X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘মরা সাপ পেটানো’র সাংবাদিকতা!

প্রভাষ আমিন
০১ নভেম্বর ২০২০, ১৫:২৩আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০২০, ১৫:২৫

প্রভাষ আমিন ইদানীং কারণে-অকারণে মানুষ সাংবাদিকদের গালি দেয়। কারণ তো নিশ্চয়ই কিছু আছে, সে আলোচনায় আসছি। তবে সাংবাদিকদের অকারণেই বেশি গালি খেতে হয়। সাধারণ মানুষ নিজেদের ব্যর্থতা, অবদমনের দায় সাংবাদিকদের ঘাড়ে চাপিয়ে ইচ্ছামতো মনের ঝাল মিটিয়ে গালি দেন। ইদানীং সমালোচকরা সাংবাদিকদের বলেন—আপনারা তো ‘মরা সাপ পেটানোর সাংবাদিকতা’ করেন। কোনোভাবে ফাঁদে পড়ে সাপ মরে গেলে তারপর ইচ্ছামতো পিটিয়ে বীরত্ব দেখান। অভিযোগটা বেশ ইন্টারেস্টিং এবং আমি এর সঙ্গে অনেকটাই একমত। অবশ্য একমত না হয়ে উপায় নেই। দ্বিমত করলেই গাদা গাদা উদাহরণ দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেবেন। সর্বশেষ উদাহরণ হলেন ইরফান সেলিম।
সম্প্রতি যখন সাংসদ হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের গাড়ি থেকে নেমে তিনি ও তার দেহরক্ষীরা নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে পিটিয়ে দাঁত ভেঙে দিলেন, তার স্ত্রীকে লাঞ্ছিত করলেন; অনেক গণমাধ্যম বিষয়টি প্রচারই করেনি। সরকারি দলের সাংসদের ছেলে পিটিয়েছে নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে। দুদিকেই স্পর্শকাতর।

সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে কয়েকটি গণমাধ্যমই বিষয়টি এড়িয়ে গেলো। কী লিখলে কার পক্ষে যায়, কী লিখলে কে বেজার হয়; সম্ভবত এই ভয়ে। কিন্তু পরদিন যখন র‌্যাব সাঁড়াশি অভিযান শুরু করলো, তখন সাংবাদিকরাও বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ইরফান সেলিম এবং তার পিতা হাজী সেলিমের অপকর্মের ফিরিস্তি এখন পত্রিকার পাতায় পাতায়, টেলিভিশনের পর্দাজুড়ে। র‌্যাব অভিযানের পর এখন সাংবাদিকরা বীরত্ব ফলাচ্ছে। চলছে মরা সাপ পেটানোর সাংবাদিকতা। অথচ এই হাজী সেলিম এই ঢাকায় রাজত্ব করছেন তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে। হাজী সেলিমের ছেলে এখন যা করেছে, এই কাজ বা এ ধরনের কাজ তিনি বছরের পর বছর ধরেই করে আসছেন। সাংবাদিকরা তাহলে এতদিন কোথায় ছিলেন?

এই প্রশ্নে এখন সোচ্চার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সাধারণ মানুষ তো বটেই, সাংবাদিকদের কেউ কেউও তুলেছেন এই প্রশ্ন। খুবই ন্যায্য প্রশ্ন। এমন উদাহরণ আরও অনেক আছে। যুবলীগ নেতা সম্রাট খোদ রাজধানীতে বসে ঢাকার ক্লাবপাড়াকে ক্যাসিনোপল্লি বানিয়ে ফেলেছিলেন। মোহামেডান, ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়ার মতো ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলো ফুটবল খেলা ফেলে জুয়া খেলায় মেতে উঠলো। আমরা কেউ জানতেই পারলাম না। পাপিয়া গ্রেফতার হওয়ার আগে আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি রাজধানীর অভিজাত হোটেলগুলোতে কী রকমের রঙ্গমহল বসে।

ওসি প্রদীপ বা এসআই আকবরের সম্পদের বিবরণ পত্রিকায় ছাপা হলো, তারা ধরা খাওয়ার পর। দেশে কি আর কোনও প্রদীপ বা আকবর নেই? তাদের সম্পদের বিবরণ লিখতেও আমরা ধরা খাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবো?

সাধারণভাবে অভিযোগ হলো, সাংবাদিকরা সরকারের অনুগত। তাই তারা সরকারের মনোভাবের অপেক্ষায় থাকে। সাংবাদিকতার নামে তারা যেদিকে মেঘ, সেদিকেই ছাতা ধরার কৌশলে দিন কাটাচ্ছে। এটা সত্যি, বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বড় রকমের ঘাটতি রয়েছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য যে সময় ও বিনিয়োগ করা দরকার, অনেকেই তা করতে পারেন না। তাই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাও গতি পায় না।

আবার এটাও ঠিক নয়, সাংবাদিকরা পুলিশও নয়, গোয়েন্দাও নয়। চাইলেই তারা সব কাজ করতে পারে না, সব জায়গায় যেতে পারে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর গণমাধ্যমের মধ্যে ফারাক আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চাইলেই আপনি লিখে দিতে পারবেন, হাজী সেলিম দখলবাজ। কিন্তু একজন সাংবাদিককে এই দুই লাইন লিখতে অনেক পরিশ্রম করতে হবে, তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করতে হবে; যেটা খুব সহজ নয়। ১৬ তলা ভবনে হাজী সেলিমের টর্চার সেলে সাংবাদিকরা যেতে পেরেছে র‌্যাবের অভিযানের কারণেই। সাধারণ সময়ে কোনও সাংবাদিকের পক্ষে সেখানে গিয়ে সরেজমিন রিপোর্ট করা সম্ভব হতো না।

পুলিশ ধরার আগে সাংবাদিকদের না লেখার অনেক কারণ থাকতে পারে। হতে পারে, সাংবাদিকরা কিছু জানতেনই না। এটা তাদের অযোগ্যতা, অদক্ষতা হতে পারে; কিন্তু অসততা নয়। হতে পারে তারা জেনেও ভয়ে চুপ করে থাকলো। সেটা তাদের সাহসের অভাব হতে পারে। কিন্তু যদি জেনেও ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা কোনও স্বার্থের কারণে মুখ বন্ধ রাখে; তাহলে অবশ্যই সেটা তাদের পেশাগত অসততা।

এখানে আমি সাংবাদিকদের কিছুটা বেনিফিট অব ডাউট দিতে পারি। দুর্বৃত্তরা ধরা পড়ার আগে আমরা তেমন কিছু জানতে পারি না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা অদক্ষতা। ক্যাসিনোকাণ্ডের পর দেখা গেছে, সাংবাদিকরা আসলে সেটা জানতেনই না। তারচেয়ে বড় কথা হলো, ব্যাপকভাবে না হলেও হাজী সেলিমের বিরুদ্ধেই কিন্তু লিখেছে সাংবাদিকরা। হাজী সেলিম টাকা দিয়ে পদ-পদবি কিনতে পারলেও, সাংবাদিকদের কিনতে পারেননি। কোনও গণমাধ্যমেই কখনও হাজী সেলিমের পক্ষে কিছু লেখা হয়নি। সাধারণে হাজী সেলিম সম্পর্কে ধারণাই ছিল, তিনি মাস্তান, দখলবাজ; বড় জোর রাজনৈতিক ক্লাউন। শুধু হাজী সেলিম নন, সম্রাটের পক্ষেও কিন্তু সাংবাদিকরা কখনও কলম ধরেনি। টেকনাফের বদি, নারায়ণগঞ্জের শামিম ওসমান, ফেনীর জয়নাল হাজারী বা লক্ষ্মীপুরের তাহেরের নেতিবাচক ভাবমূর্তি কিন্তু সাংবাদিকদেরই তৈরি করা। রিজেন্টের সাহেদের কুকীর্তি কিন্তু সাংবাদিকরাই ফাঁস করেছে। সরকার মারার আগে এরা সম্রাট, হাজী সেলিম বা সাহেদরা কিন্তু বিষধর সাপ। সেই সাপের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস বা সামর্থ্য সবার থাকে না। সাংবাদিকরাও তো এই সমাজের মানুষই। তাদেরও পরিবার-পরিজন নিয়ে এই দেশেই থাকতে হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা সাংবাদিকদের ঘাড়ে সব দায় চাপিয়ে নিজেরা নিরাপদ থাকতে চান, তাদের কাছে জানতে ইচ্ছা করে, সাংবাদিকরা না হয় দালাল, ব্যর্থ। কিন্তু আপনারা এতদিন কী করেছেন? আপনারা এলাকার এমপি বা তার ছেলের অপকর্ম নিয়ে কি কখনও ফেসবুকে একটি লাইন লিখেছেন। নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে পেটানোর আগে হাজী সেলিম বা তার ছেলে বা তাদের দেহরক্ষীরা নিশ্চয়ই একই ধরনের কাজ আগেও করেছেন। কিন্তু কেউ কি মুখ খুলেছেন, পুলিশের কাছে গেছেন? আপনি অভিযোগ না করলে সাংবাদিকরা তথ্য পাবে কোত্থেকে? বাতাসে উড়ে বেড়ানো অভিযোগ তো সাংবাদিকদের কাছে তথ্য নয়। আমি নিশ্চিত, সেদিনের ঘটনায় ভিকটিম নৌবাহিনী কর্মকর্তা না হয়ে সাধারণ মানুষ হলে, তিনিও অভিযোগ করতেন না। অভিযোগ করলেও পুলিশ থানায়ই বিষয়টি মিটমাট করে ফেলতো। পুরান ঢাকার মানুষ হলে বলতো, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তার দাঁত ভেঙেছে। তাই অকারণে সাংবাদিকদের গালি না দিয়ে বাস্তবতার নিরিখে নিজের অবস্থান বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিন। হাজী সেলিমের ছেলের ঘটনার পর সবাই এমনভাবে সাংবাদিকদের আক্রমণ করেছেন, মনে হচ্ছে হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে লিখে তারা বিশাল অন্যায় করে ফেলেছে। আগে লেখেনি বলে যেন কখনও লেখা যাবে না।

সাংবাদিকদের মধ্যে যারা প্রশ্ন তুলেছেন; তাদের বলি, আপনি কেন লেখেননি বা আপনার প্রতিষ্ঠানকে কেন বাধ্য করেননি। কারও দিকে আঙুল তুলে নিজের দায় এড়ানো যাবে না। দায়টা আমাদের সবার। প্রতিবাদটাও হতে হবে সার্বজনীন। সাংবাদিকরা কিন্তু তথ্য তুলে ধরবে, প্রতিবাদ করবে না। প্রতিবাদটা করতে হবে সবাইকে।

তবে সাংবাদিকদের প্রতি সাধারণ মানুষের এই ক্ষোভ, আক্রমণ, গালিকে আমি ভালোবাসা হিসেবেই গ্রহণ করি। আমি জানি গণমাধ্যমের কাছে সাধারণ মানুষের অনেক প্রত্যাশা। সেখানে কোনও বিচ্যুতি দেখলেই তারা হতাশায় ভোগেন, গালি দেন। এখনও মানুষ বিপদে পড়লে আগে সাংবাদিকদের কাছেই ছুটে আসে। সংসদে এবং রাজপথে বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে জনগণের কণ্ঠ তুলে ধরার একমাত্র উপায় গণমাধ্যম। সরকারের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, গণতন্ত্রহীনতা, সরকারি দলের নেতাদের গণবিচ্ছিন্নতা সবই কিন্তু গণমাধ্যম তুলে ধরে। আপনারা যে তথ্য নিয়ে ফেসবুকে বিপ্লব করেন, যে লিঙ্ক শেয়ার করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন; সেটাও কিন্তু কোনও না কোনও সাংবাদিকেরই লেখা।

গণমাধ্যম আপনার মাধ্যম, আপনার কণ্ঠস্বর। গণমাধ্যমের ভুল হলে ধরিয়ে দিন। কিন্তু ঢালাও নির্দয় আক্রমণে তাদের দূরে ঠেলে দেবেন না। পাশে থাকুন, গণমাধ্যমও সাহস হয়ে আপনার পাশে থাকবে।

 

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ



/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএনপি নেতারা ‘সিম্প্যাথি কার্ড’ খেলার অপচেষ্টা করছে: কাদের
বিএনপি নেতারা ‘সিম্প্যাথি কার্ড’ খেলার অপচেষ্টা করছে: কাদের
গ্রন্থাগার অধিদফতরের কাজে গতি আনতে কামাল চৌধুরীর আহ্বান
গ্রন্থাগার অধিদফতরের কাজে গতি আনতে কামাল চৌধুরীর আহ্বান
মীরসরাই প্রেসক্লাবের নতুন কমিটি ঘোষণা
মীরসরাই প্রেসক্লাবের নতুন কমিটি ঘোষণা
এআইইউবিতে সিএস ফেস্ট
এআইইউবিতে সিএস ফেস্ট
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ