X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

আওয়ামী লীগের ঘর গোছানো কেন জরুরি

আবদুল মান্নান
৩০ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:৫৫আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:৫৬








আবদুল মান্নান একটি বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিকের প্রধান শিরোনাম ‘ঘর গোছাতে ব্যস্ত আওয়ামী লীগ’। খবরে আরও বলা হয়েছে, করোনাকালে স্থবিরতা কাটিয়ে ঘর গোছাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ। সংবাদটি যেদিন প্রচারিত হয় সেদিন রাতে একটি টিভি টকশোতে অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ পাই। ইদানীং টকশোতে তেমন একটা অংশগ্রহণ করা হয় না। গত দশ মাস স্বেচ্ছা গৃহবন্দি। যেহেতু বিষয়টার প্রতি আমার আগ্রহ আছে সেহেতু রাজি হলাম। অনুষ্ঠান যথারীতি অনলাইনে। সেদিনের রাতের অনুষ্ঠানে আমি ছাড়াও তিনজন বিচক্ষণ আলোচক, যাদের একজন সরকারি দলের সংসদ সদস্য, সাথে সুপ্রিম কোর্টের একজন সাবেক বিচারক। অন্য জন আমার মতো আওয়ামী লীগের শুভার্থী,  বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ও উপাচার্য। সময় পঁয়তাল্লিশ মিনিট। মাঝখানে দশ মিনিট বিজ্ঞাপন বিরতি। আলোচনা কতটুকু অর্থবহ তা বোঝা যায়। বেশিরভাগ টকশোর অবস্থা একই রকম। বিজ্ঞাপন বিরতির ফাঁকে ফাঁকে দু’চারটি কথা। সাথে তো সঞ্চালকের অংশগ্রহণ আছেই। এমন পরিস্থিতিতে কোনও অংশগ্রহণকারীর পক্ষে অর্থবহ কোনও আলোচনা করা সম্ভব হয় না। সঞ্চালকরা সম্ভবত দর্শক শ্রোতাদের বিরক্তির বিষয়টা কখনও অনুধাবন করেন না। এমন যখন আমাদের টিভি অনুষ্ঠানগুলোর অবস্থা তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না ভারতের একেবারেই নিম্নমানের অনুষ্ঠানগুলো এ দেশে কেন এত জনপ্রিয়।

ফিরে আসি আওয়ামী লীগের ঘর গোছানো প্রসঙ্গে। শুরুতেই বলে নিই আমি ‘আমার সমালোচক আমার বন্ধু’ প্রবাদে বিশ্বাস করি। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জন্য একটি অমূল্য সম্পদ, যার অবদান এই দেশের যা কিছু অর্জন তার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। প্রয়াত লেখক চিন্তক আহমদ ছফা ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয়ী হলে লিখেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ জিতলে একা জিতে আর হারলে পুরো দেশ হারে’। তিনি কোনও রাজনৈতিক দলের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না, কিন্তু যেহেতু আওয়ামী লীগ জনমানুষের কথা বলে সেহেতু আওয়ামী লীগকে তিনি ভালোবাসতেন বলেই এমন সত্য কথা বলতেন। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে এমন উক্তি করার মানুষ বর্তমানে তেমন একটা পাওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে বোঝা যায় একজন নেতা হতে হলে কত বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিতে হয়। বঙ্গবন্ধু বা তাঁর সহকর্মীদের নেতা হয়ে ওঠার কাহিনি প্রায় একই রকম। তাঁরা কেউ নেতা হয়ে জন্মগ্রহণ করেননি। জনমানুষের প্রতি অঙ্গীকার, পরিশ্রম, ত্যাগ, নির্লোভ চরিত্র তাদের নেতা বানিয়েছে। সকলে কর্মী থেকে কর্মগুণে নেতা হয়েছেন। জনমানুষের প্রত্যাশা ও ভালোবাসার প্রতি অঙ্গীকার রক্ষা করতে গিয়ে তাদের অনেকে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যার ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন, ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রী সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন কিন্তু কখনও কোন পদ পদবির জন্য লালায়িত ছিলেন না। এখন কেউ আর কর্মী হতে রাজি নন। সকলে নেতা হয়ে দলে প্রবেশ করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শুরু হয় আওয়ামী লীগের একশ্রেণির মৌসুমি নেতা নেত্রী আর কর্মীর আবির্ভাব, যাদের সাথে আওয়ামী লীগের রাজনীতির কখনও কোনও সম্পর্ক ছিল না। এদের একটা বিরাট অংশ ছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর দোসর। তাদের কেউ ছিল জামায়াত শিবিরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত, কেউ বা কট্টর বামপন্থী। দলের নাম ব্যবহার করে তারা জড়িয়ে পড়ে চাঁদাবাজি, পারমিটবাজি, পরিত্যক্ত সম্পদ দখল আর নানা ধরনের দুর্নীতিতে। বঙ্গবন্ধু তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে প্রত্যেকটা বক্তৃতায় এই দুর্বৃত্তদের কথা উল্লেখ করে বলতেন, ‘মানুষ পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি’। বলতেন, ‘আমি বিদেশ হতে ভিক্ষা করে যা কিছু আনি তার সবটাই  খেয়ে ফেলে চোরের দল’। সংসদ ও সংসদের বাইরে তাঁর এমন কোনও বক্তৃতা পাওয়া যাবে না যেখানে তিনি এই দুর্বৃত্ত আর দুর্নীতির কথা উচ্চকন্ঠে বলেননি। বঙ্গবন্ধু কন্যা তো এমনি বলেন না ‘আওয়ামী লীগে যদি এত নেতানেত্রী ছিলেন তাহলে আমার বাবার লাশ ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতে কেন ত্রিশ ঘণ্টা পড়ে ছিল?’ উত্তর খুবই সোজা। যারা সে সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে ধান্দাবাজি করতে রাতারাতি জড়িয়ে গিয়েছিল তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল নিজের স্বার্থ উদ্ধার করা। আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলতেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি আদর্শের নাম, আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম।’ বর্তমানে হঠাৎ করে যারা আওয়ামী লীগের নেতানেত্রী বনে গিয়েছেন তাদের ক’জন এই আদর্শ আর অনুভূতি ধারণ করেন?

কেন্দ্রীয় পর্যায়ে হয়তো প্রকৃত অর্থে বঙ্গবন্ধুর ও আওয়ামী লীগের আদর্শ ধারণ করেন তেমন মানুষের অভাব নেই। কিন্তু জেলা উপজেলা পর্যায়ে অনেক জায়গায় পরিস্থিতি তো ভয়াবহ। একই বিষয় নিয়ে একই জেলায় আওয়ামী লীগের দু’জন সংসদ সদস্য যখন বিপরীতধর্মী কথা বলেন তখন বোঝা যায় পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা শহরের দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় করপোরেশনের উদ্যোগে গত কয়েকদিন ধরে অবৈধ বলে অনেক মার্কেট, স্থাপনা ও দোকানপাট উচ্ছেদ চলছে। যাদের স্থাপনা ভাঙা হচ্ছে তারা প্রত্যেকে বলছেন বৈধভাবে সিটি করপোরেশনকে বিরাট অংকের অর্থ দিয়ে এসব দোকান মার্কেট বরাদ্দ বা অংশ বৃদ্ধি করেছেন। এটি হাজার দু’হাজার টাকার ব্যাপার নয়, কোটি কোটি টাকা। আগের মেয়রও আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন, বর্তমান মেয়রও আওয়ামী লীগের। পুরান ঢাকায় বা দক্ষিণ ঢাকায় দুর্নীতির পরিধি কতটুকু বিস্তৃত এটি তার একটি নমুনা মাত্র। সাবেক এবং বর্তমান মেয়র দু’জনই বলছেন তারা যা করেছিলেন বা এখন যা করছেন তা আইনসিদ্ধ। একই বিষয়ে তো দুজনই ভিন্নমুখী কথা বলে নিজেদের বক্তব্য সত্য দাবি করতে পারেন না। শেষ পর্যন্ত এই বিষয়ে যিনি দায়ী তাকে কি আইনের আওতায় আনা হবে? দল থেকে বহিষ্কার মানুষ এ ধরনের অপরাধের জন্য উপযুক্ত শাস্তি বলে মনে করেন না। বঙ্গবন্ধু-উত্তর আওয়ামী লীগের সৌভাগ্য হচ্ছে দলের সংকটকালে দলের হাল ধরার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যাকে পাওয়া গিয়েছিল। তা না হলে আওয়ামী লীগের বিলুপ্তি ঘটতে পারতো। তিনি অনেকটা এককভাবে দাঁড় করিয়ে দীর্ঘ একুশ বছর পর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে গেছেন। কিন্তু যে আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ একুশ বছর পর নিজের জীবন বাজি রেখে ১৯৯৬ ও ২০০৯-এ ক্ষমতায় নিয়ে গেছেন, এখন কি সেই আওয়ামী লীগ আর আছে? সহজ উত্তর,  না নেই। ক্ষমতা, লোভ ও অহংকারের কাছে হারিয়ে গেছে, আর তাতে অবদান রেখেছে নব্য আওয়ামী লীগার বা হাইব্রিড আওয়ামী লীগাররা। এখন আওয়ামী লীগ করতে বঙ্গবন্ধুর বা আওয়ামী লীগের আদর্শের প্রতি অঙ্গীকার থাকার প্রয়োজন নেই। কোনও এক বড় ভাই বা হাইব্রিড নেতার আশীর্বাদই যথেষ্ট। উত্তরাধিকার সূত্রেও হওয়া যায়। পিতা একজন নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগ কর্মী ছিলেন। সন্তান ‘আই হেট পলিটিক্স জেনারেশনের’। সমস্যা নেই। ক’দিন পর দেখা গেলো তিনি পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। পত্রপত্রিকা খুললেই দেখা যায় অমুক জেলার বা উপজেলার জামায়াত বিএনপি’র নেতানেত্রীরা দলে দলে আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছেন বা দলের বিভিন্ন পদ পদবি বাগিয়ে নিচ্ছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, আর দলের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত কর্মীরা তা নীরবে তাকিয়ে দেখছেন। এক এগারোর পর যখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে গ্রেফতার করা হলো তখন এত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী কোথায় ছিল? আওয়ামী লীগের ভাগ্য ভালো তখন দলে একজন জিল্লুর রহমান ছিলেন, যিনি এই বয়সেও দলের ঐক্য আগলে রেখেছিলেন। আর একজন জিল্লুর রহমানকে আওয়ামী লীগে এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। যখন বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ২০১৪ সালে সারাদেশে জামায়াত-বিএনপির পেট্রোলবোমার ভয়াবহ সন্ত্রাস শুরু হলো তখন কোনও টিভি চ্যানেলে এ প্রসঙ্গে নিন্দা জানিয়ে বা সমালোচনা করে কথা বলার লোক পাওয়া যাচ্ছিল না। একদিন আমাকে সিএনজি থ্রি-হুইলারে চড়ে তিনটি টিভিতে যেতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের এক নেতা আমাকে ফোন করে বলেন ‘আপনার কি ভয় ডর নাই? নাকি আগামী সংসদ নির্বাচনে দলের টিকিটে নির্বাচন করবেন’? উত্তরে বলি এর কোনোটাই না। বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ আর তাঁর কন্যার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আছে বলেই এই ঝুঁকি নিই।

অনেকে স্বীকার করুক আর নাই করুক, আওয়ামী লীগে এখন অসংখ্য উইপোকা ঢুকেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা অনেক চেষ্টা করছেন ঘর পরিষ্কার করতে। কিন্তু পেরে উঠছেন বলে মনে হয় না। এই উইপোকাগুলো শুধু যে দলকে কুরে কুরে খাচ্ছে তা নয়, তাদের কারণে সরকারের কত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অনেক হাইব্রিডের লাগামহীনভাবে পদায়ন হচ্ছে। বাজারে একটা কথা এখন খুব চালু আছে আর তা হচ্ছে এই মুহূর্তে দেশে পদ পদবি আর পদক সবকিছুই নিলামে চড়েছে। কেউ কেউ বলে থাকেন, আওয়ামী লীগ বর্তমান অবস্থায় থাকলে শেখ হাসিনার অবর্তমানে দলটি আবার চরম সংকট বিপর্যয়ে পড়বে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর এমন কথা বলতেন আর বিশ্বাস করতেন অনেকে। চেষ্টা কম হয়নি আওয়ামী লীগকে বিলুপ্ত করতে। আওয়ামী লীগ শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও টিকে ছিল। কারণ, দলের নিবেদিতপ্রাণ তৃণমূল কর্মীরা দল ত্যাগ করেনি। এখন দেখার পালা আওয়ামী লীগ ঘর গোছাতে যে ব্যস্ত তা কতটুকু সফল হয় এবং প্রকৃত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা কতটুকু মূল্যায়িত হয়। ২০২০ সাল তো পৃথিবীটা অচল ছিল। নতুন বছর একটি পরিবর্তিত সচল পৃথিবী ও শুদ্ধ হাইব্রিডমুক্ত আওয়ামী লীগ দেশের মানুষ দেখতে পাবে, সেই প্রত্যাশায় আমার লেখার পাঠকদের ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ