X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

লতা মঙ্গেশকরের প্রস্থান: চিতা শরীর পোড়ায়, সংগীতকে নয়

আহসান কবির
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৮:১৭আপডেট : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৮:১৭

আহসান কবির চিতার আগুনে সবকিছু পোড়ানো যায়, সংগীত পোড়ানো সম্ভব না! – লতা মঙ্গেশকর                                      

সংগীতের ঈশ্বর সবার ভেতরে বাস করেন না। যার ভেতরে করেন তিনি থাকেন আকাশ উচ্চতায়! গানের সাত আসমান পেরিয়ে লতা মঙ্গেশকর মুখোমুখি হবেন ঈশ্বরের। লতার গান শুনতে পারবেন সরাসরি এমন ভেবে ঈশ্বর কী ভিন্নমাত্রার গানের পাখিকে দেখে মন ভালো করবেন? তাহলে লেখার শেষে আপনার কাছে সজল মিনতি জানাবো!

সব গান সরাসরি শোনা যায় না। কিছু সুর হয়ে ভাসে মেঘে। কোনটা নেমে আসে বৃষ্টি হয়ে। কিছু গান ভেসে আসে সাগরের ঢেউ হয়ে। কিছু খেলা করে জোয়ার ভাটায়। কিছু বেঁচে থাকে নদীর ভাষায়, কিছু সুর ভর করে পাখির কণ্ঠে। হয়তো সব প্রকৃতি কিংবা ঈশ্বরের সুর বিন্যাস। প্রায় সব ধরনের গান একজনের কণ্ঠে ভর করে না। গানের ঈশ্বর লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে যেন সবকিছুর মিশেল মেশানো গানের সুরধারা সাজিয়ে দিয়েছিলেন। লতা হয়ে উঠেছিলেন ভারতের সবচেয়ে সুরেলা কণ্ঠস্বর। সংগীতের সাম্পানে চড়ে সবাই ফিরতে পারেন না গানের ঈশ্বরের কাছে। লতাজি পেরেছেন। কারণ, স্বর্গ থেকে আসে গীত স্বর্গে যায় চলে।

যে গীত থেকে গেলো পৃথিবীতে লতা সেই গানেই বেঁচে থাকবেন। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ  বা শ্রীলঙ্কার কোটি কোটি মানুষ লতাজিকে সামনাসামনি দেখেনি। শুধু গান শুনেছেন। লতা থাকবেন না এই পৃথিবীতে কিন্তু তার গান থেকে যাবে আগের মতোই। যে লতার গান শুনতো সে শুনবেই। সবকিছু চিতাতে শেষ হয় না। যে গান ঐশ্বরিক সেটা কখনও চিতায় পোড়ে না! যে হৃদয় ঈশ্বরের, যে হৃদয় সংগীতের, মানুষের কাছে সেটা কখনও পুরনো হয় না। নাকি সংগীত নিজেই বিষণ্ন হয়ে পড়েছে লতাজির প্রয়াণে?

লতা মঙ্গেশকর কখনও পুরনো হবেন না। তিনি গানের সম্রাজ্ঞী হয়েছিলেন, সম্রাজ্ঞী হিসেবেই পৃথিবী ছেড়েছেন। সংগীত পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন, সংগীতের সাম্পান থেকে তীরে নামেননি কখনও। দ্বীননাথ ও সেবন্তী হরদিকর দম্পতির এই সন্তানের নাম ছিল ‘হেমা’। দ্বীননাথ হরদিকরের সংগীত ও নাটকের জগতে ছিল সমান বিচরণ। নিজের লেখা নাটক ‘ভাউবন্ধন’-এর লতিকা চরিত্রটা মাথায় চেপে বসেছিল দ্বীননাথের। মেয়ে হেমার নাম বদলে রেখেছিলেন লতা হরদিকর। পরে জন্মস্থান ইন্দোরের মঙ্গেশি শহরটাকে বিখ্যাত(?) করতে নাম রাখা হয় লতা মঙ্গেশকর! ‘মঙ্গেশি’ শহরটা আজীবন এই গানের পাখিকে ভুলতে পারবে না। হয়তো মানুষ বলবে ‘লতার শহর’।

লতাজিও ভোলেননি অনেক কিছু। তের বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের ‘ভার’ এসে পড়ে লতার ওপর। গানের জীবনটা শুরু হয়েছিল ব্যর্থতা দিয়ে। উনিশ বছর বয়সে সংগীত পরিচালক গুলাম হায়দার লতা মঙ্গেশকরকে নিয়ে গিয়েছিলেন শশধর মুখার্জির কাছে। ‘শহীদ’ চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেছিলেন। চিকন গলার জন্য সেই গান আর চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়নি। গুলাম হায়দার বলেছিলেন–‘একদিন পরিচালকরা এই মেয়ের পায়ে ধরে তাদের চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার জন্য ভিক্ষা করবে’! ৮২ বছর বয়সে এক সাক্ষাৎকারে লতা বলেছিলেন গুলাম আলির কথা। বলেছিলেন হায়দার সাহেবই তার জীবনের ‘গডফাদার’! বড় মানুষদের এমন কিছু গল্প থাকে জীবনে।

লতা মঙ্গেশকরের জীবনের গল্পও অনেক। হয়তো তিনি তেমন করে কখনও স্পষ্ট করেননি। তিনি কী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন? কেউ বলে ছোটকালে তিনি স্কুলে গেলে কোনও একদিন তাকে গান শেখাতে দেওয়া হয়নি বলে তিনি আর স্কুলে যাননি। কেউ কেউ বলে লতার বোন আশা মঙ্গেশকরকে স্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ বাদ সাধলে তিনি আর স্কুলমুখো হননি। তাতে লতার কোনও কিছু যায় আসেনি। লতা নিজেই স্কুল হতে পেরেছিলেন কিংবা স্কুল নিজেই আসতো লতাজির কাছে।

পুরস্কারও এসেছিল তার কাছে। বহুবার। তিনি বরাবরই ছিলেন যেকোনও ধরনের রাজনীতির বাইরে। তবু ভারতের সর্বোচ্চ সম্মানের পুরস্কারগুলো পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে ‘পদ্মভূষণ’, ১৯৯৯ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ আর ১৯৮৯ সালে দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার পান। ২০০১ সালে দ্বিতীয় সংগীত শিল্পী হিসেবে হয়েছেন ‘ভারতরত্ন’। ১২টি বাঙালি জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন ছাড়াও পেয়েছেন চারবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। একসময় শিল্পীদের জন্য ফিল্মফেয়ারের কোনও পুরস্কার ছিল না, ছিল সংগীত পরিচালকদের জন্য। লতাজির জন্য শিল্পীদের পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়, চারবার এই পুরস্কার পাবার পর তিনি এই পুরস্কার তাকে আর না দেওয়ার অনুরোধ করেন। ‘জুনিয়র’দের জন্য তিনি আশীর্বাদ আর অর্জনের জায়গাগুলো আলাদা করে রাখতেন।

নিজেকে আলাদা করে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন, ব্যক্তিগত জীবনে দেয়াল তোলা ছিল যেন। শুধু পরিবার থেকে আলাদা হননি কখনও। পরিবারের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে গিয়ে হয়তো তার বিয়ে করা হয়নি। লতাজির বোন আশা পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন। দুই সন্তানসহ একদা ফিরে এসেছিলেন লতার কাছেই, তবু তাকে ফেরাননি লতা।

পরিবারের দু’একজনকে বলেছিলেন আরেক সংগীতশিল্পী সায়গলকে তিনি খুব পছন্দ করেন। সায়গলের সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য ছিল অনেক। গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কিংবা ভূপেন হাজারিকার সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে গসিপ কম ছড়ায়নি। রাজস্থানের রাজপরিবারের সদস্য এবং একদা ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের কর্তাব্যক্তি রাজ সিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে তিনি মুখ খোলেননি কখনও। হয়তো গভীর কোনও সম্পর্ক ছিল। দুজন দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল’ হয়েই ছিলেন আজীবন। দুজনের কেউ বিয়ের পিঁড়িতে বসেননি!

হিন্দি ও উর্দু (গানের জন্য এই ভাষা শিখেছিলেন) ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় দখল ছিল না তার। তবু ৩৬টি ভাষায় তার গান আছে। একদা রেকর্ড করা সর্বোচ্চ গানের রেকর্ড ছিল লতার (প্রায় সাড়ে সাত হাজার)। পরে এই রেকর্ড ভাঙেন তার বোন আশা (তার কণ্ঠ দেওয়া ১০ হাজার গান রয়েছে)। ভারতকে তিনি বিশ্বের কাছে ‘সংগীতের দেশ’ হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। প্রায় বাহাত্তর বছর তিনি গানের সঙ্গে বসবাস করেছেন। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কার অন্তত পাঁচ প্রজন্মের কোটি কোটি মানুষ বেড়ে উঠেছে তার গানের সঙ্গে। প্রেম, বিরহ বা প্রতিবাদের দ্যোতনায় তার গান ছিল মনে রাখার মতো। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর লতাজির গাওয়া এক গানে কেঁদে উঠেছিল কোটি কোটি মানুষ। যুদ্ধ, বিয়ে বাড়ির উৎসব, প্রেম হবার পর আনন্দে কিংবা বিচ্ছেদের বিরহে, লোকগানের উন্মাদনায়, ভ্রমণের আনন্দে, একাকিত্বের অবসরে কিংবা চলচ্চিত্রের দ্যোতনায় লতা মঙ্গেশকরের গান ছিল মানুষের হৃদয়ের গানের সুধা। এই উপমহাদেশের অসংখ্য নারী গান শিখতে যেতেন লতা মঙ্গেশকরকে মনে রেখে। জীবনে ‘লতা’ হতে চেয়েছেন অনেকেই, কিন্তু ‘লতা’ ছিলেন একজনই। সংগীত নিজেই হয়তো লতার জন্য বিলাপ করছে আজ! এমন একজন লতার জন্য ভারতকে আর কত শত বছর অপেক্ষা করতে হয় কে জানে!

বিশেষ দ্রষ্টব্য: মারাঠি চলচ্চিত্রের এক পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে ‘আনন্দঘন’-এর নাম ঘোষিত হলো। সবার কৌতূহল এটা আবারে কে? সবাইকে অবাক করে দিয়ে পুরস্কার নিতে মঞ্চে ওঠেন লতা মঙ্গেশকর!

বাংলার না হয়েও বাংলাকে ভালোবেসেছিলেন লতা। বাংলা গানও গেয়েছেন কিছু। এই বাংলার যা কিছু অহংকার তার বেশিরভাগ জায়গা দখল করে আছে ভাষার জন্য আত্মাহুতি আর মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ‘ফান্ড গঠনের’ জন্য যাওয়া হয়েছিল লতা মঙ্গেশকরের কাছে। বলা হয়েছিল রিফিউজিদের আশ্রয় ও খাবার, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র কেনা হবে এই ফান্ডের টাকা দিয়ে। বাংলার মুক্তির কথা শুনে তখনই লতা লিখে দিয়েছিলেন এক লাখ টাকার চেক। ১৯৭১-এ এক লাখ টাকা অনেক! আরও কিছু অপেক্ষা করছিল বাংলার মুক্তিকামী মানুষের জন্য। তিনি তার কিছু গানের রয়্যালটির টাকা তুলে দিয়েছিলেন এই ফান্ডে!

বাংলার পক্ষে জনমত গঠনে নেমেছিলেন লতা মঙ্গেশকরও। ভারতের বিমান বাহিনীর সহায়তায় অজন্তা শিল্পী গোষ্ঠীর সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গান পরিবেশন করে ভারতে আটকে পড়া বাংলাদেশি রিফিউজিদের জন্য টাকা তুলতেন লতাজিও। স্বাধীনতার পর তার ভালোবাসার বাংলাদেশে তিনি এসেছিলেন ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি। ছিলেন দুই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। বাংলাদেশে আসার পঞ্চাশ বা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর তিনি ফিরে গেলেন ঈশ্বরের কাছেই।

শ্রদ্ধেয় লতা মঙ্গেশকর, যে বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য আপনি সহায়তা করেছিলেন, যে বাংলার রিফিউজিদের জন্য টাকা তুলতে আপনি বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গান গাইতেন, যেখানে গিয়েছেন সেখানে যদি ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা হয়, যদি ঈশ্বর আপনাকে গান গাইতে বলেন, আপনার কাছে সজল মিনতি করি, আপনি অন্তত একটা বাংলা গান গাইবেন!

মুক্তির আনন্দে যতদিন থাকবে বাংলার মানুষ, যতদিন থাকবে বাংলাদেশ, আপনাকে আমরা ভুলবো না কোনও দিন!

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পিছিয়ে থেকেও ব্রাজিলিয়ান-গ্রানাডিয়ানের গোলে আবাহনীর দারুণ জয়
পিছিয়ে থেকেও ব্রাজিলিয়ান-গ্রানাডিয়ানের গোলে আবাহনীর দারুণ জয়
শিশু হাসপাতালে আগুন: পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
শিশু হাসপাতালে আগুন: পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
অটোরিকশায় বাসের ধাক্কা, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা নিহত
অটোরিকশায় বাসের ধাক্কা, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা নিহত
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে: জাতিসংঘ
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে: জাতিসংঘ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ