X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

চীনের গবেষণাগার ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সূতিকাগার

মুহম্মদ মফিজুর রহমান
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৯:৫১আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২৩:৩৮

মুহম্মদ মফিজুর রহমান আধুনিক বিশ্ব যখন বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণাগারে রূপান্তরের কাজ করছেন, তখন আমরা এটাকে তৈরি করেছি রাজনৈতিক সূতিকাগার হিসেবে। ২০১৯ সালে চীনের উহানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৬০ দেশের সামরিক বাহিনীর ‘ওপেন টুর্নামেন্ট’। শহরটিকে সাজানো হয়েছিল আলোকসজ্জায়। রাস্তায় নতুন পোশাকে পতাকা হাতে অতিরিক্ত পুলিশ। তাদের চেহারায় বা আচরণে পুলিশ মনে হলো না। জানতে চাইলে একজন যা বুঝিয়ে বললো– তা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়, অনুমান করলাম- নির্বাচন চলাকালীন আমাদের দেশে যে অস্থায়ীভাবে অতিরিক্ত আনসার নিয়োগ হয়, তেমনি কিছু লোককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, পুলিশকে সহায়তার জন্য।

যাহোক, টুর্নামেন্ট শেষ হলে ক্লাসে একজন অধ্যাপক বললেন,‘পুরা টুর্নামেন্টের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন একজন অধ্যাপক’। শুনে কিছুটা চিন্তিত হলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টুর্নামেন্টের নিরাপত্তা কীভাবে দিলেন! তিনি কোন বিভাগের অধ্যাপক! কী তাঁর যোগ্যতা! মনে মনে ভাবলাম, নিশ্চয়ই তিনি ক্রাইম প্রটেকশন নিয়ে গবেষণা করেন! কিন্তু মাথার মধ্যে বিষয়টা ঘুরপাক করতে লাগলো।

পরদিন বিভাগের ‘ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অফিসার’-এর কাছে গেলাম। তিনি যা বললেন, তাতে পুরো মাথাটা ঘুরতে লাগলো। কীভাবে সম্ভব! বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে একজন অধ্যাপক বিশাল এলাকার কয়েক লক্ষ লোকের সমাগমকে কীভাবে মনিটরিং করলেন। কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করলেন। তাহলে পুলিশের কাজ কী। আমার উৎসাহ দেখে তিনি আমাকে বিষয়টি দেখানোর ব্যবস্থা করবেন বলে জানালেন।

চারদিন পরে তিনি আমাকে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শনের ব্যবস্থা করলেন। এই চারদিনে যখনই আমি পড়তে বসেছি, তখনই মাথার মধ্যে এই বিষয়টি ঘুরপাক খেয়েছে। কিন্তু স্বচক্ষে যখন দেখলাম, তার সঙ্গে আমার পূর্ব ধারণার ন্যূনতম মিল নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে একজন অধ্যাপক টেকনোলজির সাহায্যে প্রতি ইঞ্চি জায়গার নিরাপত্তা দিতে পারে– সেই ধারণাটিই আমার ছিল না। নিজেকে অপদার্থ মনে হচ্ছিলো। দেশের জন্য নিজের সামর্থ্য, দায়িত্ব আর কর্তব্য নিয়ে ভেবে নিজেকে তিরস্কার করা ছাড়া আর কিছুই তখন মনে আসেনি।

৪০ বছর আগে যে চীনে ছিল খাদ্যের অভাব, মানুষের জীবন ছিল ছিন্নমূলের মতো, অভাবের তাড়নায় দেশ ত্যাগ করে অনেক মানুষ বিভিন্ন দেশে চলে যায়, আজ তারা পৃথিবীর সেরা অর্থনৈতিক দেশ। পৃথিবীর বাজার এখন তাদের হাতে। কীভাবে হলো এটি– জানতে চেয়েছিলাম একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপকের কাছে।

জবাবের শুরুতেই তিনি জানালেন, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের মাসিক বেতন প্রায় বিশ হাজার আরএমবি ( চীনা মুদ্রা, 1rmb = 14.50 tk)। কিন্তু একজন অধ্যাপকের মাসিক আয় প্রায় এক লক্ষ আরএমবি। তাহলে অতিরিক্ত আশি হাজার আয় হয় কোথা হতে? জবাবে তিনি জানালেন– ‘গবেষণা থেকে। গবেষণা ছাড়া কোনও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত হয় না আমাদের’। উদাহরণ দিতে গিয়ে জানালেন, ২০০৮ সালে এই উহান শহর বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেলো। শ’খানেকেরও বেশি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এর ওপর। সরকার একটি গবেষণা টিম তৈরি করে দিলেন, তাঁরা এসব আর্টিক্যালের ওপর ভিত্তি করে একটা প্রস্তাব দিলেন সরকারকে। সেটি বাস্তবায়ন করলেন, আর কোনও সমস্যা হয়নি আজ পর্যন্ত।

কথার ফাঁকে তিনি মুচকি হেসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার দেশ তো গণতান্ত্রিক দেশ, তাই না? তোমাদের দেশের কী অবস্থা? জবাবে আমিও শুধু মুচকি হাসি দিয়েছিলাম। যদিও এই হাসির আড়ালে ছিল দীর্ঘশ্বাস।

সেদিন আমি সেই অধ্যাপককে বলতে পারিনি, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার চেয়ে প্রাধান্য পায় রাজনীতি। যেখানে ছাত্র কিংবা শিক্ষক উভয়ই রাজনৈতিক পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। যেহেতু এই পরিচয়টি তাঁকে সব সুবিধার অগ্রভাগে নিয়ে যেতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি! অনেককে দেখলে মনে হবে দেশসেরা ‘রাজনীতিবিদ’! গবেষণার চাইতে ওনাদের বিষয়ে আলোচনা বেশি হবে রাজনীতি নিয়ে। দেখে মনে হবে আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ, আর হাত কচলিয়ে কথা বলেই তিনি এ পদে এসেছেন, আবার এ পদে বহাল থাকতে পারবেন কিনা– সেটিও নির্ভর করবে, তিনি কতটুকু রাজনৈতিক সেবা দিতে পারবেন, তার ওপর। তাই তো তাকেও রাজনৈতিক পরিচর্যা করেই চলতে হয়। প্রাসঙ্গিক হোক বা না হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুষ্ঠানেই তিনি সভাপতি হয়ে রাজনৈতিক নেতাদের মতো বক্তৃতা দেবেন। আর সেসব ‘অসার’ বক্তৃতা শুনে উত্তরসূরিরা হাততালি দেবেন– এটাই তো স্বাভাবিক। কারণ, তাদের অনেকেরই প্রয়োজন বিভিন্ন পদ-পদবি। অনেক ভিসি অবসরে গেলে হবেন সংসদ সদস্য, না হয় রাজনৈতিক দলের উপদেষ্টা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে আমার বন্ধুরাও আছেন। অনেক সময় কথার মধ্যে আমি তাঁদের কাছে জানতে চেয়েছি– বিগত কুড়ি বছরের মধ্যে কোনও শিক্ষক রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছেন কিনা, তা তিনি যত মেধাবীই হোক না কেন! প্রায় সবাই প্রশ্নের জবাবটি এড়িয়ে গেছেন। বিব্রত হতে দেখে আমিও আর সামনে এগোতে পারিনি। যদিও এজন্য তারা দায়ী নন। তাহলে যে গাছের নিচে মাথা না নোয়ালে একজন মেধাবীরও চাকরি হবে না, সে গাছের মালি না হওয়াও তো এক ধরনের মোনাফেকি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের এমন নিম্নতর প্রথা আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই।

এ দেশে পৃথিবী সেরা আরেক ব্যতিক্রম হচ্ছে ‘ছাত্র রাজনীতি’। লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির নামে হেন অপকর্ম নেই, যা এই রাজনীতির মধ্যে নেই। রাজনৈতিক পরিক্রমায় যখন যে দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকে, তাদের অনুসারী ছাত্রনেতারা হয়ে যায় দুর্বার, অপ্রতিরোধ্য। নকলবাজি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ সব বাজিতেই তারা হয় বাজিকর।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ভিসি বা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষকে রাতে ঘুমানোর আগে তিন ঘণ্টা পড়াশোনা করতে হয়। পড়াশোনার বিষয়– পরবর্তী দিনে ছাত্রনেতাদের কী কী দাবি উঠতে পারে, এবং কীভাবে সেসব মেটানো যাবে। লেখাপড়ার মান নিয়ে ভাববার সময় তার কোথায়? এ নিয়ে অনেক রাজনীতিবিদকে কটূক্তি করতে দেখেছি; কিন্তু সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি আজও।

সম্প্রতি একটি রিপোর্টে দেখলাম, এক দশকে ১৬২ জন ছাত্র তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খুন হয়েছে ছাত্র রাজনীতির কারণে। আবরার হত্যাকাণ্ডের পরে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ আছে (!), যদিও কেউ প্রশ্ন করেনি যে ছাত্র রাজনীতি যদি খারাপই হয় এবং সেজন্য যদি তা বন্ধ করতে হয়, তবে কেন শুধু বুয়েটে? কেন অন্য প্রতিষ্ঠানে বন্ধ হবে না? হয়তো একমাত্র জবাব হতে পারে, এভাবে অন্য প্রতিষ্ঠানে কেউ মারা গেলে, তখন বন্ধ করা হবে।

দুনিয়াব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের মূল এবং একমাত্র কাজ হচ্ছে পড়াশোনা করা, দীক্ষিত হয়ে দেশ জাতি তথা বিশ্বকে সাজিয়ে তোলা। আর সেই কাজের দিকনির্দেশক হন শিক্ষকেরা। সেজন্য ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক পরিপূরক। শিক্ষকের মগজের একটি অংশে থাকে শিক্ষার্থীর মননশীলতার চিত্র। আর শিক্ষার্থীর মননে থাকে শিক্ষককে অনুসরণ, অনুকরণ। এভাবেই শিক্ষকের দিকনির্দেশনায় তৈরি হয় নতুন বিশ্বচিন্তা। ফলে শিক্ষকেরা হন সেরা এবং সর্বশ্রেষ্ঠ গোষ্ঠী।

দুর্ভাগ্য আমাদের। এ দেশের শিক্ষকদের অনেকেই দলান্ধ। মুক্তচিন্তা যেখানে অনেকেই সুদূরপরাহত। সমাজে বা রাষ্ট্রের কাছেও তারা একটি সামান্য শ্রেণির জাতিগোষ্ঠী। যদিও অনেক নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক রয়েছেন, যারা সব লোভ-লালসা উপেক্ষা করে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন দেশের তরে। সব প্রতিকূলতা মেনে নিয়ে, নিজের সাধ্যের সবটুকু দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।

অন্যদিকে ছাত্র সমাজও স্নেহসিক্ত গোষ্ঠীর পরিবর্তে পেয়েছে ‘অসভ্য গোষ্ঠী’র তকমা। বেয়াদবির ভয়ে অনেকেই এড়িয়ে যান ছাত্রদের অসভ্যতা দেখেও। যদিও অল্প কিছু ছাত্র ছাড়া বাকিরা হচ্ছে নিরীহ প্রাণী। তারা অসহায় নয়নে তাকিয়ে থেকে মলিন বদনে দিনাতিপাত করে। তাদের অসহায়ত্বই দাঁড়াবার ক্ষমতাকে কুরে খায়।

শিক্ষা প্রশাসনকে ভাবতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে। উচ্চশিক্ষাকে সংকুচিত করে বিশ্ববিদ্যালয়কে রূপান্তর করতে হবে গবেষণাগারে। সেক্ষেত্রে গবেষণার প্রায়োগিক দিক থাকতে হবে। দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থানীয় গবেষণার তথ্য-উপাত্তকে প্রাধান্য দিতে হবে। আর এজন্য নিয়মিত গবেষণা লাগবে। উন্নয়নের সব ক্ষেত্রেই (যেমন, শিক্ষা, কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ ব্যবস্থা, নগরায়ণ) গবেষণার ব্যবহার হতে হবে। মেধা পাচার রোধ করতেই হবে। গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি ও গবেষকদের লালন ছাড়া এ কাজ সম্ভব নয়। এছাড়া সব স্তরে কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে বিশাল এই যুবশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।

মনে রাখা দরকার, সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যার ঘনত্ব বাংলাদেশ থেকে সাতগুণ। সুতরাং অধিক জনসংখ্যার কারণে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে- এমনটি ভাবার কোনও কারণ নেই। শুধুই প্রয়োজন– সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত। সেক্ষেত্রে সবার আগে যেটি প্রয়োজন, সমাজপতিদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি গবেষণাগার হবে, নাকি রাজনীতির সূতিকাগার হবে।

লেখক: বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা), পিএইচডি (চীন)

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিমানযাত্রীর পকেট থেকে জ্যান্ত সাপ উদ্ধার
বিমানযাত্রীর পকেট থেকে জ্যান্ত সাপ উদ্ধার
ডু প্লেসি ঝড়ে গুজরাটকে পাত্তা দিলো না বেঙ্গালুরু
ডু প্লেসি ঝড়ে গুজরাটকে পাত্তা দিলো না বেঙ্গালুরু
দোহায় হামাসের কার্যালয় বন্ধের চিন্তা করছে কাতার
দোহায় হামাসের কার্যালয় বন্ধের চিন্তা করছে কাতার
ভিসা অব্যাহতি ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ নিয়ে মিশরের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা
ভিসা অব্যাহতি ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ নিয়ে মিশরের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ