X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুজিবনগর সরকারের গৌরবময় পঞ্চাশ বছর

ড. সাজ্জাদ হোসেন
১৬ এপ্রিল ২০২১, ১৩:৪৮আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০২১, ১৭:১৪

ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নির্বাচিত বাঙালি জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করতে চায়নি। ফলশ্রুতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এ দেশের সর্বসাধারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা হাতে নিয়ে নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করা, পরিচালনা করা ও বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে মুজিবনগর সরকার গঠন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় এবং ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহাকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। তৎকালীন মেহেরপুর মুক্ত এলাকা হওয়ার কারণে এবং ১০ এপ্রিল এমএনএ ও এমপিদের কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা বেছে নেয়। অনুষ্ঠিত অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে যুদ্ধ পরিচালনা ও পাক হানাদার বাহিনীকে আমাদের স্বদেশ ভূমি থেকে বিতাড়িত করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান ঘোষিত এবং নির্দেশিত পথে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের লক্ষে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। বাঙালির গৌরবময় মুজিবনগর তথা বাংলাদেশ সরকার এ বছর গৌরবময় ৫০ বছর পূর্ণ করছে।

মুজিবনগর সরকার গঠন
১৯৭০ সালের নির্বাচনে এই দেশের জনগণ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১লা মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে। এমতাবস্থায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তির দিশারী বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক অনন্য সাধারণ ইতিহাসে বিরল মুক্তির ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। শুরু হয় মুক্তির চেতনায় দেশের জন্য লড়াই। ২৫ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এই দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওই রাতেই তারা বাঙালির মুক্তির অগ্রদূত শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের পরিচয় ফুটে ওঠে। ২৫ মার্চের ভয়াবহ গণহত্যার সময় আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান নেতা তাজউদ্দীন আহমদ নিজ বাসভবন ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে সরকার গঠনের পরিকল্পনা করেন। এরইমধ্যে ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি ফরিদপুর-কুষ্টিয়া পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে পৌঁছান। তার সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম। ৩১ মার্চ তাজউদ্দীন মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিদর্শক গোলক মজুমদার যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের পূর্বে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাজউদ্দীন আহমদকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে কোনও সরকার গঠিত হয়েছে কিনা। এমন প্রশ্নের উত্তরে বৈঠকে তাজউদ্দীন ইন্দিরা গান্ধীকে বলেন, ২৫ ও ২৬ মার্চেই বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান সেই স্বাধীন সরকারের প্রেসিডেন্ট আর আমি (তাজউদ্দীন) প্রধানমন্ত্রী। এভাবেই বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়।

আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠন

বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে সর্বপ্রকার সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলে তাজউদ্দীন আহমদ কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে অধিবেশন আহ্বান করেন। উক্ত অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। ১০ এপ্রিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি), তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, এএইচএম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তৎকালীন কর্নেল এমএজি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। এই দিন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। [উৎস: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: তৃতীয় খণ্ড, পৃ-১৬-১৭]

মুজিবনগর সরকারের অন্যতম লক্ষ্য ছিল দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করা। যেন তাদের সমর্থনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা সহজ এবং দ্রুত সফলতা পাওয়া যায়। এজন্য ন্যাপের মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মনি সিংহ ও কংগ্রেসের শ্রী মনোরঞ্জন ধরের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। ঐক্যবদ্ধ হয়ে সকলের সহযোগিতার ফলে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।

মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ

মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানটি ছিল সংক্ষিপ্ত সময়ের। দেশি-বিদেশি ১২৭ জন সাংবাদিক ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতির মাধ্যমে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। শপথবাক্য পাঠ করান অধ্যাপক ইউসুফ আলী। এই সরকার গঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন মেহেরপুরের তৎকালীন সাবডিভিশনাল অফিসার তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, যিনি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা। বৈদনাথতলার ওই স্থানটি বাছাই করার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এমন একটি জায়গা বাছাই করতে বলা হয়েছিল যেখানে ভারত থেকে সহজেই প্রবেশ করা যায়, যে এলাকা শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে এবং বাংলাদেশের দিক বিবেচনা করলেও একটু দুর্গম হয়। পুরো বিষয়টি আয়োজন করা হয়েছিল খুব গোপনে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হয়েছিল সকালে। সেখানে ছোট একটা মঞ্চের মতো ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মঞ্চে সাত-আটটি চেয়ার ছিল, যার মধ্যে একটি প্রেসিডেন্ট তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্য ফাঁকা রাখা হয়েছিল। সেখানে দেশি-বিদেশি অনেক সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।’

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্য পেশ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের মাধ্যমে সকল রাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানান। শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের নাম ঘোষণা করে বলেছিলেন, ‘সমবেত সাংবাদিক বন্ধুগণ এবং জনসাধারণ, আপনাদের সামনে আমার মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রীকে সর্বপ্রথম উপস্থিত করছি। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ।’

স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা

স্বাধীনতার যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে মুজিবনগর সরকার। এই সরকার যুদ্ধ ক্ষেত্রকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে। যাতে যুদ্ধ করতে ও অঞ্চলভিত্তিক কাজ করতে সুবিধা হয়। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ত্রাণ, পুনর্বাসন ও নিপীড়িত মানুষদের সার্বিক সহযোগিতা করেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সকল ক্ষেত্রেই বিশেষ ভূমিকা পালন করে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশকে সাহায্যের আবেদন জানালে তিনি সম্মত হন। যুদ্ধ চলাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বিশেষ দূত করা হয়। তাকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সমর্থন ও জনমত আদায়ের জন্য বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়। এছাড়া বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, সুইডেন ও অন্যান্য কতিপয় প্রভাবশালী দেশের সমর্থন লাভের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালানো হয়। তৎকালীন সময়ে কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউ ইয়র্ক ও স্টকহোমসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মিশন স্থাপন করা ছিল এই সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এই সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এপ্রিল মাস থেকে পাকিস্তান দূতাবাসের অনেক বাঙালি পক্ষত্যাগ করে। এছাড়া ১৯৭১ সালের অক্টোবরে মুজিবনগর সরকারের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলকে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য পাঠানো হয়। এই অধিবেশনে উপস্থিত ৪৭টি দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ঘটনা শোনেন এবং সহমর্মিতা প্রদর্শন করেন। মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধকালীন বহির্বিশ্বের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট ছিল।

মুজিবনগর সরকার যুদ্ধকালীন দেশের ভেতর ও বাইরে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। যার ফলে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। বাংলাদেশের জন্মক্ষণে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা অনন্য সাধারণ। বাঙালির গৌরবের ইতিহাসে মুজিবনগর সরকার এক স্বর্ণপালক।

লেখক: অধ্যাপক; সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ