X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্পের কারণে ‘ভোট রঙ্গ’ হতে পারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী
২৭ আগস্ট ২০২০, ১৩:৩৮আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০২০, ১৩:৩৯

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করার জন্য যে প্রাইমারি ভোটের আয়োজন করা হয় করোনার কারণে তা এবার সুষ্ঠুভাবে হয়নি। আবার ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান প্রার্থী হওয়ার প্রথা অনুযায়ী রিপাবলিকান প্রার্থী মনোনয়নের জন্য কোনও প্রাইমারি নির্বাচনের প্রয়োজন নেই। সুতরাং এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে বিশ্বব্যাপী আগের নির্বাচনগুলো থেকে উত্তেজনা কম। অথচ নির্বাচনের আর মাত্র দুই মাস বাকি। আগামী ৩ নভেম্বর ২০২০ এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
চূড়ান্ত মনোনয়ন প্রদানের জন্য ডেমোক্র্যাটদের জাতীয় কনভেনশন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনের মিলওয়াকি শহরে ১৭ আগস্ট আরম্ভ হয়েছিল। একুশে আগস্ট মনোনয়ন চূড়ান্ত করার পর কনভেনশন শেষ হয়েছে। করোনার কারণে কনভেনশন ছিল অনলাইনভিত্তিক। অন্যদিকে, ২৪ আগস্ট উত্তর ক্যারোলিনার শার্লোটে আয়োজিত রিপাবলিকান পার্টির জাতীয় সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এবং তার রানিংমেট হিসেবে আবারও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনয়ন দিয়েছেন রিপাবলিকানরা। মনোনয়নের জন্য ভোট দিতে তিন শতাধিক দলীয় প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।

ডেমোক্র্যাট পার্টির কনভেনশনে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে জো বাইডেনকে এবং তার রানিংমেট হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত সিনেটর কমলা হ্যারিস। প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থীর বয়স ৭৭ বছর। তিনি এর আগেও দুই দুইবার বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। প্রশাসক হিসেবে তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং খ্যাতি রয়েছে। তার রানিংমেট কমলা হ্যারিস দুই ইমিগ্র্যান্টের সন্তান। মা শ্যামলা গোপালন এসেছিলেন ভারত থেকে আর তার বাবা ডোনাল্ড হ্যারিস এসেছিলেন জ্যামাইকা থেকে। কমলার জন্ম ক্যালিফোর্নিয়ার অকল্যান্ডে। তিনি নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গ বলে দাবি করলেও শতভাগ কৃষ্ণাঙ্গ নন। কমলার গায়ের রঙ আর জন্ম নিয়ে কটাক্ষ করেছেন ট্রাম্প। তিনি বলেছেন কমলা নাকি জন্মসূত্রে আমেরিকান নন। 

কমলার মনোনয়ন ক্যারিবীয় ও ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের মাঝে কিছুটা যে প্রভাব ফেলবে না তা নয়। পরিসংখ্যান বলছে ৪ শতাংশ ক্যারিবিয়ান আর দশমিক ৯ শতাংশ ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভোটার রয়েছে। মায়ের ধর্মের প্রতি তার ভক্তি আছে, আবার বাবার ধর্মের প্রতি অনুরাগে কমলা চার্চে যান। তার বাবা-মা উচ্চশিক্ষিত এবং পিএইচডি ডিগ্রির অধিকারী। তার বাবা ডোনাল্ড জে হ্যারিস স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। তিনি আইনজীবীও। অনেকদিন ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। মা ব্রেস্ট ক্যানসারের গবেষক এবং মায়ের দ্বিতীয় স্বামী ধর্মে ইহুদি। কমলার শ্বেতাঙ্গ স্বামী ডগলাস এমহফ একজন আমেরিকান আইনজীবী। কমলা প্রাইমারিতে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, কিন্তু হেরে যান। এখন বাইডেন তাকে রানিংমেট হিসেবে পছন্দ করেছেন। 

২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ট্রাম্প এবং রানিংমেট মাইক পেন্স গত চার বছর ক্ষমতায়। রাষ্ট্রশাসনের প্রচুর ব্যর্থতা রয়েছে তাদের। বিশেষ করে করোনা সামাল দিতে ট্রাম্প পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। করোনায় এক লাখ ৭০ হাজার নাগরিক গত ৫ মাসে প্রাণ হারিয়েছে। গত চার বছরের শাসনকালে তার এমন কোনও বড় সফলতা নেই, যা দিয়ে এই ব্যর্থতা ঢেকে দেওয়া যায়।

উন্নত বিশ্বে জনমত জরিপে আগাম ফলাফল আন্দাজ করা যায়, যদিওবা সব সময় জরিপের ফলাফল অনুসারে কাজ হয় না। ২০১৬ সালের নির্বাচনে দেখা গেছে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন মতামত জরিপে এগিয়ে ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে ট্রাম্পের। এখনও জো বাইডেন মতামত জরিপে ৮ শতাংশ ভোটে এগিয়ে আছেন। বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া, রাষ্ট্রশাসনের কোনও চমক সৃষ্টি করতে না পারা, ক্ষমতায় থাকার সময় আত্মীয় তোষণ, নিজের ব্যক্তিগত যৌন কেলেঙ্কারি—সব মিলিয়ে এবারের নির্বাচন ট্রাম্পের অনুকূলে যাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না।

জনসাধারণ যতই সম্পৃক্ত থাকুক না কেন, যিনি জনসাধারণের সর্বোচ্চ ভোট পাবেন তিনিই প্রেসিডেন্ট হবেন এমন নিয়ম মার্কিন নির্বাচনে নেই। সব অঙ্গরাজ্য থেকে নির্দিষ্ট ৫৩৮ জন ইলেকটোরাল কলেজের মধ্যে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য পাবে (ন্যূনতম ২৭০ সদস্য) সে দলের প্রার্থীই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। যে রাজ্যে যে দল বেশি ভোট পাবে সব ইলেকটোরাল কলেজ তাদের। উইনার-টেইকস-অল, পরাজিতরা হিসাবের খাতায় আসবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনভোট পেয়েও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত না হওয়ার নজির রয়েছে। এমনকি গত নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চেয়ে হিলারি ৩০ লাখ ভোট বেশি পেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি হেরে যান এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

২০২০-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে রাজ্যগুলোকে ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট রয়েছে টেক্সাস রাজ্যের—৩৮। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, এখনকার জরিপে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেসব রাজ্যে এগিয়ে আছেন সেগুলো হচ্ছে—জর্জিয়া, আইওয়া এবং টেক্সাস। কিন্তু এখানে ব্যবধান খুব সামান্য। গত নির্বাচনেও এসব রাজ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু ভোটের ব্যবধান ছিল আরও  অনেক বেশি।

জো বাইডেন এগিয়ে আছেন অ্যারিজোনা, ফ্লোরিডা, মিশিগান, মিনেসোটা, নেভাদা, নিউ হ্যাম্পশায়ার, নর্থ ক্যারোলাইনা, ওহাইও, পেনসালভেনিয়া, ভার্জিনিয়া এবং উইসকনসিন রাজ্যে। জো বাইডেনের জন্য ভালো খবর হচ্ছে এসব রাজ্যে তিনি বড় রকমের ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। শুধু তাই নয়, ২০১৬ সালের নির্বাচনে এসব রাজ্যের অধিকাংশতেই ব্যাপক ভোটে জয়ী হয়েছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু এসব রাজ্যে এখন এগিয়ে গেছেন জো বাইডেন।

এবারের ভোটে ট্রাম্প গণ্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করছেন। পোস্টাল ভোট সম্পর্কে ট্রাম্পের ঘোরতর আপত্তি আছে। অথচ করোনার কারণে এবার পোস্টাল ভোট বেশি হবে বলে সবার ধারণা।
ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান সমর্থকদের উদ্দেশে বলছেন, ‘এবারের নির্বাচনে আমাদের হারার সম্ভাবনা একমাত্র একটা কারণেই—যদি নির্বাচনে কারচুপি হয়।’ তার প্রতিপক্ষ জো বাইডেন একটি টকশোতে কঠিন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ‘প্রেসিডেন্ট এই নির্বাচনে চুরি করতে যাচ্ছেন।’ সবচেয়ে নজিরবিহীন বিষয় হলো এ প্রসঙ্গে তারা দুজনেই ডাক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।

চার বছর আগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সামাজিক মাধ্যমে জনমত জরিপের সন্দেহজনক অ্যালগরিদিম বা হিসাবনিকাশ, রুশ হ্যাকিং এবং গোপন দলিল পত্র ফাঁস এসব নিয়ে হুলুস্থুল হয়েছিল। এবারও মার্কিন নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপের আশঙ্কা করছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি সেন্টারের (এনসিএসসি) পরিচালক উইলিয়াম ইভানিনা চীন, রাশিয়া এবং ইরানের নাম উচ্চারণ করে হুঁশিয়ার করেছেন যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে বিদেশি কয়েকটি রাষ্ট্র তৎপরতা শুরু করেছে। তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, চীন চাইছে না ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার জিতে হোয়াইট হাউসে থেকে যান। অন্যদিকে রাশিয়া ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের ক্ষতি করতে চাইছে।

মার্কিন গোয়েন্দারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনে কাজ করেছে। তার বিবৃতি অনুযায়ী—এবারও মস্কো চায় ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন ক্ষমতায় থেকে যান। অবশ্য রাশিয়া সবসময় বলে এসেছে তারা মার্কিন নির্বাচনে বা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কখনও মাথা গলায়নি।

জানি না, শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পের হেন-তেন কর্মকাণ্ডের কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আগের মতো না হয়ে ‘ভোট-রঙ্গে’ পর্যবসিত হয় কিনা। ট্রাম্প ক’দিন আগে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছেন, এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল পেতে বছরের পর বছর সময় লাগতে পারে। আর মাঝখানে শাসনতন্ত্র অনুসারে এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে স্পিকার ‘পাগলী’ ন্যান্সি পেলোসি (ডেমোক্র্যাটিক দলীয়) মধ্যবর্তী প্রেসিডেন্টও হয়ে যেতে পারেন।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রিক্রুটিং এজেন্সিকে মানবিক হওয়ার আহ্বান প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর
রিক্রুটিং এজেন্সিকে মানবিক হওয়ার আহ্বান প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর
চুয়াডাঙ্গায় বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ, তাপমাত্রা ৪০.৬ ডিগ্রি
চুয়াডাঙ্গায় বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ, তাপমাত্রা ৪০.৬ ডিগ্রি
জার্মানির বিশ্বকাপ জয়ী স্ট্রাইকার পরপারে
জার্মানির বিশ্বকাপ জয়ী স্ট্রাইকার পরপারে
আপনি কি টক্সিক প্যারেন্ট? বুঝে নিন এই ৫ লক্ষণে
আপনি কি টক্সিক প্যারেন্ট? বুঝে নিন এই ৫ লক্ষণে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ