X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

কিশোরী, তোমার সঙ্গে সাহসী হবো আমরাও

তুষার আবদুল্লাহ
১২ মার্চ ২০২২, ১৩:৪১আপডেট : ১২ মার্চ ২০২২, ১৩:৪১

তুষার আবদুল্লাহ বইমেলায় দূর থেকে এক কিশোরীকে দেখছিলাম। দৌড়ে দৌড়ে এক স্টল থেকে অন্য স্টলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ক্রমশ ওর হাতে বইরের ঝোলা বাড়তে থাকে। উঁকি দিয়ে, লুকিয়ে দেখছিলাম কী বিষয়ের বই কিনছে কিশোরী। ওর পাঠ রূচি দেখে আমি মুগ্ধ। আলাপ করতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু বই বাছাই আর কেনায় ও এতটাই ব্যস্ত যে থামানোর ফুরসত পাচ্ছিলাম না। এক সময় আমরা মুখোমুখি হই। জানতে চাই, কোথায় পড়ছে? জানালো দূরের এক জেলা শহরে পড়ে ও। দশম শ্রেণির ছাত্রী পরিবার থেকেই বইপড়ার নেশা তৈরি। শুধু নিজের জন্যই বই কিনছে না। কিনছে বন্ধুদের জন্যও। ওর অনেক বন্ধুকে বই পড়ার নেশা ধরিয়েছে। আমি ওকে অভিনন্দন জানাই। এবং জানতে চাই ওর শহরের খোঁজ খবর। এক পর্যায়ে এও জিজ্ঞেস করি, যৌন নিপীড়ন, যাকে আমরা ইভ টিজিং বলেও জানি, সেটা কমেছে কিনা। কিশোরী এককথায় বলে দিলো- না। বরং বখাটেদের উৎপাত বেড়েছে। এখন এককের চেয়ে বেড়েছে দলগত উৎপাত। দলবেঁধে বিদ্যায়তনের সামনে বা আসা যাওয়ার পথে তারা মেয়েদের উৎপাত করে বেড়ায়। শুধু ছাত্রী নয়, পথের যে কোনও মহিলাদেরও রেহাই দেয় না। কিশোরী জানালো,যতটা এসব নিয়ে প্রতিবাদ হতো, ততটা হয় না। কারণ এর সঙ্গে জড়িতরা রাজনীতির দোহাই দিয়ে চলে। ফলে বিচার পাওয়া যাবে না। বরং নিপীড়ন আরও বাড়বে, এই শঙ্কায় অনেকেই নিরব হয়ে থাকে। কিশোরীকে চা খাওয়ালাম। আর বললাম সাবধানে থাকতে। ওকে বিদায় দিয়ে মেলার এক প্রান্তে বসে ফেসবুক দেখছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়লো একটি চিঠির পাতা। চিঠি পড়ে মেলার মাঠের বাতি আর বইয়ের আলোর মাঝেই আমি যেন অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকলাম।

এক জেলা শহরের কিশোরী আত্মঘাতী হয়েছে। যৌন নিপীড়নের ঘটনায় অপমানিত হয়ে। আত্মহত্যার আগে কিশোরী একটি চিঠি লিখে যায় বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে- আত্মহত্যার আগে দু’টি চিঠি লিখে যায় আশামনি। একটিতে লিখেছে- ‘মা, আমার সঙ্গে ওয়াহাব চেয়ারম্যানের ভাতিজা আজ এক রুমে কাটাইছে। ও আমাকে খুব ডিস্টার্ব করতো। ও আমারে বলছে, ওর সঙ্গে দেখা করলে সে আমার জীবন থেকে চলে যাবে। কিন্তু ও আমার সঙ্গে খুব খারাপ কিছু করছে, যা বলার মতো না। বাবা-মা তোমরা ভালো থেকো। আর ছেলেটির নাম তামিম। ইতি তোমাদের আদরের আশামনি।’

অন্যটিতে লিখেছে- ‘মা, পারলে ক্ষমা করো। যদি কোনও বিচার করো, ছেলেটার নাম তামিম আহমেদ শপন খান। মা-বাবা তোমরা ভালো থেকো। আমাকে ভুলে যেও। আমি বেঁচে থাকলে তোমাদের সম্মান শেষ হয়ে যেতো। বাবা-মা আবার বলছি ভালো থেকো। গুড বাই, সোনা বাবা মা।’

এখনকার জেলা শহর, উপজেলা শহর, ইউনিয়ন আমার চেনা। নিয়মিত যাওয়া হয় দেশের নানা প্রান্তে। যে রাজধানীতে থাকি, তারও অলিগলি জানা। শহরের নেড়ি বা বেওয়ারিশ কুকুরকে ভয় পাই না। কিন্তু ভয় পাই কিছু উঠতি তরুণ ও কিশোরদের। তাদের চলার ভঙ্গী, বাচন শুনে দেখে আমি নিজেই আতঙ্কিত হই। পোশাক, চুলের নকশা, হাতের মোবাইল দেখে বিস্মিত হই, এরা কোথা থেকে টাকা পায় এমন চলন বলনের? উত্তর খুব সোজা-স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, উপনেতা, পাতি নেতাদের মোটরসাইকেলের শোভা যাত্রার মানুষ এরা। কিংবা তাদের পক্ষে জিকির তোলার লোক কিংবা পেটুয়া বা তোলা বাহিনীর সদস্য এরা। এদের হাতে পথ চলতি মেয়েরা উত্যক্তের শিকার হচ্ছেন। প্রতিবাদ করলে পরিবারের ওপরই হামলা চলে আসছে। কাউকে কাউকে তুলে নিয়ে নিগৃহীত করলেও বিচার পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় ক্ষমতাশালীদের সন্তান ও পরিজনরাতো আরও বেপরোয়া ও হিংস্র। তারা প্রশাসনকেও পরোয়া করছে না। কারণ তারা ক্ষমতাসীন দলকে ভাঙিয়ে চলছে। এরা এমনই। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে,  তখন তারা সেই দলের কর্মী হয়ে ওঠে। কারণ ওই রাজনৈতিক দল বা দলের নেতার প্রশ্রয়ে নিজেদের অপরাধটি নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারে।

যে কিশোরী আত্মঘাতী হয়েছে, তার আত্মঘাতী হবার জন্য আমরা দায়ী। কারণ আমরা এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করেছি, চেয়ারম্যান বা প্রভাবশালীর আত্মীয় ধর্ষণের মতো অপরাধ করলে, তার কোনও শাস্তি হয় না। অনেকক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে আপস করে ফেলা হয়। অবশ্যই ক্ষমতার চাপ বা হুঙ্কারে। নির্যাতনের শিকার নারী ও তার পরিবারের এলাকা ছাড়ার ঘটনাটাও স্বাভাবিক। আর নির্যাতনের শিকার নারীর ওপর পুরো দোষ চাপানোর রেওয়াজতো আছেই। ফলে ওই কিশোরী আর ভরসা রাখতে পারেনি সমাজের  কাছে। কিশোরীর কাছে মনে হয়েছে, তার জন্য ধর্ষণের চেয়ে আরও বড় নিপীড়ন অপেক্ষা করছে। সেই নিপীড়নের আগুনে পুড়তে পারে তার পরিবারও। তাই কিশোরী নিজেকেই সরিয়ে নেয় পৃথিবী থেকে।

কিন্তু কিশোরীর এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করছি না আমি। বরং নিজের জীবন বাঁচিয়ে ধর্ষক ও তার পরিবারের রূপ উন্মোচিত করার প্রয়োজন ছিল। কিশোরীর ওপর যে পীড়ন হয়েছে, তার সঙ্গে কোনও পীড়নের তুলনা চলে না। তবে এরচেয়েও বেশি পীড়নের প্রয়োজন ছিল চেয়ারম্যানের ভাতিজার। আমরা যদি সম্মিলিত ভাবে ধর্ষকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারতাম। চেয়ারম্যানের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে জানতাম, তাহলে কিশোরীও সাহসী হয়ে উঠতে পারতো। কিশোরীকে সাহসী হয়ে উঠতে বলার আগে, আমাদের নিজেদের সাহসী হয়ে উঠার তৌফিক অর্জন করতে হবে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কণ্ঠের সুচিকিৎসা দেশেই সম্ভব: বিএসএমএমইউ ভিসি
কণ্ঠের সুচিকিৎসা দেশেই সম্ভব: বিএসএমএমইউ ভিসি
গরু অথবা মাংস আমদানির বিকল্প কী?
গরু অথবা মাংস আমদানির বিকল্প কী?
ক্রিমিয়ায় রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের দাবি ইউক্রেনের
ক্রিমিয়ায় রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের দাবি ইউক্রেনের
প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে চান প্রধানমন্ত্রী
প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে চান প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ