X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন

নিয়ামজিত দাস
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৪:৫৮আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৪:৫৮
নিয়ামজিত দাস ২০২১ সালে সরকার দেশের মোট ৮৪৫১ মেগাওয়াটের উৎপাদন ক্ষমতার ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাদ দিয়েছে, যা ছিল পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলনে সবচেয়ে বেশি দূষণকারী দেশগুলোর জবাবদিহি আদায়ের উদ্যোগ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জলবায়ু সংক্রান্ত লড়াইয়ের জন্য ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) প্রধান হিসেবে বাংলাদেশ নেতৃত্বের জায়গায় থেকে গত বছর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জলবায়ু সহিষ্ণুতা ও প্রকৃতিভিত্তিক পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব দিয়ে স্থানীয়ভাবে বাস্তবায়নযোগ্য অভিযোজন পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করে ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান ২০৩০’ চূড়ান্ত করা হয়েছে। এছাড়া পরিবেশ অধিদফতর দেশের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে গত দুই বছরে প্রায় ৭০০টি অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ বন অধিদফতর বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে ৭.২৭ কোটি গাছের চারা রোপণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সে জন্যে উপকূলীয় অঞ্চলের ৯ হাজার ৪০০ একর জমিতে ম্যানগ্রোভ বনায়ন এবং সারা দেশে ১,৮০২ কিলোমিটার স্ট্রিপ গার্ডেনিংয়ের মাধ্যমে গাছের চারা রোপণ করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বছরটিতে পার্বত্য এলাকায় অতিবৃষ্টিতে পাহাড় ধস অন্যান্য বছরের চেয়ে কম ছিল।

বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা অনুসারে, বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর ক্ষেত্রে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে গত ১৫ বছরে (২০০৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে) প্লাস্টিকের ব্যবহার তিনগুণ বেড়েছে। ২০২০ সালে ৯ লাখ ৭৭ হাজার টন প্লাস্টিকের ব্যবহার হলেও তার মধ্যে মাত্র ৩১ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে। বাকিগুলো ভাগাড়, নদী, খাল, ড্রেন ও যত্রতত্র ফেলা হয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ টন প্লাস্টিক বাংলাদেশ থেকে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়। যার ফলে আমাদের বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশের কারণে শুধু সামুদ্রিক জীবন নয়, মানবস্বাস্থ্যের ওপরও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে। ১৯৯৫ সালের পর ঢাকায় ৪০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে, যা ২৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। কানাডাভিত্তিক এক কোম্পানির তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার মাতুয়াইল ভাগাড় প্রতি ঘণ্টায় চার টন মিথেন নির্গত করে, যা কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়ে ৮০ গুণ বেশি তাপমাত্রা বাড়ায়। বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশবিদদের মতে, দেশব্যাপী চলমান তাপপ্রবাহ এবং ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার জন্য অন্যতম প্রধান কারণ অনিয়ন্ত্রিত মিথেন নির্গমন।

গত বছর রাজধানী ঢাকা শহরে বায়ুদূষণ ১০ শতাংশ হারে বেড়েছে বলে একটি যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে। গবেষকরা বলছেন, ঢাকার এমন বায়ু স্বাস্থ্যের ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলছে। ফুসফুসের নানা রোগ, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিলতায় পড়ছেন ঢাকাবাসী।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় বর্ষাকাল আসছে আরও বেশি বৃষ্টি, আরও বেশি বিপদ নিয়ে। সায়েন্স অ্যাডভান্সেস জার্নালে প্রকাশিত নতুন এক গবেষণা বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের এ ধারণাকে আরও দৃঢ় করেছে।

বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরাও বলছেন, এ দেশেও বর্ষাকাল বদলে যাচ্ছে। দেশে বৃষ্টিপাত বাড়লে তাতে লাভই বেশি হবে, অনেক বিপন্ন নদী নাব্য ফিরে পাবে। আবার বৃষ্টির ফলে স্বাদু পানির সরবরাহ বাড়লে লবণের পরিমাণ কমে যাবে। এছাড়া বহু বছর ধরে উপকূলীয় কৃষকদের জন্য অভিশাপ ছিল মাটির অতিরিক্ত লবণাক্ততা। সেই লবণাক্ত মাটি থেকেই এখন ফসল (যেমন, তরমুজ ও সূর্যমুখী চাষ) ঘরে তুলছে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষক। বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজেনাস নলেজ-এর হিসাবে গত এক যুগে কৃষকরা নিজেরাই দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষম ৩৫টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন, সেগুলোর বেশিরভাগই অবশ্য মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে রয়েছে।

দেশের জীববৈচিত্র্য, পাখি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২-এর ৪৯ ধারার প্রদত্ত ক্ষমতা বলে এয়ারগান ব্যবহার বা বহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। এছাড়া স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সুন্দরবনে ১০০ কুমির অবমুক্ত করা হয়েছে। চট্টগ্রামের চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে একটি নতুন প্রজাতির ব্যাঙের দেখা মিলেছে, এই নতুন প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইনোগ্লোসাস সোয়ানবরনোরাম। নিউ ইয়র্কভিত্তিক ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৬২টি ডলফিন ও ৬টি তিমি মারা গেছে। আবার বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সাল থেকে গত ১৭ বছরে মানুষের হাতে হত্যার শিকার হয়েছে ১১৮টি হাতি।

গত বছর দেশের বিভিন্ন এলাকায় হত্যা করা হয় আরও নয়টি হাতি। মানুষ-সৃষ্ট কারণে বহু হাতি মারা গেলেও এখন পর্যন্ত কাউকে কোন শাস্তি দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি বন্যহাতি মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে এটি একটি বড় কারণ। প্রকৃতি বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের কারণে দেশে হাতি, বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হুমকির মুখে। এ অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ‘বঙ্গবন্ধু কনজারভেশন করিডোর’ নামে নিরাপদ করিডোর তৈরি করবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ভারত থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের কাসালং, সাক্সগু হয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত এশীয় হাতি ও বেঙ্গল টাইগারের জন্য আন্তদেশীয় নির্বিঘ্ন চলাচলের পথ বা করিডোর তৈরির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। এতে তিন দেশের হাতি ও বাঘের খণ্ডিত আবাসস্থলগুলোর ভেতর সংযোগ তৈরি হবে।

গত বছর সরকার বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর ৬ক ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ব্যাটারি প্রস্তুতকারী ও পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ, ব্যাটারি ভাঙা বা আগুনে গলানোর কার্যক্রম, অকার্যকর ব্যাটারি পণ্য নিরাপদ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সম্পর্কিত নির্দেশ জারি করেছে। পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা কর্তৃক প্রণীত গেজেট দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে Single-Use Plastic ব্যবহার বন্ধে পরিবেশ অধিদফতর কর্তৃক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া পরিবেশ অধিদফতর গত বছর শিল্পের জন্য EIA নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে।

লেখক: গবেষক (পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিভাগ), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশাল রিসার্চ ট্রাস্ট।

[email protected]
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ