X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

করোনা মোকাবিলা: বিপজ্জনক আত্মপ্রসাদ

মো. তৌহিদ হোসেন
২১ মে ২০২০, ১৪:৪৪আপডেট : ১৮ জুন ২০২০, ১৫:৪৮

মো. তৌহিদ হোসেন চীনের উহানে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে ২০১৯-এর ডিসেম্বর মাসে (মতান্তরে আরও আগেই)। মাসখানেক এ নিয়ে ঢাক-ঢাক গুড়গুড়ের পর জানুয়ারির দ্বিতীয়ার্ধে চীন তা বাকি পৃথিবীকে জানায়। ইতোমধ্যে চীন থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ ব্যবসা বা পর্যটন উপলক্ষে ইউরোপ আমেরিকায় ভ্রমণ করেছেন। বাকিটুকু বিশ্বজুড়ে কোভিড ১৯ সংক্রমণের ইতিহাস, যা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্যানুযায়ী, মুষ্টিমেয় কিছু দেশ বাদ দিলে বাকি পৃথিবীতে দৈনিক সংক্রমণের হার এবং মৃত্যু দুটোই কমে আসছে। ইউরোপের সবচেয়ে আক্রান্ত দেশগুলো ধীর এবং সাবধানী পদক্ষেপে থমকে যাওয়া অর্থনীতিকে চালু করার প্রয়াস পাচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার বিভিন্ন পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নানান হাস্যকর ও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য শত দুঃখের মাঝেও মানুষের তিক্ত বিনোদনের খোরাক হয়েছে। বক্তব্যগুলোকে পাশাপাশি নিয়ে এসে তার অর্বাচীনতাকে জনসমক্ষে হাজির করেছে বিশ্বের মিডিয়া। তবে এরকম বক্তব্যের ব্যাপারে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীও কিন্তু বড় একটা কম যান না, যদিও তিনি ট্রাম্প সাহেবের মতো অতটা বিখ্যাত ব্যক্তি না হওয়ার কারণে বিশ্ব মিডিয়া এ নিয়ে মাতামাতি করেনি। চীন ছাড়িয়ে করোনা যখন ইউরোপে আঘাত হেনেছে, স্বাস্থ্য খাতের মানুষজন তখন আমাদের প্রস্তুতির প্রসঙ্গ তুলছেন। মন্ত্রী মহোদয় সবাইকে আশ্বস্ত করে বলে দিলেন যে কোনও চিন্তা নেই, আমাদের প্রস্তুতি ইউরোপ আমেরিকার চেয়ে ভালো। পরে জানা গেলো ১৬ কোটি মানুষের জন্য তিনি ২০০০ টেস্ট কিট নিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন। সমস্যা যখন এসেই গেলো, তখন ডাক্তারদের নিরাপত্তার জন্য পিপিইর প্রশ্ন এলো। তিনি বলে দিলেন, পিপিই ছাড়াই ডাক্তাররা রোগী দেখতে পারেন। মাঝে আরও অনেক জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য দেওয়ার পর, ক’দিন আগে ২০০০ ডাক্তার নিয়োগ উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে তাদের উদ্দেশে বললেন, কোভিড তাঁদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ, যেহেতু এ কারণেই তারা চাকরি পেয়েছেন! স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কোনও কথায়ই মানুষ আর অবাক হয় না। তবে তাঁর এই দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি, সচেতন মানুষ মাত্রেরই ক্ষোভের কারণ হয়েছে। 

এছাড়া আরও দুটি বাক্য  স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং আরও অনেক নেতা মন্ত্রী অবিরাম বলে যাচ্ছেন (বাধ্য হয়ে কিছু উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাও)। এক. সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি অনেক ভালো। দুই. সরকারের সমালোচনা করার আগে সমালোচকদের উচিত ইউরোপ আমেরিকার দিকে তাকানো।

এ কথা অবশ্যই ঠিক যে ইউরোপ আমেরিকার মতো বিপুল সংখ্যক সংক্রমণ বা মৃত্যু বাংলাদেশে ঘটেনি। তবে একটা বিষয় ভুলে গেলে চলবে না যে, কোভিড সংক্রমণ এবং মৃত্যুর ধরন পৃথিবীর একেক অঞ্চলে একেক রকম। জলবায়ু, ডেমোগ্রাফিক প্যাটার্ন, এমনকি ভাইরাসের স্ট্রেইনের ভিন্নতা এর কারণ হতে পারে। এমনকি উত্তর ইউরোপ এবং দক্ষিণ ইউরোপের মধ্যেও সংক্রমণের ব্যাপকতার বিশাল পার্থক্য রয়েছে। ইতালির তুলনায় সুইডেনে সংক্রমণ হার অনেক কম। তারপরও সুইডেনের সরকারের নীতিমালা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, কারণ সেখানে সংক্রমণের হার প্রতিবেশী নরওয়ে, ডেনমার্ক ইত্যাদি নরডিক দেশের তুলনায় অনেক বেশি। 

আমাদের নিজেদের মূল্যায়ন করতে হবে তাই আঞ্চলিক দেশগুলোর পরিস্থিতির আলোকে, বিশ্বের অন্য প্রান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নয়। আরেকটা কথা ভুলে গেলে চলবে না। ইউরোপে কোভিড ১৯ ঢুকে গিয়েছিল চুপিসারে, রোগটির ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষমতা উপলব্ধি করার আগেই। যতদিনে পূর্ণ সচেতনতা এলো, ততদিনে বিশাল সংখ্যক মানুষের মাঝে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস এসেছে সোচ্চারে, ঢাকঢোল পিটিয়ে। নিতান্ত বধির না হলে এর তূর্যনিনাদ শুনতে না পাওয়ার কোনও কারণ নেই। আমেরিকা নিয়ে আলোচনা করলাম না। সে দেশে ৫১টি সরকার, সবাই স্বাধীন, কেউ কারও কথা শোনে না। তার সঙ্গেও ট্রাম্প ফ্যাক্টর তো আছেই। 

দক্ষিণ-দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় আমাদের অবস্থান কেমন? এ দেশগুলোতে কোভিড ১৯-এর সক্রিয় আক্রমণ শুরু হয়েছে মার্চের প্রথমদিকে। মার্চের ১০ তারিখে বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩ জন, শ্রীলংকায় ১, ইন্দোনেশিয়ায় ২৭, ফিলিপাইনে ৩৩, থাইল্যান্ডে ৫৩, ভারতে ৬২। (মার্চের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল খুবই কম, মাত্র ৪৯।) এক মাস পর, ১০ এপ্রিল যখন বাংলাদেশে সংক্রমণের সংখ্যা ৪২৪-এ পৌঁছালো, শ্রীলংকা (১৯০) বাদে বাকি সবাই তখন হাজারের অঙ্কে। তখনও পর্যন্ত সংক্রমণের সংখ্যায় বাংলাদেশের অবস্থান তালিকার নিচের দিকে। এরপরই শুরু হয় একে একে বহু দেশকে ডিঙিয়ে বাংলাদেশের ঊর্ধ্বযাত্রা। মে মাসের ১০ তারিখে এদের মধ্যে ভারত বাদে বাকি সবাইকে ডিঙিয়ে বাংলাদেশ উঠে এসেছে বিশ্ব তালিকায় ৩০ নম্বরে। এদিন বাংলাদেশের ১৪ হাজার ৬৫৭ জনের বিপরীতে ইন্দোনেশিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন ১৪ হাজার ৩২, ফিলিপাইনে ১০ হাজার ৭৯৪, থাইল্যান্ডে ৩ হাজার ৯, শ্রীলংকায় ৮৫৬, ভারতে ৬৭ হাজার ১৬১ জন । আরও আছে, চীন সীমান্তবর্তী ভিয়েতনামে আক্রান্ত হয়েছে মোট ৩২৪, মৃত্যু হয়নি কারোই। নেপালে সংক্রমণ সংখ্যা ৩৭৫, মারা গেছেন ২ জন। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে সংক্রমণের সংখ্যায় নতুন রেকর্ড হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন। আজ পর্যন্ত সংক্রমণের সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি। এ হার বাড়ছে যে স্বল্পসংখ্যক দেশে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। এ অঞ্চলে পাকিস্তানের অবস্থা শুধু বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ, কিন্তু সে দেশটি তো বেঞ্চমার্ক হতে পারে না বাংলাদেশের জন্য। নিতান্ত যদি কাউকে অনুসরণ করতে হয়, সেটা শ্রীলংকা হতে পারে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, দূরে না তাকিয়ে কাছাকাছি দৃষ্টি দিলে আমাদের অবস্থানকে আর অতটা রঙিন মনে হচ্ছে না। আর নিতান্তই যদি দূরে দেখতে ইচ্ছে হয়, তাহলে তাকানো যাক নাইজেরিয়ার দিকে। আফ্রিকার এই দেশটির লোকসংখ্যা, অর্থনীতি, সুশাসনের ঘাটতি সবই প্রায় আমাদের মতো। ১০ মার্চে সেখানে সংক্রমণ সংখ্যা ছিল ২ (বাংলাদেশ ৩), ১০ এপ্রিলে ৩০৫, আর ১০ মে তারিখে ৪,৩৯৯। নাইজেরিয়া যেটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে কোভিড ১৯, আমরা তাও পারিনি।

সংখ্যা নিয়েই যেহেতু বিশ্লেষণ হচ্ছে, দেখা যাক কোথায় কতজন মারা গেলেন। বাংলাদেশে এযাবৎ মৃত্যু ৩৭০, ইন্দোনেশিয়ায় ১১৯১, ফিলিপাইনে ৮৩১, থাইল্যান্ডে ৫৬, শ্রীলংকায় ৯, ভারতে ৩১৬৪। বাংলাদেশের সংখ্যাটাকে অতটা আর বড় বলে মনে হচ্ছে না। তবে দুটো বিষয় ভুলে গেলে চলবে না। এর বাইরেও করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর খবর আসছে নিয়মিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের হিসেবে এই সংখ্যাটা গত দুই মাসে ৯৩২। এরা সবাই হয়তো কোভিডে মারা যাননি, তবে অনেকেই যে গেছেন তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সেক্ষেত্রে আমাদের সংখ্যাটা অতো  ছোট নয়। দ্বিতীয়ত, যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই সুস্থ হয়ে উঠবেন, তবে তার মাঝে কিছু মৃত্যুবরণও করবেন। জার্মানিতে এ মৃত্যুর হার শতকরা ৫ ভাগ, আমাদের দেশে ৭ ভাগ। অর্থাৎ যে ২৫,০০০ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, দুঃখজনকভাবে তাদের ৭ শতাংশ, কমবেশি ১৭৫০ জন মৃত্যুবরণ করতে পারেন। সেই সঙ্গে অব্যাহত নতুন সংক্রমণ তো আছেই।

‘আমাদের অবস্থা অনেক ভালো’- এই বাক্যাংশের  সঙ্গে তাই একমত হওয়া যাচ্ছে না। দেখা যাক বাক্যের বাকি অংশের কি অবস্থা। ‘সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত’– তাই কী? অনেক বরং ‘বেঠিক’ সিদ্ধান্ত চোখে পড়ে। যা বলছিলাম, কভিড-১৯ চুপিসারে ঢোকেনি বাংলাদেশে। ইউরোপে দাবানলের আকার পাবার পরও অন্তত এক মাস সময় পেয়েছে বাংলাদেশ, বাগাড়ম্বর ছাড়া প্রস্তুতি প্রায় কিছুই হয়নি এ সময়ে। মাত্র একটি হাসপাতাল আধা প্রস্তুত করা হয়, সারা দেশের রোগী শনাক্তে মাত্র একটি পরীক্ষাগার, ডাক্তারদের সুরক্ষার ব্যবস্থা না করা, চীন ইতালি থেকে আসা সম্ভাব্য সংক্রমণকারীদের সারা দেশে অবাধে ছড়িয়ে পড়তে দেওয়া, শ্রমিকদের ঢাকায় আনা এবং ফেরত পাঠানো, গণস্বাস্থ্যের টেস্ট কিট নিয়ে অসহযোগিতা এবং কালক্ষেপণ- তালিকা অনেক দীর্ঘ। দেশের স্বাস্থ্য প্রশাসনের অদক্ষতায় শুধু করোনা চিকিৎসা নয়, সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা খাতই মুখথুবড়ে পড়েছে। 

এই আত্মপ্রসাদ থেকে তাই বেরিয়ে আসতে হবে। করোনা মহামারি খুব শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে এমন আশা করছেন না বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ। টিকা বা নতুন ওষুধের ব্যাপারেও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। করোনার বিরুদ্ধে এ লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, আর ততদিন জীবন জীবিকা বন্ধ করে রাখা যাবে না। প্রস্তুতি নিতে হবে করোনা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসে পাশাপাশি অর্থনীতির চাকা সচল করার, যেমন শুরু হয়েছে ইউরোপে। আগামীতে এটাই হবে একরকম ‘নিউ নরমাল’। কিছু মানুষ সংক্রমিত হবেন, সঙ্গে সঙ্গে তাদের, এবং তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছেন সবাইকে খুঁজে বের করে দ্রুত বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে ভিয়েতনামের মতো। সহজ এবং ব্যাপক টেস্টের ব্যবস্থা করতে হবে অন্তত জেলা পর্যায় পর্যন্ত। সব মিলিয়ে নিয়ন্ত্রণের একটি কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ‘সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত’ নিয়ে কাজে নামতে হবে। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সে সময়টা এখনই।

লেখক: প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধবিরতির ‘চূড়ান্ত’ প্রস্তাবে হামাসের সিদ্ধান্ত জানা যাবে: ট্রাম্প
২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধবিরতির ‘চূড়ান্ত’ প্রস্তাবে হামাসের সিদ্ধান্ত জানা যাবে: ট্রাম্প
বিলবাওয়ে নতুন চুক্তি করে বার্সায় যাওয়ার গুঞ্জনে ইতি টানলেন উইলিয়ামস
বিলবাওয়ে নতুন চুক্তি করে বার্সায় যাওয়ার গুঞ্জনে ইতি টানলেন উইলিয়ামস
চট্টগ্রামে আরও তিন জনের করোনা শনাক্ত
চট্টগ্রামে আরও তিন জনের করোনা শনাক্ত
ব্রাজিল বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখছেন বাংলাদেশের অধিনায়ক!
ব্রাজিল বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখছেন বাংলাদেশের অধিনায়ক!
সর্বশেষসর্বাধিক