X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

কল্পনা চাকমা সব সময়ই জাগরুক

জোবাইদা নাসরীন
১২ জুন ২০২১, ১৫:১৬আপডেট : ১২ জুন ২০২১, ১৫:১৬

জোবাইদা নাসরীন পঁচিশ বছর হয়ে গেলো। কল্পনা হারিয়ে গেছে, আসলে তা নয়, কল্পনাকে অপহরণ করা হয়েছিল। ২৫ বছর পরও তার অপহরণের কোনও কূল-কিনারা হয়নি। কারণ অপহরণটি ছিল পরিকল্পিত এবং রাজনৈতিক। কেন তাকে অপহরণ করা হলো? সে প্রশ্নের উত্তর আজ  এত বছর পরও কারও অজানা থাকার কথা নয়। তবু পঁচিশ বছর পরে হলেও আমাদের বলে যেতে হবে কল্পনার অপহরণের কথা। কারণ আমি বিশ্বাসি করি নিপীড়নের ইতিহাস মানুষকে মনে রাখতে হয় এবং এর মধ্য দিয়েই টিকে থাকে রাজনৈতিক ইতিহাস।

মনে পড়ে, খুব মনে পড়ে এই লড়াকু ছিপছিপে গড়নের মেয়েটির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে। তখন আমরা দু’জনই কলেজ ছাত্রী। কিন্তু তার গর্জন ভয়ার্ত। তার মনে প্রাণে ক্ষোভ, সেই ক্ষোভ থেকেই তৈরি হয়েছিল গর্জন। হ্যাঁ, তিনি গর্জে উঠেছিলেন পাহাড়ে জাতিগত নিপীড়ন, নিজ সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তিনি জানতেন এর পরিণাম কী হবে। কিন্তু তারপরও জারি রেখেছিলেন প্রতিবাদ, প্রতিরোধের সলতে। 

১৯৯৬ সাল। শান্তি চুক্তি তখনও হয়নি। কল্পনা ছিলেন অবিভক্ত হিল উইমেন ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক। সে সময় সাংগঠনিক কাজে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা চষে বেড়ানো খুব সহজ ছিল না। কিন্তু কল্পনা সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলো। সেই অভিজ্ঞতাগুলোকে তিনি তার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। কল্পনা কি বুঝে গিয়েছিলেন তাকে আর বাঁচিয়ে রাখা হবে না? তা না হলে কীভাবে তিনি চিন্তা-চেতনায় এতটা ক্ষীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন? তার চিন্তায় যেমন ছিল তেজের প্রখরতা তেমনই ছিল লড়িয়ে মেজাজ। সম্ভবত এই দুটো’ই কল্পনাকে স্বপ্ন দেখাতে সাহায্য করেছিল পাহাড়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তৈরিতে। 

পাহাড়ে-পাহাড়ে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ফেরী করা কল্পনাকে থামিয়ে দেওয়া হলো। পাহাড়ের পর পাহাড় ডিঙানোর তেজ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই পাহাড় থেকেই অপহরণের মাধ্যমে এবং বাছাই করা হয়েছিল সেই রাতকে যেটি পার হওয়ার পরেই শুরু হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সবাই নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। কোন পাহাড়ে কিংবা কোথা থেকে কল্পনাকে অপহরণ করা হয়েছে সেটি খুব সহসা কেউ জানতে পারবে না। 

কিন্তু কল্পনা অপহরণ প্রমাণ করেছে কল্পনা কোনোভাবেই ‘সাধারণ’ ছিলেন না। কল্পনার এই ‘অসাধারণত্ব’  হয়তো অপহরণকারীরা বুঝতে পেরেছিল তাই অপহরণ করার পরিকল্পনা করেছিল। কল্পনার অপহরণ শুধু জাতীয় পরিসরেই নয় সেটি বিশ্বজুড়েই আলোচিত হয়। কল্পনার অপহরণ পাহাড়ের নিপীড়ন সংস্কৃতিকে নতুন ভাবে চিনতে সহায়তা করেছে।

এমনকি অপহরণের প্রায় দেড় বছর পর সম্পাদিত চুক্তিতে কল্পনা না থাকলেও কল্পনা অপহরণ এখনও পাহাড়ের জন্য অন্যতম ক্ষতি এবং ক্ষত।

তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শান্তি চুক্তির পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই এবং তার পরিণতিতে অপহরণের শিকার হওয়া কল্পনা চাকমা বিষয়ে চুপ ছিলেন পাহাড়ি নেতারা। এখন কল্পনা অনেকটাই সীমিত হয়ে গেছে অপহরণ দিবসের স্মরণ হিসেবে। দূরদর্শী রাজনৈতিক সংগঠক কল্পনা সেই তখনই বুঝতে পেরেছিলেন তার নিজ সমাজের পুরুষতান্ত্রিক চরিত্রকে। আরও বুঝতে পেরেছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতীয়তাবাদী শত্রুর সঙ্গে পুরুষতন্ত্রের বোঝাপড়াকে। 

কল্পনার অপহরণ বেশ কেছু দিককে বুঝতে সহায়তা করেছে। বিশেষ করে কল্পনার অপহরণ বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের আদিবাসী নারী নিপীড়নের বিষয়টি যুক্ত করতে ভাবনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। বলতে দ্বিধা নেই যে এর আগ পর্যন্ত আদিবাসী নারীদের বিষয় একবারেই গুরত্বহীন এবং অবহেলিত ছিল মূল ধারার নারী আন্দোলনে। তাই এ্‌ই অপহরণ প্রথমবারের মতো নারী আন্দোলনে পাহাড় এবং সমতলের নারীদের যুক্ত করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে। কল্পনা তাই এখন শুধু পাহাড়ের জন্যই প্রতিবাদের স্মারক নয়, বাংলাদেশের নারী আন্দোলন তথা নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক। আমরা কল্পনার রক্ত বহন করে চলেছি। 

কল্পনা আমার প্রথম পাহাড় বোঝানোর শিক্ষা গুরু। ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব আমার চোখ খুলে দিয়েছিল। আমার বয়সী একটি মেয়ের বোধে, শক্তিতে, প্রজ্ঞায়, শানিত চিন্তায় আমার চেয়েও অনেক বেশি এগিয়ে ছিল। অনেকেই হয়তো তাত্ত্বিকভাবে এগিয়ে থাকে কিন্তু সেটিকে বাস্তবে নিয়ে যায় কয়জন। কিন্তু কল্পনা সেই ঈর্ষনীয় দক্ষতায় সেটি করতে পেরেছিলো আর তৈরি করছিল স্বপ্নের পাহাড়।  

শান্তি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ে থামেনি নিপীড়ন। অব্যাহত আছে ধর-পাকড় আর অপহরণ। পাহাড় ভেঙেছে শরীরে, রাজনীতিতে। ভেঙেই ক্ষান্ত হয়নি, আঞ্চলিক দলগুলো বিভক্ত হয়েছে নানাভাবে। নতুন নতুন নিপীড়নের কৌশল পাহাড়ে দৃশ্যমান হচ্ছে। পাহাড়ে এখন আর শত্রু-মিত্র নির্ধারিত নয়। 

প্রতিনিয়তই এগুলো নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে। ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পে ঢেকে যাচ্ছে পাহাড়। মাঝখানকার ক্ষতি- আশার জায়গা থেকে ফসকে পড়ে গেলো কল্পনার অপহরণ মামলাটি। মামলাটি আরও দু’বছর আগেই ক্লোজড ঘোষণা করেছে সরকার। 

সরকারিভাবে ক্লোজড হলেও বাংলাদেশে কল্পনা চাকমাকে পাঠন-পঠন খুব জরুরি। কেন জরুরি? কেন আমাদের বারবার করে কল্পনা এবং তার অপহরণকে মনে রাখতে হবে? কেন যুগ-যুগ ধরে কল্পনাকে জিইয়ে রাখতে হবে? কারণগুলো একেবারেই স্পষ্ট। আমাদের মনে রাখতে হবে, কল্পনা যদি এদেশের নিপীড়নের ইতিহাসের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায় তাহলে হারিয়ে যাবে এদেশে লড়াই, সংগ্রামের ইতিহাসও। রাষ্ট্র, সরকার হয়তো চাইবে কোনও কোনও লড়াই্য়ের ইতিহাস বিস্মৃত হোক। কারণ এটাই স্মৃতি-বিস্মৃতির রাজনীতি। কিন্তু তার বিপরীতে আমরা চাই কল্পনা শুধু ১২ জুনের পাঠ নয়, কল্পনা ইতিহাসের টেক্সট হয়েই সব সময় সকল লড়াই্ সংগ্রামে আমাদের অংশ হোক। কল্পনা আমাদের স্মৃতি-বিস্মৃতি নয়, কল্পনা আমাদের নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের পতাকার অংশ। 

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: [email protected]




 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ