদালত আন্দ্রিয়াকে সন্তান হত্যার দায় থেকে মুক্ত ঘোষণা করলো। তবে তাকে মানসিক রোগের চিকিৎসার নির্দেশ দিল। মহিলা এখনও মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হয়তো আজীবন তাই থাকবেন। 

হিউস্টনের অনুরূপ ঘটনা প্রায় ঘটছে আমাদের দেশে। গণমাধ্যমে দেখা যা্য, ‘সন্তানদের হত্যা করে, মায়ের আত্মহত্যা’ শিরোনামের সংবাদ। যেমন, গত ৮জুন রাজধানীর তুরাগ থানাধীন কামারপাড়ার কালিয়ারটেক এলাকার একটি বাড়ির এক কক্ষ থেকে তিন সন্তানের এবং অন্য কক্ষ থেকে মায়ের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। শান্তা (১৩), আরিশা (৯), সাদ (১১মাস) এবং মা রেহানা পারভীন (৩৪)। জানুয়ারির ৯ তারিখে রাজধানীর দারুস সালাম থানার ছোট দিয়াবাড়ি এলাকার একটি বাড়ি থেকে দুই সন্তানসহ এক মহিলার মৃত দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। দুই শিশুর একজনের বয়স পাঁচ বছর অন্যজনের তিন। সন্তান দুটিকে গলা কেটে হত্যার পর মা আনিকা আত্মহত্যা করেন। ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট পিরোজপুরে কণা (২) এবং বেবি (৯মাস) নামের দুই শিশু সন্তানকে হত্যা করে বিষপানে আত্মহত্যা করেন মা নাজমুন্নাহার লাইজু (২৬)। ২৪ জুলাই, ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জে ৪০দিন বয়সের এক শিশুকে কোলে নিয়ে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন মা সোনিয়া আক্তার (২২)।

এই ধরনের ঘটনাগুলোকে আমরা অন্য আর দশটি অপরাধের ঘটনার মতো করে বিবেচনা করি। কখনও হত্যাকারীর চরিত্রকে দোষারোপ, কখনও সমাজকে দোষারোপ আবার কখনও দারিদ্রকে। বিশ্লেষকরা মতামতে বলেন, যখন কোনও মা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন তখন আর তার সন্তানদেরকে অনিরাপদ রেখে যেতে চান না বলে আগে সন্তানদেরকে হত্যা করেন পরে নিজে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু কেন মায়েরা আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন এবং সন্তানদের হত্যা করেন, সেটা খতিয়ে দেখা হয় না। অবশ্য পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন সম্পর্কে এদেশের বেশির ভাগ মানুষই অবগত নন। পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন কী? সাইকোলজিতে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনটা সাধারণত শিশু জন্মের পরে প্রায় সব মায়েরই এমনটা হয়ে থাকে। অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা। শরীরে ম্যাসিভ নিউরো-ট্রান্সমিটার বা হরমোনাল চেঞ্জের জন্য এমনটা ঘটে থাকে। এই সময়ে মায়েরা স্বামীদের খুন করে ফেলতে চায়, অথবা আত্মহত্যা করতে চায়। অথবা এমন কিছু করতে চায় যা সুস্থ মাথার মানুষ কল্পনাও করতে পারেন না। সাধারণত ৩০ ভাগ নারী প্রসবপূর্ব বিষন্নতায় ভোগেন আর ৫০ ভাগ প্রসবোত্তর বিষন্নতায় আক্রান্ত হন। পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে অহেতুক দুশ্চিন্তা, উদাস থাকা, বিষাদ্গ্রস্ত থাকা এবং সন্তানের প্রতি অনাগ্রহ তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রেই মা’র মনে হতে পারে তার সন্তানের মানসিক বা শারীরিক কোনও খুঁত রয়েছে। কাজেই একে মেরে ফেলা ভালো। ক্ষেত্র বিশেষ মায়েরা নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন এবং আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন।

গণমাধ্যমে সন্তান হত্যার সংবাদে ছোট সন্তানটির বয়স বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বছরখানেকেরও কম দেখা যাচ্ছে। মানে এক্ষেত্রে মা হওয়ার পর শরীরে যে হরমোনাল চেঞ্জের কথা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে বলা হচ্ছে সেটার সম্ভাবনা ভেবে দেখবার মতো। এছাড়াও মানসিক চাপ থেকে মুক্তির জন্য ‘মা’ সন্তানদের হত্যা করছেন। যেমন, মাহফুজা মালেক জেসমিন যিনি তার দুই সন্তানকে হত্যা করেছিলেন তার স্বামী মামলার এজাহারে জেসমিনের মানসিক সমস্যার কথা বলেন। বলেন জ়ে সমিন সন্তানদের পড়ালেখা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। সন্তানরা না থাকলে মানসিক টেনশনও থাকবে না ধারণা করেই জেসমিন এই কাজ করেন।

আন্ড্রেয়া পেশায় ছিলেন ‘হাউজ ওয়াইফ’। তৃতীয় সন্তান জন্মাবার পর থেকেই মূলত তিনি ডিপ্রেশনে ভুগতে শুরু করেন। চিকিৎসক তাকে এন্টিডিপ্রেশনের ওষুধ দেন। সেবনও করেন কিছুদিন। সুস্থ হয়ে গিয়েছেন ভেবে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন। জন্ম নেয় আন্ড্রেয়ার চতুর্থ সন্তান। পরিস্থিতির অনবনতি হলো। পঞ্চম সন্তানের বয়স যখন ছয় মাস তখনই ঘটে এই হত্যাকাণ্ড। মনে রাখতে হবে, পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে যারা আক্রান্ত তারা অপরাধী নয়। সাইক্রিয়াটিস্ট এর সহায়তা নিয়ে এদের উপযুক্ত চিকিৎসা করা প্রয়োজন। ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষেরা নিজেদের মধ্যে একধরনের শূন্যতা অনুভব করেন। তাই ডিপ্রেশনের সাথে আত্মহত্যার প্রবণতা খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত। ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষদের কাছে বস্তুত ঠিক ভুলের কোনও আলাদা মানদণ্ড থাকে না। ডিপ্রেশন এক গভীর, গোপন অসুখ; যা মানুষ সবার অলক্ষ্যে নিজের ভেতর বয়ে চলে। 

ডিপ্রেশন এবং ব্যক্তিত্ব এতটাই একসুতোয় জড়িয়ে থাকে যে, একে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার ১০ থেকে ২০ ভাগের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সমস্যা বা ‘পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার’ রয়েছে। যাদের মধ্যে ‘পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার’ তাদের মাদকাসক্তি, হত্যা, আত্মহত্যা, উদ্বিগ্নতা, নানা ধরনের অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এদেশে বিষন্নতায় ভুগছেন ৪.৬ শতাংশ মানুষ। দীর্ঘদিনের চাপ ও অসহায়ত্বে ভুগতে থাকা মানুষেরা সবকিছুকে নেতিবাচক ভাবে দেখতে থাকেন। জীবনে নানা ধরনের টানাপোড়েন চলতে থাকে। হতাশা ও বিষন্নতা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। সবচেয়ে প্রিয় সন্তানদের কোথায়, কার কাছে রেখে যাবেন সেই অনিশ্চয়তা থেকে সন্তানদেরকে আগে হত্যা করে পরে নিজে আত্মহত্যা করেন।

নতুন মা’দের জীবন আগের চেয়ে বেশ খানিকটা বদলে যায়। সন্তানকে পুরোটা সময় মনোযোগ দিতে হয় বলে, অনেকের মনে হয় আগের জীবনের সেই স্বাধীনতাটা আর নেই। নিজের সৌন্দর্য, ফিগার, ক্যারিয়ার সব কিছু থাকে চিন্তিত করে তোলে। অনেক ক্ষেত্রে আগের জীবনের কোনো বিষন্নতা হঠাৎ হঠাৎ ফিরে আসে। দীর্ঘদিন চেপে রাখা চিন্তা বা ভয় মনে মাত্রাতিরিক্ত চাপ তৈরি করতে পারে। এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবার আগে এগিয়ে আসা উচিত পরিবারের। স্বামীকে স্ত্রীর প্রতি আগের চেয়ে আরও বেশি মনোযোগী হতে হয়। সামাজিক বন্ধন আর পারস্পারিক সহযোগিতা ছাড়া এই অবস্থার উন্নতি করা প্রায় অসম্ভব।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা এবং গণমাধ্যম অধ্যায়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
করোনার পরে মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পরে মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ