X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

তামাক নিয়ন্ত্রণে সংসদ সদস্যদের উদ্যোগ ও কিছু কথা

ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত
২১ এপ্রিল ২০২১, ১৯:৫৫আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২১, ১৯:৫৫

ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত আইন প্রণয়নের পাশাপাশি নির্বাচনি এলাকার সমস্যা সংসদে তুলে ধরা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকার পাশাপাশি, সংসদ সদস্যবৃন্দ নানান সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ব্যক্তিগতভাবে বা জাতীয় সংসদে; বিভিন্ন কমিটি ও উপ-কমিটির মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে জড়িত থাকার মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ অবদান রাখার চেষ্টা করেন। মাদক বা তামাক নিয়ন্ত্রণ, বাল্যবিবাহ রোধ, মাতৃমৃত্যু বা শিশু মৃত্যুর হার কমানো, যুব উন্নয়ন ইত্যাদিসহ বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে সংসদ সদস্যবৃন্দের অংশগ্রহণ মূলত সেগুলোরই অংশ বিশেষ।

একজন চিকিৎসক হিসেবে জনস্বাস্থ্য নিয়ে আমি দীর্ঘদিন কাজ করছি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইন্টার পার্লামেন্টারিয়ান ইউনিয়নের (আইপিইউ) স্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির পদে সভাপতি হিসেবে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে সেখানে। দেশেও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে একটি সংসদীয় ফোরাম গঠনের ভাবনা আসে। এরপর গত বছরের শেষদিকে আমরা ২২ জন সংসদ সদস্যের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিং’ নামে একটি সংসদীয় ফোরাম গঠন করলাম। ফোরামটির মূল উদ্দেশ্য দেশের সকল মানুষের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা। জনস্বাস্থ্য নিয়ে যেকোনও বিষয়ে আমরা কথা বলবো, আলোচনা করবো। আমাদের পরামর্শ, আবেদন আমরা সরকারকে জানাবো, যা সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। ফোরামের মাধ্যমে আমরা জনস্বাস্থ্য খাতের নানান বিষয় নিয়ে কাজ করছি। কখনও সেগুলো নীতিনির্ধারণী পরামর্শের মাধ্যমে, কখনও সরাসরি ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে, কখনও বা গণমাধ্যমে লেখালিখি করে।

কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, ২০১৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। যেহেতু আমরা সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করছি; সেক্ষেত্রে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়। আমরা নিজেরা তামাকবিরোধী নানান ইস্যুতে শুরু থেকেই সরব ছিলাম। আমি আমার নির্বাচনি এলাকা সিরাজগঞ্জ-২ (সিরাজগঞ্জ সদর-কামারখন্দ)-কে মাদকমুক্ত করেছি। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে আমরা ২২ সংসদ সদস্য আন্তরিকভাবে কাজ করার উদ্যোগ নিলেন। চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতে গিয়েই টের পেয়েছি, তামাক আমাদের জাতীয় উন্নয়নকে কতটা বাধাগ্রস্ত করে। প্রতি বছর দেশে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ শুধু তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন (গ্লোবাল টোব্যাকো এটলাস, ২০২০)। দেশে মোট তামাকপণ্য ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ কোটি ৭৮ লাখ। গ্যাটসের তথ্যানুযায়ী (২০১৭), দেশে প্রতি ৩ জনের একজন তামাকপণ্য গ্রহণ করেন। এরমধ্যে ২ কোটি ধূমপায়ী, ২ কোটি ২০ লাখ ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য ব্যবহার করেন। অর্থাৎ, জর্দা, গুল ইত্যাদি। দেশের প্রতিটি হাসপাতালে ভুগছে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত রোগী। আমি যখন লেখাটি লিখছি, তখন প্রায় ৭০ লাখ মানুষ তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবনের সঙ্গে লড়ছে। চিকিৎসাক্ষেত্রে আমরা মূলত অসংক্রামক রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করি। বিশেষ করে ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক, শ্বাসরোগ, কিডনি রোগ, হৃদরোগ ইত্যাদি। এগুলোতেই আমাদের দেশে মোট মৃত্যুর ৬৭% ঘটে। যার জন্য মূলত দায়ী তামাক। জনশ্রুতি আছে, তামাক নির্মূলের ক্ষেত্রে আমাদের মূল অন্তরায় এ থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব আয়। কথাটি একেবারেই সঠিক নয়। তামাক থেকে রাজস্ব আসে ২২ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। অথচ তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের খরচ হয় ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। এরমধ্যে চিকিৎসা ব্যয় রয়েছে, উৎপাদনশীলতা হারানোর বিষয়টিও রয়েছে।

তবে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর দেশে তামাকবিরোধী কর্মকাণ্ড বিশেষ গতি পেয়েছে। দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও আমরাই এগিয়ে ছিলাম। আমার বিভিন্ন লেখায় সেসব কথা তুলে ধরেছি বারবার। তাই নতুন করে বলতে চাই না। আমরা সংসদ সদস্যবৃন্দ খেয়াল করলাম, তামাক নির্মূলের ক্ষেত্রে আমাদের কয়েকটি বিষয় জরুরি। বিশেষজ্ঞদের অভিমত এবং তামাকবিরোধী সংস্থাগুলোর নানান জরিপ ও গবেষণা এখানে আমাদের পথ দেখিয়েছে, তা স্বীকার করতেই হয়। আমাদের বিদ্যমান আইনে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু বিচ্যুতি তৈরি হয়েছে। সেগুলো সময়োপযোগী করতে হলে আমাদের তামাক নিয়ন্ত্রণ সংশোধন করা জরুরি। এক্ষেত্রে এফসিটিসি’র প্রস্তাবনাগুলো কার্যকর হতে পারে। এগুলোর মধ্যে গণপরিবহন ও রেস্টুরেন্টে তামাকপণ্য ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান নিষিদ্ধ করা, খুচরা সিগারেট বিক্রি বন্ধ, তামাকপণ্যের দৃশ্যমান প্রচারণা বন্ধ করা, তামাকপণ্যে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্ক বার্তাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম বন্ধ করার বিষয়গুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আরেকটি হলো, তামাকপণ্যে কর বৃদ্ধি করা। তামাকপণ্য ব্যবহারকারীদের নিরুৎসাহিত করতে তামাকপণ্যে সুনির্দিষ্ট করারোপ করার মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধি একটি আন্তর্জাতিকভাবে অনুসৃত পদ্ধতি। এ থেকে রাজস্ব আয়ের সুযোগও অনেক বেশি। আসন্ন ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটে সুনির্দিষ্ট কর বাস্তবায়নের মাধ্যমে ৮ লাখ তরুণকে নতুন করে ধূমপায়ী হতে বিরত রাখা সম্ভব। অর্থনৈতিক সমীক্ষা জানাচ্ছে, এর মাধ্যমে ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয়ের সুযোগও রয়েছে। বিশ্বের নানান দেশেই তা হয়ে এসেছে, এমনকি আমাদের দেশেও তাই। কিন্তু প্রয়োজন একটি সঠিক শুল্ক-নীতি প্রণয়ন। শুধু তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন বা কর বৃদ্ধিই নয়। নতুন যুগের ইলেকট্রিক্যাল সিগারেট বা ভেপ; যা কিনা ই-সিগারেট হিসেবে পরিচিত, তা নিষিদ্ধ করা নিয়েও আমরা কাজ করছি।

ফোরামের মাধ্যমে কাজ করলেও, আমরা পাশে পেয়েছি প্রায় পুরো সংসদকেই। আমরা অবাক হয়ে খেয়াল করেছি, দল-মত নির্বিশেষে তামাক নিয়ন্ত্রণে তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে আমাদের সংসদ সদস্যবৃন্দ কতটা আন্তরিক। আমরা সবাইকে নিয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বিষয়ে কাজ করছি। মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বরাবর বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনে চিঠি দিয়েছি। যেখানে সর্বমোট ১৫২ জন সংসদ সদস্য স্বাক্ষর করেছেন। তাদের সুপারিশ জানিয়েছেন। এ এক বিশাল অর্জন আমাদের জন্য। আমরা প্রধানমন্ত্রীর নিকট ই-সিগারেট আমদানি, তৈরি ও ব্যবহার নিষিদ্ধের দাবিতে চিঠি দিয়েছি, যেখানে ১৫৩ সংসদ সদস্য এর পক্ষে নিজেদের সুপারিশ জানিয়েছেন। আসছে বাজেটে আমরা তামাকপণ্যে কর বৃদ্ধির জন্য ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি। আমরা অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছি। এখানে আমরা ৫২ সংসদ সদস্যকে পাশে পেয়েছি। বাজেটে এই করারোপের বিষয়টি যেন বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে, আমরা সকল সংসদ সদস্যকে আসন্ন বাজেট অধিবেশনে তামাকপণ্যে সুনির্দিষ্ট কর বাস্তবায়নের বিষয়টি নিয়ে কথা বলার অনুরোধ জানিয়ে চিঠিও প্রেরণ করেছি।  

শুধু প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী বা স্বাস্থ্যমন্ত্রীই নয়। এসব ক্ষেত্রে যারা দেশের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে রয়েছেন, আমরা সরাসরি তাদের কাছে যাচ্ছি। তাদের তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়ে সকলকে সচেতন করার চেষ্টা করছি। আমাদের উদ্যোগের পাশে থাকতে অনুরোধ করছি। তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছি। মোদ্দা কথা, আমরা সবাইকে সঙ্গে নিয়েই কাজগুলো করছি। বিশ্বাস করি আমরা তাতে সফল হবো।
আমরা জানি, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নেই আমাদের সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে হবে। জনমানুষের কাছে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবগত করতে হবে। আমরা সেই কাজও শুরু করেছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, মাঠপর্যায়; সকল ক্ষেত্রে আমরা সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালিয়ে যাচ্ছি। সবকিছু মিলিয়েই আমরা দেশকে তামাকমুক্ত করতে চাই।

সংসদ সদস্যদের কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চিকিৎসক, কেউ আইনজীবী, কেউ শিক্ষক; কেউ বা অন্য কোনও পেশার। আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। তারপরও এই একটি উদ্যোগে সবাইকে পাশে থাকতে দেখে আমরা আশার আলো খুঁজে পাই। একটি সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার পথে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগে সবাই পাশে থাকবেন বলে আশা করি।

লেখক: অধ্যাপক; সংসদ সদস্য; প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান: স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ