X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস: শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা

আশরাফ সিদ্দিকী বিটু
২৫ মার্চ ২০২২, ০০:০৩আপডেট : ২৫ মার্চ ২০২২, ০০:০৩

আশরাফ সিদ্দিকী বিটু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতিকে চিরতরে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করতে পরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গণহত্যা চালানো হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে সংঘটিত গণহত্যা বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ও নিষ্ঠুরতম গণহত্যাগুলোর একটি। রাতের অন্ধকারে অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে চালানো হয় এই নৃশংস গণহত্যা।

নিরস্ত্র মানুষের ওপর এমন হত্যাযজ্ঞ বিশ্বে নজিরবিহীন। আওয়ামী লীগ ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিপুল জয় পেলে পাকিস্তানি জান্তা সরকার বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করে, মূলত ক্ষমতা দিতে শাসক শ্রেণি রাজি ছিল না। মার্চের এক তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। এ খবর ঢাকায় পৌঁছালে জনতা রাজপথে নেমে আসে। এ ঘোষণার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় হরতাল ও ৩ মার্চ সারাদেশে হরতালের ডাক দেন। শুরু হয় এক অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন। ২ মার্চ রাতে কারফিউ জারি করা হয়। কারফিউ ভেঙে সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

সে রাতে পাক সেনারা ৮ জন বাঙালিকে হত্যা করে। ৩ মার্চ পল্টনে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্সে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উত্তাল জনসমুদ্রে দিলেন এক ঐতিহাসিক ভাষণ। সংগ্রামের পূর্বাপর ইতিহাস তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ভাষণে ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কথা বলে নির্দেশ দেন শত্রুর মোকাবিলা করার। অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে এবং ১৫ মার্চ তিনি ৩৫ দফা নির্দেশনা দেন। বাঙালি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতো অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শাসকগোষ্ঠীর কয়েক দফা ব্যর্থ বৈঠক হয়। তলে তলে সুকৌশলে বৈঠকের নামে সামরিক জান্তা ঢাকায় সৈন্য ও সমরাস্ত্র আনা শুরু করেন। সময়ক্ষেপণ করে অপারেশন সার্চ লাইটের পরিকল্পনা সম্পন্ন করা হয়। এ অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল ঢাকাসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) প্রধান শহরগুলোতে বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা ও ছাত্রনেতাদের এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গ্রেফতার ও প্রয়োজনে হত্যা করে বাঙালিদের দুর্বল করে দেওয়া। পাশাপাশি সামরিক, আধা সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করে অস্ত্রাগার, রেডিও ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখলসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন কঠোর হস্তে দমন করে প্রদেশে পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।

মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা তখন পূর্ব পাকিস্তানের ১৪তম ডিভিশনের জিওসি ছিলেন। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে সামরিক অভিযানের অন্যতম পরিকল্পনাকারী তিনি। ‘আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি ইস্ট পাকিস্তান, ১৯৬৯-১৯৭১’ শিরোনামের একটি স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান টেলিফোনে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজাকে কমান্ড হাউজে ডেকে পাঠান। দুই জন সেখানে যাওয়ার পর টিক্কা খান তাদের বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আলোচনায় ‘প্রত্যাশিত অগ্রগতি’ হচ্ছে না। যে কারণে এখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘মিলিটারি অ্যাকশনে’র জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। আর সে কারণে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি সামরিক পরিকল্পনা তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছেন। সে অনুযায়ী ১৮ মার্চ সকাল থেকে ক্যান্টনমেন্টে খাদিম হুসাইন রাজার বাসায় রাও ফরমান আলী এবং তিনি দুই জন মিলে অপারেশন সার্চলাইটের খসড়া তৈরি করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা দুই জন পরিকল্পনার পরিসর নিয়ে একমত হন, এরপর দুই জনে দুটি আলাদা পরিকল্পনা লেখেন। ঢাকা অঞ্চলে সামরিক অপারেশনের দায়িত্ব নেন রাও ফরমান আলী, আর বাকি পুরো প্রদেশে অভিযানের দায়িত্ব নেন খাদিম হুসাইন রাজা। রাও ফরমান আলী পরিকল্পনায় তার অংশে একটি মুখবন্ধ লেখেন এবং কীভাবে ঢাকায় অপারেশন চালানো হবে তা বিস্তারিত লেখেন। ঢাকার বাইরে বাহিনী কী দায়িত্ব, কীভাবে পালন করবে তার বিস্তারিত পরিকল্পনা করেন খাদিম। সন্ধ্যায় খসড়া পরিকল্পনা নিয়ে তারা হাজির হন কমান্ড হাউজে।

খাদিম হুসাইন রাজা পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন এবং কোনও আলোচনা ছাড়াই পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সিদ্দিক সালিক। ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ শিরোনামের একটি বইয়ে তিনি ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নিয়ে লিখেছেন, জেনারেল রাও ফরমান আলী হালকা নীল কাগজের অফিসিয়াল প্যাডের ওপর একটি সাধারণ কাঠ পেন্সিল দিয়ে ওই পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, তিনি স্বচক্ষে সেই হাতে লেখা পরিকল্পনার খসড়া দেখেছিলেন। তাতে সামরিক অভিযানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, ‘শেখ মুজিবের ডিফ্যাক্টো শাসনকে উৎখাত করা এবং সরকারের (পাকিস্তানের) কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।’ সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিকল্পনা ছিল ১৬টি প্যারা সংবলিত এবং পাঁচ পৃষ্ঠা দীর্ঘ।

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দেশের বিভিন্ন ব্যারাকে ঘুরে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা তদারকি করলেও, অপারেশন সার্চলাইটে অংশ নেওয়ার জন্য সামরিক বাহিনীর কারও কাছেই কোনও লিখিত অর্ডার পাঠানো হয়নি। সময় জানিয়ে মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইনের কাছে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের কাছ থেকে ফোনটি এসেছিল ২৫ মার্চ সকাল ১১টায়। সংক্ষেপে বলা হয়েছিল, ‘খাদিম, আজ রাতেই’। সময় নির্দিষ্ট হয়েছিল রাত ১টা। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসেবে অবশ্য তখন থাকবে ছাব্বিশে মার্চ। হিসাব করা হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ততক্ষণে নিরাপদে করাচি পৌঁছে যাবেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২৪-২৫ মার্চ জেনারেল হামিদ, জেনারেল এ. ও মিঠঠি, কর্নেল সাদউল্লাহ হেলিকপ্টারে করে বিভিন্ন সেনানিবাসে প্রস্তুতি পরিদর্শন করেন। সিদ্ধান্ত হয়, ২৫ মার্চ রাত ১টায় অপারেশন সার্চলাইটের আওতায় অভিযানে ঢাকায় নেতৃত্ব দেবেন জেনারেল রাও ফরমান আলী। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে নেতৃত্ব দেবেন জেনারেল খাদিম রাজা। লে. জেনারেল টিক্কা খান ৩১ ফিল্ড কমান্ডে উপস্থিত থেকে অপারেশনের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করবেন। এ ছাড়া এই অভিযানকে সফল করার জন্য ইতোমধ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের দু’জন ঘনিষ্ঠ অফিসার মেজর জেনারেল ইখতেখার জানজুয়া ও মেজর জেনারেল এ.ও মিঠঠিকে ঢাকায় আনা হয়।

২৫ মার্চ বৃহস্পতিবার ছিল অসহযোগ আন্দোলনের ২৪তম দিন। দুপুরের পর থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। এদিন সকাল থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। হেলিকপ্টারযোগে তারা দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস পরিদর্শন করে বিকালের মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসে। দুপুরের পর বঙ্গবন্ধু কর্মীদের যার যার এলাকায় চলে যাবার নির্দেশ দেন। ২৪ তারিখই পশ্চিম পাকিস্তানের গণপরিষদ সদস্যরা ঢাকা ত্যাগ করে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সব পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ছেড়ে করাচি চলে যান। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর চোখ ফাঁকি দিতে পারেননি। তিনি ঠিকই জেনে যান প্রেসিডেন্ট ঢাকা ত্যাগ করেছেন। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তার বৈঠকে কোনও ইতিবাচক ফলাফল না পেয়ে বলেন, ‘ইয়াহিয়া খান সমস্যা সমাধানের জন্য সামরিক ব্যবস্থা বেছে নিলেন আর এখানেই পাকিস্তানের সমাপ্তি হলো।’ বঙ্গবন্ধু সবাইকে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য তৈরি হওয়ার আহ্বান জানান।

অপারেশন সার্চলাইট অভিযান শুরুর সময় নির্ধারিত ছিল ২৬ মার্চ রাত ১টা। কিন্তু সে রাতেই ঢাকার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিকামী বাঙালি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ও এ.এ.কে নিয়াজীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালেক মন্তব্য করেছেন যে বাঙালি বিদ্রোহীদের প্রবল প্রতিরোধ সৃষ্টির আগেই পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পৌঁছার লক্ষ্যে অভিযান এগিয়ে ২৫ মার্চ রাত ১১টা ৩০ মিনিটে শুরু করে। পাকিস্তান সৈন্যরা ১১টা ৩০ মিনিটে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে ফার্মগেটে মিছিলরত বাঙালিদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে অপারেশন সার্চলাইটের সূচনা ঘটায়। এরপর পরিকল্পনা মোতাবেক একযোগে পিলখানা, রাজারবাগে আক্রমণ চালায়। রাত ১টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন ইকবাল হল, জগন্নাথ হল, রোকেয়া হলসহ শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে ৯ জন শিক্ষকসহ বহু ছাত্রকে হত্যা করে।

একই পরিকল্পনার আওতায় পুরনো ঢাকা, তেজগাঁও, ইন্দিরা রোড, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ঢাকা বিমানবন্দর, গণকটুলী, ধানমন্ডি, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান প্রভৃতি স্থানে আক্রমণ চালায়। এ রাতে চট্টগ্রামে পাক সেনাদের গুলিতে অনেকে হতাহত হয়। মার্চ মাসের মধ্যেই অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনায় সেনানিবাসকে কেন্দ্র করে পাকবাহিনী তাণ্ডব চালায়। এ ছাড়া বাঙালির মুক্তির আন্দোলনে সমর্থনের কারণে ইত্তেফাক, সংবাদ ও দ্য পিপলস অফিসে অগ্নিসংযোগ করে। কয়েকজন সংবাদকর্মী আগুনে পুড়ে মারা যান।

২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানার তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্প, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল ও জহুরুল হক হলসহ সারা ঢাকা শহরে তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এক রাতের মধ্যেই তারা ঢাকা শহরকে মৃত্যুপুরী বানিয়ে ফেলে। একদিনে এত মানুষ একসঙ্গে হত্যা বিশ্বে নজিরবিহীন।

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঢাকা ছেড়ে গেলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার জন্য আগত পাকিস্তান পিপলস পার্টির সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে থেকে ২৫ মার্চ অভিযান প্রত্যক্ষ করেন। পরদিন ঢাকা ত্যাগের আগে প্রাক্কালে ভুট্টো সেনাবাহিনীর আগের রাতের কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে মন্তব্য করেন, ‘আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ যে পাকিস্তানকে রক্ষা করা গেছে।’ ইয়াহিয়া খানসহ সামরিক কর্মকর্তাদের সবাই অভিযানের প্রশংসা করেন। এমনকি পরবর্তী ৫ আগস্ট পাকিস্তান সরকার যে ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশ করে তাতে ২৫ মার্চ সামরিক অভিযানকে ‘অত্যাবশ্যকীয়’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

আর্চার ব্লাডের লেখা ‘দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’ থেকে জানা যায়, সে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে আগুন ধরানো হয়েছিল এবং ছাত্রীরা হল থেকে দৌড়ে বের হওয়ার সময় মেশিনগান দিয়ে গুলি করে তাদের হত্যা করা হয়েছিল। ২৬ মার্চ সকালের দিকে সেনাবাহিনীর কন্ট্রোল রুম ও ৮৮ ইউনিটের মধ্যে যে কথোপকথন হয় তার রেকর্ড থেকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই অগণিত ছাত্রছাত্রী নিহত হয়েছিল।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. নূরুল্লার ধারণকৃত ভিডিওটি আজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশবিকতার সাক্ষী। সেই ভিডিওরত দেখতে পাওয়া যায়, ছাত্রদের দিয়েই জগন্নাথ হলের মাঠে গর্ত খোঁড়া হচ্ছে, সেই গর্তে ছাত্রদের লাশ মাটিচাপা দেওয়া হচ্ছে। অনেক ঘরবাড়ি ও পত্রিকা অফিস, প্রেসক্লাবে আগুন ধরিয়ে কামান ও মর্টার হামলা চালিয়ে বিধ্বস্ত করা হয়। আগুন দেওয়া হয় শাঁখারি পট্টি ও তাঁতিবাজারের অসংখ্য ঘর-বাড়িতে। ঢাকার অলিগলিতে বহু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সে রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার হলো আরও ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘরবাড়ি, দোকানপাট লুট, আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহ কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। পুরো বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।’

এ গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা ও সামগ্রিক সংকট নিয়ে পাকিস্তানি সরকার কর্তৃক প্রকাশিত শ্বেতপত্র যা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ হয়। এতে বলা হয়: ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’

এ কালরাত্রিতে ঢাকায় নিহতের সংখ্যা সিডনির ‘মর্নিং হেরাল্ড’ লিখেছে ১০ হাজার থেকে ১ লাখ। আর ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ লিখেছে ১০ হাজার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমেরিকার ‘সেন্ট লুইস পোস্টে’ যুক্তরাষ্ট্রের একজন শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে লেখা হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোল্যান্ডে নাৎসিদের গণহত্যার পর এই হত্যাকাণ্ড হচ্ছে সবচেয়ে নৃশংস। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এর প্রতিনিধি সিডনি শ্যানবার্গকে ৩০ জুন (১৯৭১) ঢাকা থেকে বহিষ্কার করা হয়। নয়াদিল্লি গিয়ে তিনি ঢাকার কূটনীতিকদের বরাত দিয়ে বলেছেন, প্রথম তিন মাসে দুই থেকে আড়াই লাখ বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে।

সাইমন ড্রিং ৩১ মার্চ লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর ঢাকা মহানগরী মুহুর্মুহু তোপধ্বনিতে প্রকম্পিত হতে থাকে। সর্বত্র বোমা-বারুদের তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। টিক্কা খান বর্বর সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে নির্মমভাবে গণবিদ্রোহ দমনে সচেষ্ট হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের প্রধান কার্যালয় পিলখানা সেনা-অভিযানে বিধ্বস্ত হয়। নিরস্ত্র মানুষের ওপর সেনাবাহিনী নির্বিচারে ভারী আর.আর.গান, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ব্যবহার করে। ইকবাল হলকে তারা প্রধান আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। সেখানে প্রথম ধাক্কাতেই ২০০ ছাত্র নিহত হয়। একদিকে হলগুলোর দিকে উপর্যুপরি শেল নিক্ষেপ করা হতে থাকে, অন্যদিকে চলতে থাকে মেশিনগানের গুলি। দুদিন পর্যন্ত পোড়া ঘরগুলোর জানালা-দরজায় মৃতদেহ ঝুলে থাকতে দেখা যায়। পথে-ঘাটে মৃতদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। জগন্নাথ হলেও বর্বরোচিত আক্রমণ চালানো হয়। কয়েক শত ছাত্র, যারা প্রায় সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী, নিহত-আহত হয়। সৈন্যরা মৃতদেহগুলোকে গর্ত খুঁড়ে গণকবর দেয়। এরপর ট্যাংক চালিয়ে মাটি সমান করে। রিপোর্টের এক অংশে বলা হয়: ‘আল্লাহ ও পাকিস্তানের ঐক্যের নামে ঢাকা আজ এক বিধ্বস্ত ও সন্ত্রস্ত নগরী।’

‘Sydney Morning Herald’ প্রকাশ করে যে ঢাকার মাটিতে একমাত্র ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তান বাহিনীর হাতে এক লাখ মানুষ নিহত হয়। হত্যাকাণ্ড শুরুর প্রথম তিন দিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও অন্যান্য শহরে লক্ষ লক্ষ নর-নারী ও শিশু প্রাণ হারায়। ঢাকার প্রায় ১০ লাখ ভয়ার্ত মানুষ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে’ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ংকর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিরাপত্তা বিষয়ক আর্কাইভ’ তাদের অবমুক্তকৃত দলিল প্রকাশ করে। এতে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাযজ্ঞকে নিষ্ঠুর ও নির্বাচিত গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

২০১৭ সালের ১১ মার্চ ১০ম জাতীয় সংসদের ১৩তম অধিবেশনে ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে স্মরণ করে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হোক এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হোক’ মর্মে প্রস্তাবটি সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ১৪৭ ধারায় সংসদে উত্থাপন করা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে গণহত্যা সংক্রান্ত বিশেষ ভিডিওচিত্র ও স্থিরচিত্র প্রদর্শন করেন এবং বিরোধীদলীয় নেতাসহ ৫৬ জন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী এই প্রস্তাবের সমর্থন জানিয়ে ৭ ঘণ্টাব্যাপী আলোচনায় অংশ নেন। সর্বসম্মতিক্রমে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের প্রস্তাব পাস হয়। এরপর ২০ মার্চ মন্ত্রিসভার বৈঠকেও ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার বিষয়টি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। পরদিন ২১ মার্চ জারি হওয়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে দিবসটিকে ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসেবে পালনের অনুমোদন দেওয়া হয়। জাতীয় সংসদ ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত।

২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালন গণহত্যায় নিহত শহীদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘৃণ্য ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানানো। এই দিবস পালন আমাদের জাতিগতভাবে পাকিস্তানি বর্বরতার সাক্ষ্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থাপনের অন্যতম প্রক্রিয়াও যার মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৫ বছরে হিটলারের বাহিনী প্রায় ৬০ লাখ মানুষ হত্যা করেছিল। আর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালে ৯ মাসেই হত্যা করে ৩০ লক্ষাধিক মানুষ। তাই এটা বলা যায়, বিশ্বে সবচেয়ে বৃহৎ গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও আদায় সম্ভব। পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সংঘটিত এই গণহত্যার স্বীকৃতিও আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ ও সংরক্ষণে প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করছে। আমরা জানি আর্মেনিয়ার গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে ১০০ বছর লেগেছিল। তাই আমাদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতেই হবে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকার আন্তরিক। ইতোমধ্যে ২০টি আমাদের পক্ষে দেশের স্বীকৃতি অর্জন সম্ভব হয়েছে এবং আরও ৬০টির বেশি দেশের স্বীকৃতি প্রয়োজন। জেনোসাইড ওয়াচ এবং লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদানে অনুরোধও জানিয়েছে, যা আমাদের শক্তি জোগাবে।

মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আর্জেন্টিনা, হংকং, পোল্যান্ডসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করে পাঠদান করা হচ্ছে। বিশ্বের অনেক গবেষকও একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে বিভিন্ন কাজ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ কোর্স চালু করা হয়েছে।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ ও জাতিকে সঠিক ইতিহাস উপহার দিতে কাজ করছে এবং ইতিহাস বিকৃতি বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে তরুণ প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে পারছে। দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। এই দেশে এখনও স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের বংশধররা রয়েছে যারা ইতিহাস বিকৃতি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চায়। গণহত্যা দিবস পালন এই ইতিহাস বিকৃতিকারীদের অপকর্মকে ব্যর্থ করে দেবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি দিনক্ষণ ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ এবং এসব বিষয় সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দিনগুলো পালন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা আমাদের সংগ্রাম-ত্যাগ ও রক্তদানের গভীর ইতিহাসকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত ছড়িয়ে দেবে। শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে এবং আমাদের ঋণও কিছুটা লাঘব হবে।

আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী, স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছি। এটা আমাদের গর্বের। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যায় এই প্রত্যয় আমাদের থাকতে হবে। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসে সব শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক: মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিশ্বসাহিত্যের খবর
বিশ্বসাহিত্যের খবর
দেশজুড়ে এমপিরাজ শুরু হয়েছে: রিজভী
দেশজুড়ে এমপিরাজ শুরু হয়েছে: রিজভী
স্কুল ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ