X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

দৃঢ়চেতা ও মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব

আশরাফ সিদ্দিকী বিটু
০৮ আগস্ট ২০২১, ২২:৪৪আপডেট : ০৮ আগস্ট ২০২১, ২২:৪৪
আশরাফ সিদ্দিকী বিটু বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব সব সময় সরল সাধারণ জীবনযাপন করেছেন, কখনই তিনি নিজেকে সামনে আনতে আগ্রহী ছিলেন না। ধীশক্তিসম্পন্ন এই মানুষটি সব সময় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। নিজেকে রেখেছেন সব জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে। নীরবে দ্বিধাহীনভাবে দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন। আরও গবেষণা নিশ্চিতভাবেই পাওয়া যাবে বেগম মুজিবের সাহসিকতা, দূরদর্শিতার নানা উদাহরণ ও কর্মকাণ্ড। এমনকি তিনি কোনও দিন করাচি যাননি। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য সব সময় তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা।

বেগম মুজিব যেকোনও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারদর্শী ছিলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতিতে সকল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহযোদ্ধা হিসেবে পাশে থেকে প্রেরণা দিয়েছেন বেগম মুজিব। বঙ্গবন্ধুও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বঙ্গমাতার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতেন। তিনি নিজেকে সব সময় প্রচারবিমুখ রেখেছেন।

কোনও দিন কোনও দাবি নিয়ে বাধা হয়ে দাঁড়াননি। বেগম মুজিবের উৎসাহতেই জাতির পিতা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ লিখেছিলেন।

বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব একজন অনুসরণীয় নিরহংকার, নির্লোভ ব্যক্তিত্ব, আদর্শ স্ত্রী, মা, গৃহিণী এবং দক্ষ সংগঠক। বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে থাকতেন তখন সংসার, ছেলেমেয়েদের দেখভাল, পড়াশোনা, এমনকি দলের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতেন বঙ্গমাতা বেগম মুজিব। তিনি নিজের জমির ধান বিক্রির অর্থ পাঠিয়ে স্বামীকে সহযোগিতা করেছেন। বাসার ফ্রিজ বিক্রি করে দলের কর্মীদের টাকা দিয়েছেন। এমনকি নিজের গয়না বিক্রি করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের টাকা-পয়সা দিয়েছেন। অনেক গরিব ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করার জন্য আর্থিক সহযোগিতা করতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ১২৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘রেণু খুব কষ্ট করতো, কিন্তু কিছুই বলতো না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখতো যাতে আমার কষ্ট না হয়’।

১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট বঙ্গমাতা বেগম মুজিবের জন্ম। পিতার নাম শেখ জহুরুল হক ও মাতার নাম হোসনে আরা বেগম। ফুলের রেণুর মতোই কোমল, ফুটফুটে ছিল বলে মা মেয়ের নাম রেখেছিলেন রেণু। সেই থেকে সবার কাছে রেণু নামেই পরিচিত হন বেগম মুজিব। বাবা-মায়ের দু’কন্যা সন্তানের মধ্যে তিনি ছোট। মাত্র ৩ বছর বয়সে পিতাহারা হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে আকদ হয়। ৫ বছর বয়সে মাকে হারান। এরপর থেকে তিনি শ্বশুরালয়ে বসবাস করতে থাকেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তাদের বিবাহ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, “তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনির বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।” রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরুব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইলো তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর সে আমার মা'র কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সাথেই রেণু বড় হয়। রেণুর বড়বোনেরও আমার আর এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিবাহ হয়। এরা আমার শ্বশুরবাড়িতে থাকলো, কারণ আমার ও রেণুর বাড়ির দরকার নাই। রেণুদের ঘর আমাদের ঘর পাশাপাশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান। অন্যান্য ঘটনা আমার জীবনের ঘটনার মধ্যেই পাওয়া যাবে।‍’’

ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন শান্তশিষ্ট, মার্জিত, অমায়িক ও প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ছোটবেলায় বাড়ির ভেতরে গৃহশিক্ষক ও মুরুব্বিদের কাছে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। পরবর্তী জীবনও তিনি প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। একা একা বই কিনে পড়তেন। নতুন বই নিউমার্কেটের বিভিন্ন দোকান থেকে কিনে এনে পড়তেন। বাসায় একটা ছোট লাইব্রেরিও গড়েছিলেন তিনি। অনেক গরিব মানুষকে অর্থ দিয়েছেন তাদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য। তিনি খুবই দানশীল ছিলেন, সবাইকে বিপদে-আপদে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। অনাথ এতিমদের তিনি সব সময় সহযোগিতা করেছেন। যেকোনও আত্মীয় ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করতে চাইলে তিনি নিজের বাসায় রেখেও পড়াশোনা করিয়েছেন। মানুষকে ভালোবাসার এক অসাধারণ গুণ ছিল বেগম মুজিবের। স্বামী রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকায় ছেলেমেয়েদের মানুষ-করা, আত্মীয় পরিজনদের দেখাশোনা, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান সবই একহাতে করেছেন তিনি। তাঁর মধ্যে কোনও হা-হুতাশ ছিল না। কোনও কিছুর জন্য কোনও  আক্ষেপ ছিল না।  

বঙ্গমাতা মুজিব অনেক সুন্দর সুন্দর শ্লোক জানতেন, যা তিনি মাঝে মাঝে বলতেন। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনতো। হাসি-খুশি থাকতে পছন্দ করতেন। দুঃখ-কষ্টের কথা সব সময় আড়াল করতেন। কোনও গম্ভীর পরিবেশে শ্লোক বলে পরিবেশ হালকা করতে পারতেন। তিনি পান খেতে পছন্দ করতেন। সব সময় পান, সুপারিসহ একটা পানের বাটা তিনি যত্ন করে রাখতেন। কোনও উপহার পেলে খুব আনন্দ পেতেন। এক অসাধারণ সারল্য ছিল তাঁর মাঝে।

বঙ্গমাতার স্মরণশক্তি ছিল প্রখর, আন্দোলন চলাকালীন সময়ে জেলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশনা নিয়ে এসে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে সেই মোতাবেক নির্দেশনা দিতেন। আবার আওয়ামী লীগের কার্যকরী সংসদের সভা যখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে হতো, তিনি নিজ হাতে রান্না করে নেতাদের খাইয়েছেন।

জাতির পিতার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেগম মুজিব কোনোদিন বাধা দেননি বরং সাহস দিয়েছেন, ঘর সামলানোর পাশাপাশি রাজনীতিকে সহযোগিতাও করেছেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবি পেশ করলে ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার ৬ মাস পর প্রথম ক্যান্টনমেন্টে কোর্ট বসালে সেখানে বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিবের প্রথম দেখা হয়। বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন, এটাই ছিল পরিবারের সকলের সান্ত্বনা।  ৬ দফার প্রশ্নে আপস রফার দাবি তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বরং কোনও আপস হবে না এই কঠিন মনোবল নিয়ে সংগঠনকে শক্ত রাখেন এবং মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হলে বেগম মুজিব প্যারোলে মুক্তির বিপক্ষে অবস্থান নেন। এ প্রসঙ্গে তাদেঁর কনিষ্ঠা কন্যা শেখ রেহানা লিখেছেন, “মা কখনোই আব্বার রাজনীতি করা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেননি। মা  না চাইলে আব্বার পক্ষে রাজনীতি করা সম্ভব হতো কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। তিনি বাবাকে শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে অনুপ্রাণিত করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে মার ইতিবাচক সমর্থন ছিল। তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সময়ে অনেকেই বাবাকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আইয়ুবের গোলটেবিলে যোগদানের জন্য বলেছিলেন। মা এর বিরোধিতা করেছিলেন প্রচণ্ডভাবে। মাকে আব্বার কাছাকাছি যেতে দেওয়া হয়নি। মা চিৎকার করে বলেছিলেন, তুমি প্যারোলে যাবে না। গেলে বাঙালিদের সাথে বেইমানি করা হবে।”

বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি নেননি এবং আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। তিনি নেপথ্যে থেকে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। বঙ্গমাতা কোনোদিন আপস করেননি। কোনও অবস্থাতেই তাকে কেউ টলাতে পারেনি। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানসিক শক্তি ও অসীম ক্ষমতা বেগম মুজিবের ছিল।

বেগম মুজিব তোষামোদি পছন্দ করতেন না। বঙ্গবন্ধু যখন জেনেভায় অপারেশন করে সুইস সরকারের অতিথি হিসেবে কিছু দিন বিশ্রামে ছিলেন, তখন সেখানে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গীরা একটা পিকনিকের আয়োজন করলে বেগম মুজিব বিরোধিতা করেন এবং বলেছিলেন, ‘এতে তোমার শরিক হওয়ার দরকার নাই। এ রকম তোষামোদের দল সুযোগের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় নিজেদের স্বার্থে। ডাক্তার সাহেবের কথা শোন।’’ জাতির পিতা সেই পিকনিকে আর যাননি।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ প্রদানে জাতির পিতাকে উৎসাহ ও প্রেরণা জুগিয়েছেন বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। সৎ বুদ্ধি দিয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘...আমার মা আব্বাকে বললেন, সমগ্র দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সবার ভাগ্য আজ তোমার ওপর নির্ভর করছে। তুমি আজ একটা কথা মনে রাখবে, সামনে তোমার লাঠি, পেছনে বন্দুক। তোমার মনে যে কথা আছে তুমি তাই বলবে। অনেকে অনেক কথা বলেছে, তোমার কথার ওপর অগণিত মানুষের ভাগ্য জড়িত, তাই তুমি নিজে যেভাবে যা বলতে চাও নিজের থেকে বলবে। তুমি যা বলবে সেটাই ঠিক হবে। দেশের মানুষ তোমাকে ভালোবাসে, ভরসা করে।’

মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় বেগম মুজিবদের বন্দি করে রাখা হয়। পাক সৈন্যরা বেগম মুজিবকে ছেলেমেয়েসহ গ্রেফতার করে ধানমন্ডি ১৮ নম্বর সড়কের (বর্তমান ৯/এ সড়ক) একটি একতলা বাড়িতে আটক করে রাখে। বড় ছেলে শেখ কামাল ২৫ মার্চ রাতেই বাড়ি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। আটকাবস্থা থেকে ৫ আগস্ট শেখ জামালও একদিন কাউকে না জানিয়ে যুদ্ধে চলে যায়। বন্দি অবস্থায় পাকসেনাদের মানসিক অত্যাচার তিনি সহ্য করেছেন। শেখ হাসিনার পুত্র সন্তান জয়ের জন্মের সময় বেগম মুজিবকে একবারের জন্যও ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে যেতে দেয়নি পাকিস্তানি সেনারা।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। মু্ক্তির উল্লাস সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে কিন্তু তখনও ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের বাড়িতে বন্দি বেগম মুজিব ও বঙ্গবন্ধুর পরিবার। ১৭ ডিসেম্বর সকালে সবাই মুক্তি পান। মুক্তি পেয়েই বেগম মুজিব বাড়ির ছাদ থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে আগুন ধরিয়ে দেন। প্রচণ্ড দেশপ্রেম ও পাহাড়সম সাহস ছিল বলেই বন্দি অবস্থায় পাক সেনাদের দুর্ব্যবহার, স্বামী সন্তানদের জন্য দুশ্চিন্তা তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি বরং দেশের বিজয়ের জন্য ধৈর্য ধরে নিজেকে সামলে রেখেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ থেকে প্রথমে শেখ জামাল ও পরে শেখ কামাল ফিরে এলেও বেগম মুজিব শান্তি পাচ্ছিলেন না, তিনি জানতেন না তার স্বামী বাঙালির মুক্তির নেতা বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন, ফিরবেন নাকি ফিরবেন না- এই শঙ্কায় তিনি ত্রস্ত। অবশেষে ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি জানা গেলো বঙ্গবন্ধু ফিরছেন, তিনি মুক্তি পেয়েছেন, ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা ফিরলেন প্রিয় স্বদেশ ভূমিতে। বেগম মুজিব ফিরে পেলেন প্রিয় স্বামীকে। ১২ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুর্নগঠনের অভিযাত্রা শুরু করেন।

বঙ্গবন্ধু যখন দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন তখনও পাশে পেয়েছেন বেগম মুজিবকে। তিনিও দেশের জন্য কাজে নেমে পড়েন। তিনি উদ্যোগ নিয়ে মু্ক্তিযুদ্ধে নির্যাতিতা মা-বোনদের সহযোগিতা করা শুরু করেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করে সামাজিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার ব্যবস্থা করেছিলেন। সম্ভ্রমহারা নির্যাতিতা নারীদের জন্য নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। বেগম মুজিব বীরাঙ্গনাদের সান্ত্বনাই নয়, তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দিয়ে সামাজিক মর্যাদা প্রদান করে স্বাভাবিক জীবনের ব্যবস্থা করে দেন। তিনি নিজে উপস্থিত থেকে ওইসব মেয়েকে বিয়ে দেন। নিজের গহনা তাদের দিয়েছেন তিনি।

বেগম মুজিব প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীর হয়েও স্বাভাবিক জীবনযাপন করেছেন। তাই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে কখনোই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যাননি। বিলাসিতা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি কোনোদিন। বাড়িতে কোনও দামি কারপেট, আসবাবপত্র, এয়ারকন্ডিশন ব্যবহার করেননি। তিনি নিজ হাতে রান্না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের জন্য খাবার পাঠাতেন। তিনি কোনও সরকারি সুযোগ-সুবিধা চাইতেন না, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর সহধর্মিণী হয়েও সাধারণভাবে থেকেছেন, সন্তানদের সাদাসিধা জীবনযাপন করতে শিখিয়েছেন। প্রচণ্ড সংসারী হয়েও স্বামীকে সহযোগিতা করেছেন কিন্তু গুছিয়েছেন ঘরের প্রতিটি আসবাব, প্রতিটি কাজ তিনি করতেন অত্যন্ত যত্ন করে।

জাতির পিতার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়লে বোঝা যায় কত আন্দোলন-সংগ্রাম তিনি করেছেন এবং বেগম মুজিবও বহু কষ্ট করেছেন, সন্তানদের লেখাপড়া করানোর পাশাপাশি রাজনীতিতেও সহযোগিতা করেছেন। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় জেলজীবনের পাশাপাশি পারিবারিক অনেক কথাই উঠে এসেছে। এ বইয়ের এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “সময়: ১৪ই এপ্রিল ১৯৬৭।   ১৪ তারিখ ১৫ দিন পর ছেলেমেয়েদের সাক্ষাৎ পেলাম।... এক ঘণ্টা সময়। সংসারের কথা, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, আব্বা মা'র শরীরের অবস্থা আলোচনা করতে করতে চলে যায়। কোম্পানি আজও আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দেয় নাই, তাই একটু অসুবিধা হতে চলেছে বলে রেণু বললো। ডিসেম্বর মাসে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি- চার মাস হয়ে গেলো আজও টাকা দিলো না। আমি বললাম, জেল থেকে টেলিগ্রাম করবো। প্রথম যদি না দেয় তবে অন্য পন্থা অবলম্বন করবো। আমার টাকা তাদের দিতেই হবে। কোনোমতে চালাইয়া নিয়ে যাও। বাড়ির থেকে চাল আসবে, নিজের বাড়ি, ব্যাংকেও কিছু টাকা আছে, বছর খানেক ভালোভাবেই চলবে, তারপর দেখা যাবে। আমার যথেষ্ট বন্ধু আছে, যারা কিছু টাকা ধার দিতে কৃপণতা করবে না। ‘যদি বেশি অসুবিধা হয় নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ছোট বাড়ি একটা ভাড়া করে নিব’, রেণু বললো। সরকার যদি ব্যবসা করতে না দেয় তবে বাড়িতে যে সম্পত্তি আমি পেয়েছি আব্বার, মায়ের ও রেণুর তাতে আমার সংসার ভালোভাবে চলে যাবে। রেণু বললো, ‘চিন্তা তোমার করতে হবে না।’ সত্যই আমি কোনও দিন চিন্তা বাইরেও করতাম না, সংসারের ধার আমি খুব কম ধারি।”

স্বামীর প্রতি বেগম মুজিবের ছিল অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা। তারা একে অপরের আত্মা হয়ে থেকেছেন, কাজ করেছেন। দু’জনের তীব্র ভালোবাসা ছাপিয়ে দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা, তাদের মুক্তির জন্য সংগ্রামকেই প্রাধান্য দিয়ে, নিজেদের সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়ে সংসার করেছেন। বেগম মুজিব জীবনের শেষদিন পর্যন্ত স্বামীর সাথে থেকে নীরবে দেশ ও মানুষের সেবা করে গেছেন। স্বামীকে কাছে না পেলেও মানুষের জন্য স্বামীর ত্যাগ সংগ্রামে নিরন্তর সহযোগিতা করেছেন, যা সত্যিই অনন্য, অতুলনীয়। বঙ্গমাতা ছিলেন শক্তিদায়িনী, প্রেরণাদায়ী কিন্তু বেছে নিয়েছিলেন সহজ সরল সাধারণ জীবন, ছিলেন নিভৃতচারী। এখানেই তার বিশেষত্ব! ভালোবাসার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি, বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের সুখ-দুঃখ বেদনারই নয়, মরণেও ছিলেন পরম সঙ্গী। তাই তো ঘাতকের বুলেট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলে হত্যাকারীদের কাছে তিনিও মৃত্যু ভিক্ষা করেন, একই সাথে চিরবিদায় নেন এই পৃথিবী থেকে।

আজ ৮ আগস্ট, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯১তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে তিনি নিহত হন। আগস্ট মাসেই তাঁর জন্ম ও মৃত্যু। তিনি এ দেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে বেগম মুজিব স্বীয় কর্মগুণে আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর সার‌ল্য-মেধা-ধীশক্তি-সহমর্মিতা সবসময়ই আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। পরিশ্রম, ত্যাগ, আস্থা-ভরসা ও নির্ভরতার এক অনন্য উদাহরণ তিনি। আমি তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আজ তাঁর জন্মদিনে জানাই অতল শ্রদ্ধা ও অফুরান ভালোবাসা।

লেখক: মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব।

তথ্যসূত্র:

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’।

www.albd.org

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা স্মারকগ্রন্থ। সম্পাদনায়- অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান চৌধুরী।

দৈনিক জনকণ্ঠ। ০৮ আগস্ট ২০১৭।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ। ০৮ আগস্ট ২০১৭।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ