X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ক্রিকেট কি আসলেই দেশপ্রেমকে ধারণ করছে?

অজয় দাশগুপ্ত
২১ মার্চ ২০১৮, ১৪:৩৮আপডেট : ২১ মার্চ ২০১৮, ১৪:৪৩

অজয় দাশগুপ্ত খেলাকে খেলা হিসেবে নিতে না পারার বিপদ এখনও কাটেনি। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় টি-টোয়েন্টি নিদাহাস ট্রফির পর ক্রিকেটে আরও দুশমন বাড়লো। যা  ছিল অপ্রত্যাশিত। আজকাল খেলার সঙ্গে টাকা আর জুয়া জড়িয়ে এমন এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যেখানে খেলা আর খেলা নেই। আমরা জেতা খেলা বহুবার হেরেছি। আবার হারা খেলাও জিতেছি। এটাই খেলার সৌন্দর্য। তবে মানা না মানার বিষয়টা এখন এমন স্তরে, যেখানে বিবাদ বা কলহ ছাড়া কেউ কাউকে মানছে না। না মানার জন্য মিডিয়া আচরণ আর পরিবেশ দায়ী। সামাজিক মিডিয়া এখন এমন এক ভূমিকায়, যেখানে তার নিয়ন্ত্রণ জরুরি হলেও সেটা সম্ভবপর হচ্ছে না। কী হচ্ছে এখানে? দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে এত বিবাদ বা কলহের কারণ কিন্তু আগেও ছিল। সেটা উস্কে দেওয়ার মিডিয়া বা মাধ্যম ছিল না তখন। যার যা খুশি বলতে পারা বা লিখতে পারার মুশকিল এখন প্রকাশ্য।
আগে বলি আমি নিজে ক্রিকেট-পাগল মানুষ। একসময় ক্রিকেট খেলা এবং দেখা দুটোই ছিল পছন্দের শীর্ষে। তখন এই খেলাটি ছিল ক্লাসিক। বলছি না এখন নেই, কিন্তু জৌলুস বাড়লেও তার সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে নানাভাবে। পাঁচদিনের ক্রিকেট ক্লান্তিকর ছিল বৈকি। সে ক্লান্তির ভেতর যে নিয়মানুবর্তিতা বা ধৈর্য সেটা উধাও এখন। যে খেলোয়াড় পাঁচদিন মাঠে থাকে বা খেলে তার জীবনে কিছু নিয়ম এমনিতেই কাজ করতে শুরু করে। সে জানে কীভাবে সবুর করতে হয়। এরপর ক্রিকেটে ওয়ানডে’র শুরু। সেটাও মন্দ না। একটা খেলায় জয়-পরাজয় থাকা জরুরি। তা না হলে মানুষ খেলা দেখতে যাবে কী কারণে? সেটা ফিরিয়ে এনেছিল ওয়ানডে। ওয়ানডেতে এখনও শিল্প বা কৌশল কাজ করে। কিন্তু বাণিজ্য বা করপোরেট সেখানেও আঘাত হানলো। তার মনে হলো মানুষকে আরও একটু পাগলাটে করে তোলা দরকার। তাদের ভেতর আরও জোশ আরও উত্তেজনা মানেই আরও টিকেট বিক্রি। আরও উপার্জন। আরও বিজ্ঞাপন আরও স্পনসর আরও জুয়া। তার হাত ধরে এলো টি-টোয়েন্টি। যখন থেকে এই খেলার শুরু তখন থেকে কেউ আর ব্যাট হাতে দৃষ্টিনন্দন ভঙ্গিতে মাঠে নামে না। যেমন ধরুন এম এস ধোনি। তাকে আমার কখনও ভালো লাগেনি। শুরু থেকেই মনে হতো যুদ্ধ করতে নামছেন। আর ভঙ্গিও মারাত্মক। কী দেখলাম আমরা? যেকোনও উপায়ে একটি বলকে মাঠ টপকে বাইরে পাঠানোই যেন খেলা। সেটা ভালোভাবে শিল্পমানে পাঠানো হোক বা গায়ের জোরে মারা হোক। শচীন লারাদের সেসব ধ্রপদী শটগুলো হারিয়ে গাভাসকারের মতো বড় খেলোয়াড়ও বলতে শুরু করলেন এর নাম হেলিকপ্টার শট।

পচে যাওয়ার আর কী বাকি আছে? বলছিলাম আমাদের খেলার কথা। প্রতিবার খেলার আগে আমরা দেশপ্রেমের নামে যেভাবে জেগে উঠি তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু এই জেগে ওঠাটা কী সব কাজে সবকিছুতে হতে পারে না? দেশপ্রেম মানে কি ক্রিকেটে জিতে আসা? যে খেলা আমাদের হিন্দু মুসলিম বাঙালি ভারতীয় পাকিতে বিভক্ত করে তার জন্য জান দেওয়া মানুষ ভুলে যায় সমাজে কত অনাচার আর কত ধরনের অনিয়ম। একের পর এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো মানুষদের দূরে সরিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠার ভেতর জীবন না উন্মাদনা ঠিক বুঝতে পারি না। আমার ধারণা, কিছু একটা নিয়ে মেতে থাকার একটা বিষয় দরকার আমাদের। কিন্তু লাগামহীন বা বল্গাহীন হলে তো আখেরে আমরাই ঠকে যাবো। এবার আমরা শ্রীলঙ্কাকে যেভাবে ট্রিট করলাম তাতে বেশ সময় লাগবে সম্পর্ক জোড়া লাগতে। তারুণ্যের স্বভাব বিদ্রোহ। কিন্তু সে তরুণ যদি হয় আইকন, তার সুনাম যদি হয় দেশের সুনাম, রাশ টানার প্রয়োজন আছে বৈকি।

ভারতের বেলায় একটা কথা সত্যি, তাদের দাদাগিরি বা মুরুব্বিসুলভ আচরণ মাঝে মাঝে অসহ্য। কিন্তু এই ভারতকেই আমরা নানা কাজে টেনে আনি। দেশের বিষয়ে নাক গলাতে দেই। আমাদের নির্বাচন কীভাবে হবে, কেমন করে হবে, সেটাও নাকি ঠিক করে দেয় তারা। বাণিজ্যের নামে আজ  টিভি বাক্সজুড়ে তাদের আধিপত্য। সেদিন দেখলাম একটি টিভি চ্যানেল মেডিকেয়ারের নামে ভারতে চিকিৎসা ও যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। ন্যায় অন্যায় জানি না, বাস্তবতা এটাই। এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বিচার ব্যতিরেকে তারা মাঠে নামেনি। ফলে মনে রাখতে হবে, ভারতকে সব জায়গায় মাথার ওপর রেখে ক্রিকেটের বেলায় কাঁধে কাঁধ বললে তারা মানবে না। তাই জাতীয় আচরণ ও সমাজে সমান সমান হওয়ার প্রতিযোগিতা দরকার। নতজানু রাজনীতি সেটা হতে দিচ্ছে না। আর যতদিন তা না হবে ততদিন নির্ভরতা যাবে না। ততদিন তারা আমাদের হেয় করার জন্য বয়স ভুলে সম্মান ভুলে দু-হাত কপালে বা মাথায় তুলে বাচ্চাদের মতো নাগিন নাচ নাচবে।

দেশ বা জাতির সম্মান শুধু খেলার মাঠে থাকে না। আন্তর্জাতিক মিডিয়াও বিষয়। আজ যখন এই লেখা লিখছি, বিবিসি সমানে বাংলাদেশের রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। কী সেই প্রচার? বাংলাদেশে নাকি রোহিঙ্গাদের যৌন নির্যাতন করা হচ্ছে। তাদের বাচ্চাদের ট্রাফিকিং করে পাঠানো হচ্ছে নানা দেশে। পতিতাবৃত্তি থেকে আরো নানা ধরনের অভিযোগ। অভিযোগ নিঃসন্দেহে গুরুতর। মুশকিল হলো সরকার বা দেশের মিডিয়া কেউ এসব নিয়ে বলে না। পাল্টা বক্তব্য কী? আসলে কি তা হচ্ছে? হলে তার দায় কার? কীভাবে প্রতিরোধ সম্ভব? এ নিয়ে কেউ কিছু না বলা মানে তো বিষয়টা স্বীকার করে নেওয়া। এতে আমাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। অথচ লাখো লাখো রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আমরা করছি মানবতার বড়াই। কই, তা নিয়ে তো প্রতিবেদন হয় না। মুখে বা কাগজে কলমে যতই বড়াই করি বা মধ্য আয়ের দেশ বলি না কেন, বাংলাদেশকে এখনো গরিব দেশ বলেই মনে করে বিশ্ব। মনে করার কারণ আছে। সমাজ এখনও প্রাগৈতিহাসিক। জীবন এখনও যুদ্ধময়। নারী ও প্রগতিবাদীরা আছেন হুমকির মুখে। সমতাহীন আয় ব্যয়, দারিদ্র্য, লেখাপড়াহীন জনগোষ্ঠী, সব মিলিয়ে পরিসংখ্যান সুখকর নয়। সেদিকে নজর নেই আমাদের। রোহিঙ্গা সমস্যা চাপিয়ে দেওয়া মিয়ানমার কিন্তু বেশ আছে। দু-একটা মৃদু প্রতিবাদ ছাড়া তাদের বেলায় আশ্চর্যজনকভাবে নীরব বিশ্বমিডিয়া। এত এত শরণার্থী আর মানবেতর জীবননযাপনে বাধ্য আরকানবাসীদের দেশ থেকে তাড়িয়েও তারা আছে ভালো ভূমিকায়। কই, এ নিয়ে তো দেশপ্রেম কাজ করে না আমাদের। ক’দিন হৈচৈ করার পর মিডিয়া বুঝে গেছে এই ইস্যু আর চলবে না। ফলে তারা গেছে শীতনিদ্রায়। 

আমরাও পারি বটে। সবকিছু জায়েজ জাস্ট সময়ের ব্যাপার। নদীতে লাশ, রাস্তায় নারীর লাশ, সামাজিক মিডিয়ায় লোলুপ মানুষের স্ট্যাটাস, সব একসময় চাপা পড়ে যায়। এই যে ক্রিকেট নিয়ে মাতম, গাভাসকার বিরোধিতা, তাও সময়ের ব্যাপার। কাল যদি তিনি পা রাখেন, ঢাকার তালেবর ব্যক্তিরাই হোটেলে তাকে নাগিন নাচ নেচে দেখিয়ে কৃতার্থ হবেন। তিনিও জেনে যাবেন আবারও অপমান করা জায়েজ। মনে রাখতে হবে খেলার বাইরেও দেশপ্রেম দরকার। আমাদের বড় প্রতিবেশী দেশটি চতুর। তারা সবকিছু নিয়ম মতো করে। নিজের দেশ ও সমাজকে ঠাঁই দেয় সবার ওপরে। নিজেরা এগিয়ে থেকে আরেকজনকে মাতিয়ে তোলে উন্মাদনায়। বালক বয়সে আমাদের এক বন্ধুকে অভিভাবকেরা একেবারেই পছন্দ করতেন না। কারণ, সে তার পড়াশোনা শেষ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতো অন্যদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য। তার ফলাফল হতো লোভনীয় আর বন্ধুদের কপালে জুটতো গালমন্দ।  

Patriotism is the last refuge of a scoundrel.—এই কথাটা ভুললে চলবে না। আহাজারি দেশপ্রেম নয়। দেশপ্রেম নিজেদের শক্তি আর সাহসকে চেনা। তাকে অবলম্বন করে এগিয়ে যাওয়া। ক্রিকেটে সে শক্তি আছে আমাদের। এখন তার প্রয়োগ দরকার। 

লেখক: সিডনি প্রবাসী কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ