X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালির মুক্তির মার্চ মাস: প্রসঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু

ড. জেবউননেছা
২৫ মার্চ ২০২২, ১৬:৫৬আপডেট : ২৫ মার্চ ২০২২, ১৬:৫৬
ড. জেবউননেছা বিশ্বায়নের এই যুগে পৃথিবী ক্রমেই নতুনরূপে উপস্থাপিত হচ্ছে। প্রায় সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর কোনও ব্যত্যয় ঘটেনি। সময়ের দ্রুতগামিতার কারণে বিচিত্র মাত্রার আলোড়ন গতির ধারাবাহিকতাকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ উৎস থেকে উৎসারিত একটি দেশ। মুক্তিযুদ্ধ তার রক্ত সংকল্পের গর্বময় অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার যে কতটা মহান ও তাৎপর্যপূর্ণ তা কেবল প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের জানা, আর কারও নয়। তাই নানা বিভ্রমের কুয়াশায় মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই স্বপ্ন ও আদর্শ আপাত চোখে ধূসর হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্ম এই ইতিহাসকে তার সঠিক কৌণিকতায় চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। কোনও কোনও শক্তি অতিরঞ্জন আর কোনও কোনও শক্তি আক্রমণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শুদ্ধতম ধারণাকে পর্যুদস্ত করছে। এখন চাই ওই শুদ্ধতম ধারণাকে বলিষ্ঠতম কাঠামোর ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা। তাহলে তার পুনরুৎপাদনে মুক্তিযুদ্ধের সব সংকলন ও স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করতে হবে। এটি হতে পারে নতুন নতুন পর্বে।

উৎসাহে ও উদ্দীপনায় নতুন সব ইন্ধন। গভীর নিষ্ঠা পেয়ে আমি অনুভব করেছি যে সব বিভ্রান্তিকে দূর করে আমাদের অহংকার সমৃদ্ধ এই ঐতিহ্যকে সুন্দরভাবে এবং স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত রাখতে হবে। ক্ষুদ্র হলেও এই ধারণায় বিশ্বাস নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষণায়  উদ্যোগী হয়েছি। বিন্দু বিন্দু দিয়ে সিন্ধু রচিত। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও এ দেশের প্রত্যেকটি মানুষকে আমি মুক্তিযোদ্ধা বলবো। কেননা, যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনি তারা কি অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। না, তা নয়। কারণ, হয়তো কারও বোন তরুণী ছিল তাকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য যুদ্ধে যেতে পারেননি ভাইটি। হয়তো কারও ঘরে বৃদ্ধা বাবা-মা ছিল, হয়তো কারও ঘরে ছিল সন্তানসম্ভবা স্ত্রী। এতদসত্ত্বেও কেউ থেমে থাকেনি। সবাই যুদ্ধ করেছেন, করেছেন প্রতিরোধ যার যা ছিল তাই নিয়ে। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে দুই শতাধিক বছরের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের অবসান ঘটায়। বহু দেশপ্রেমিকের প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছে এই দেশ। আবহমানকালে ইতিহাসে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়টি নতুন নয়। বারবার বহিঃশক্তি বাংলাদেশকে আক্রমণ করেছে, করতে চেয়েছে পদানত। বাঙালি শত্রুকে কখনও সংস্কৃতির পরোক্ষ জালে জড়িয়ে কখনও প্রত্যক্ষ বাহুবলে ঠেকিয়ে জাতীয় অস্তিত্বকে ঠেকিয়ে রেখেছে। ব্রিটিশরা এই অঞ্চলটিকে প্রায় দুই শত বছর শাসন ও শোষণ করেছে। তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। জেল খেটেছেন। দ্বীপান্তরে গিয়েছেন। বহু আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে এই দেশটি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামে পরিচিতি লাভ করে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে দূরত্ব প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার। তবে মানুষগুলোর মধ্যেও ছিল বিশাল দূরত্ব। তাদের সামগ্রিক বিষয়গুলো ছিল ভিন্ন। শুধু একটি বিষয়ই মিল ছিল– সেটি হচ্ছে ধর্ম। আশ্চর্যের বিষয়, এক ধর্মের মানুষ হয়েও শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, পুলিশ, মিলিটারি সবকিছুতেই বৈষম্য প্রদর্শন করতে লাগলো পশ্চিম পাকিস্তানিরা। বিভিন্নভাবে নিপীড়ন শুরু করলো অর্থনৈতিক নিপীড়নের পর শুরু করলো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর নিপীড়ন। পাকিস্তানের শুরুতেই তারা ‘উর্দু’ ভাষাকে চাপিয়ে দিতে চাইলো পশ্চিম পাকিস্তানিরা। কিন্তু না বাঙালি জেগে উঠলো। ভাষার জন্য প্রাণ দিলো বাংলার মানুষ। প্রতিষ্ঠিত হলো মাতৃভাষা বাংলা। অতঃপর বঙ্গবন্ধু প্রণীত ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭০-এর বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করলে ও পাকিস্তানিরা ক্ষমতা দিতে চাইলো না। আর তখন থেকেই বাঙালিদের মধ্যে আন্দোলনের উত্তাল জোয়ার বইতে শুরু করলো। অতঃপর পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের ইতিহাসে নিষ্ঠুরতম গণহত্যা শুরু করলো। নারী-শিশু-পুরুষ-মুসলিম-অমুসলিম কেউ রক্ষা পেলো না এই হামলা থেকে। ঢাকা শহরকে করলো তারা লাশের শহর। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো সারা দেশে। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। সেই জঘন্যতম গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি স্বাধীন পতাকার লক্ষ্যে নারী-পুরুষ সবাই মিলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে সংঘটিত হলো ২৬৬ দিনের স্বাধীনতা সংগ্রাম। এই সংগ্রাম সফল হয়েছে পুরুষের পাশাপাশি। নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে। নারীরা সশস্ত্র সংগ্রাম করেছেন। প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে চিকিৎসক হিসেবে, আশ্রয়দাত্রী, শব্দসৈনিক, সুর সৈনিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নারীদের  বিশাল অংশগ্রহণের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে অল্প সময়ের মধ্যে জয়। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহর পর্যন্ত নারীরা মুক্তির লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন।

আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণে যুদ্ধের মাধ্যমে যে বাংলাদেশ পেয়েছি, সে যুদ্ধে নানাভাবে সাহায্য প্রদান করেছেন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষার্থী, খেটে খাওয়া মানুষ। ১৯৭১-এর ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু বলেন,  ‘আমার মৃত্যু হলেও আমি আপনাদের সঙ্গে বেইমানি করতে পারবো না। রক্ত দিয়ে হলেও আমি আপনাদের ঋণ শোধ করবো। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ নম্বরের বাসায়  স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর আগে ১৯৭১-এর ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চূড়ান্ত যুদ্ধের রণকৌশল ঘোষণা করেন তিনি। ১৯৭১-এর ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসকে ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। ছাত্রলীগ প্রতিরোধ বাহিনী ঢাকার পল্টন ময়দানে এক আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ করে  বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গেয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। এদিন বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন, সাত কোটি মানুষের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে। উল্লেখ্য, এই মার্চ মাসের ১৭ তারিখ ১৯২০ সালে জাতির পিতা জন্মলাভ করেন। বাংলার জনগণের স্বাধীনতা আনয়নের জন্য এই মার্চ মাস যেন বাঙালির মুক্তির মাস। ইতিহাসের দিকে ফিরে  তাকালে দেখা যায় বাংলাদেশ মার্চ মাসে পেয়েছে তার পূর্ণতা। এই মহামানবের জন্ম মাসে ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসেবে ১৯৫২ সালের পূর্ব পর্যন্ত প্রতিবছর পালিত হতো। এই ভাষা আন্দোলনে ১৯৪৮-১৯৪৯ সালে উল্কাবেগে সারা বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু জনমত গঠনের লক্ষ্যে ঘুরে বেড়ান। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট, ঢাকা শহরে বিক্ষোভ এবং পিকেটিং করা হয়। হরতালের সময় ২০০ জন আহত, ১৮ জন গুরুতর আহত এবং ৯০০ জন গ্রেফতার হন।  ঢাকায় সচিবালয়ের সামনে থেকে  শেখ মুজিবুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করে। স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এই দিন বঙ্গবন্ধু প্রথম গ্রেফতার হন। ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি মুক্তিলাভ করেন। উত্তাল মার্চ যেন আমাদের জীবনে বলিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে আছে। ১৯৭১-এর ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ছাত্র সমাবেশে প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এই মার্চেরই ৭ তারিখে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণে স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয়েছিল এবং ২৫ মার্চ তারিখে গভীর রাতে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাক হানাদার বাহিনী গ্রেফতার করে পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ কারাগারে অন্তরীণ করে রাখে। সেখান থেকে মিনাওয়ালি কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতারের পূর্বে তারবার্তার মাধ্যমে  ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তিনি। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে জাতির পিতার সামনে কবর খোঁড়া হয় কিন্তু তিনি আপস করেননি, নুয়ে পড়েননি।

১৯৭১-এর পরেও মার্চ মাস ছিল গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীন বাংলাদেশকে বেশ কয়েকটি দেশ এই মার্চেই স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৭২ সালে  ২ মার্চ গাম্বিয়া, ৪ মার্চ শ্রীলংকা, ১০ মার্চ সোয়াজিল্যান্ড, ১১ মার্চ গ্রিস, ১৩ মার্চ সুইজারল্যান্ড, ২১ মার্চ লোসোনা, ২৩ মার্চ বতসোয়ানা, ২৫ মার্চ,জ্যামাইকা, ২৮ মার্চ তাইওয়ান এবং ১৯৭৩-এর ২৮ মার্চ লেবানন, ১৯৭৪-এর ৪ মার্চ কাতার, ১০ মার্চ সংযুক্ত আরব আমিরাত, ২১ মার্চ কঙ্গো প্রজাতন্ত্র স্বীকৃতি প্রদান করে। এই মার্চেই  ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ  জাতির পিতার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৮ মার্চ ১৯৭৩ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু  এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘শোষকের স্থান সোনার বাংলার মাটিতে নেই।’ মার্চ যেন নানা চড়াই-উতরাইয়ের ঘটনাবহুল মাস।

১৯৭১-এর মার্চে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার পরই মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। সেই সরকারের  দক্ষ নির্দেশনায় এগিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান তাদের দূরদর্শিতায় এগিয়ে যায় স্বাধীনতা যুদ্ধ। মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা কমিটি ও দূরদর্শী ব্যক্তিদের পরিচালনায় সফল হয় মুক্তিযুদ্ধ। এই পরিষদের সদস্য ছিলেন মওলানা ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, কমরেড মনি সিংহ। মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ, বিভিন্ন বাহিনী গঠন, ১১টি সেক্টর ও টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত সেক্টর ছাড়াও জুন মাস নাগাদ ব্রিগেড আকারে তিনটি ফোর্স গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত করা, কাদেরিয়া বাহিনী, ক্র্যাক প্লাটুন, মুজিব বাহিনী, গেরিলা বাহিনী, গণবাহিনী, মুক্তিবাহিনী, ন্যাপ সিপিবি ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনীর সাহসী  ভূমিকা অনস্বীকার্য। অপারেশন জ্যাকপট পরিচালনা, ১৯৭১-এর ২৮ সেপ্টেম্বর  বিমান বাহিনী এবং ১৯৭১-এর জুলাই মাসে  নৌবাহিনী গঠন, ১৯৭১-এর ২৫ মে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে নানান অনুষ্ঠান প্রচার,মুজিবনগর সরকার কর্তৃক ‘জয়বাংলা’ পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে  এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁর পতাকা হাতে নেয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। দীর্ঘদিনের শোষণ জাঁতাকল থেকে মুক্তি পায় সাধারণ জনগণ।

মহান নেতা বঙ্গবন্ধু কারাবাস করে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন কাজে হাত দেন।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন একান্ত সচিব ড. ফরাসউদ্দিন তাঁর একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে বলেছিলেন, ‘তিনি টুঙ্গিপাড়া চলে যেতে চান, তার পরিবার নিয়ে, কিন্তু জাতীয় চার নেতা এবং বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী বলেন, তাকে গ্রামে যেতে দেওয়া হবে না। এরপর তিনি দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি যেদিন উপ-সচিব, নথি-২ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন সেদিন বঙ্গবন্ধু তাকে আড়াই ঘণ্টা নানান দায়িত্ব বয়ান করেন। শেষ কথা বলেন, ‘দেখরে আমি গরিব দেশের প্রধানমন্ত্রী, এটা সবসময় মনে রাখবি। তোর কাছে সুট, টাই পরা অনেক লোক আসবে, তাদের কাজগুলো করে নেবে। কিন্তু যার গায়ে ঘামের গন্ধ থাকবে, যার গায়ে ময়লা কাপড়চোপড় থাকবে, লুঙ্গি পরা থাকবে, তাদের কাজ করে দিবি, তাদের কাজ করে আমাকে জানাবি। এই কথা বলতে বলতে তিনি কেঁদে দেন। একমাত্র তিনিই গণমানুষের নেতা।

কোন দেশে এমন নেতা পাবেন? প্রেসিডেন্ট হাউজে অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন ক্যারিয়ারে দেশি মাছ আসতো বাসা থেকে। ম্যাসেঞ্জারকে জিজ্ঞেস করতেন, খেয়েছে কিনা, তখন তাকে নিয়ে বসে খেতেন। বিদেশে গেলেও তিনি এমনটি করেছেন। এই হলো আমাদের নেতা শেখ মুজিব।’

মাটি মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিত্বে ছিলেন অটল। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে আলজিয়ার্স বৈঠকে বঙ্গবন্ধু বাদশাহ ফয়সালকে বলেছিলেন, ‘এক্সেলেন্সি, বেয়াদবি নেবেন না। আমি হচ্ছি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আমার তো মনে হয় না মিসকিন-এর মতো বাংলাদেশ আপনাদের কাছে কোনও সাহায্য চেয়েছে?’– এই এতটুকু উত্তরে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বকে চেনা যায় ভেঙেছেন কিন্তু মচকাননি।

টুঙ্গিপাড়ার খোকা নামের যে ছেলেটি যিনি নিজের জামা, ছাতা, গোলার ধান মানুষকে দিতেন, এক মুষ্ঠি করে চাল সংগ্রহ করে মানুষের মাঝে বিতরণ করতেন, সেই মানুষটি ৩০৫৩ দিন কারাবাস করে, সংগ্রাম করে হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু। যিনি স্বপ্ন দেখতেন মানুষ ভালোভাবে থাকবে, মানুষ একটি সুন্দর জীবন পাবে,দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খেতে পাবে। কারণ সাধারণ মানুষের কষ্ট তাকে পীড়া দিতো। এই মানুষটির জন্ম না হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হতো না। তিনি ১৯৭২ সালে এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘কৃষকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে আমি জানি শোষণ কাকে বলে’। বীরাঙ্গনা নারীদের বলেছিলেন, সবার ঠিকানা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর লিখে দাও’। ১৮ মার্চ, ১৯৭৩ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলাম; আজ স্বাধীনতা পেয়েছি; সোনার বাংলা দেখে আমি মরতে চাই।’  সত্যি তিনি সোনার বাংলা দেখে মৃত্যুবরণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু বারবার তাঁর শত্রুদের উদারতা দিয়ে ক্ষমা করেছেন । কিন্তু সেই উদারতার প্রতিদান পেয়েছেন ১৮টি বুলেট।

কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে  নিউজ উইক ম্যাগাজিন তাদের প্রচ্ছদে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ আখ্যায়িত করে নিবন্ধ প্রকাশ করে। একজন বঙ্গবন্ধু যিনি বিরাজ করেন সর্বত্র। লেখাটি শেষ করবো বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত জাতীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত অনুষ্ঠানে এক ভাষণের কথা উল্লেখ করে। তিনি বলেছিলেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও দরকার’।  

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা আজ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া বাংলার মানুষের জন্য জনগণের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্যই দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তারই ফলশ্রুতিতে  স্বাধীনতার ৫১ বছরে বাংলাদেশ  ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী বিশ্বের ৪১তম অর্থনীতির দেশ।

জয় বাংলা।

লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ