X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

গরিবের চোখে সুখের পানি

সাদ্দিফ অভি
২৬ এপ্রিল ২০২২, ১৮:২০আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২২, ১৮:২০

সাদ্দিফ অভি বিয়ের পর থেকে দেবরের বাড়ির বারান্দায় সংসার করতেন মরিয়ম। এই এক বারান্দায় পার করেছেন ৫০ বছরের দাম্পত্য জীবন। জীবন সংগ্রামে খেটে খাওয়া এই দম্পতির অবশেষে মিলেছে আশ্রয়ণ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষে দিয়েছেন একটি ঘর উপহার। সেই ঘরে এখন তারা নতুন করে স্বপ্ন বুনছেন। বলছিলাম জলবায়ুর ঝুঁকিতে থাকা দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাতক্ষীরার এক গৃহহীনের কথা। যার একটি ঘরের কথা ভাবলেও চোখের কিনার বেয়ে নেমে আসতো দুঃখের জল। গৃহহীন এসব মানুষের চোখে এখন সুখের পানি এনেছে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর। একে একে পালটাচ্ছে জীবনযাত্রার মান।  

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প শুধু দেশেই নয়, আলোচিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলেও। গৃহহীন অসহায় মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এমন প্রকল্পের নজির নেই বিশ্বে। মুজিববর্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার করেছেন যে – একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না। প্রধানমন্ত্রীর এমন মহৎ উদ্যোগের পেছনে আছে দূরদর্শিতা। আমি নিজে আশ্রয়ণ প্রকল্প দেখতে ঘুরেছি অন্তত ১২টি জেলা। দক্ষিণবঙ্গ থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গ সব জায়গায় এই গৃহহীন মানুষদের একটিই কথা- কোনও দিন ভাবিনি একটা ঘর হবে। আশ্রয়ণ প্রকল্প শুধু কিন্তু ঘর দিচ্ছে না, ঘরের জায়গাসহ জমির মালিকানাও দিচ্ছে। তাদের কারও লাগছে না ঘর ভাড়া। সেই অর্থ তারা বিনিয়োগ করছেন জীবনমান উন্নয়নে। একজন মানুষের মাথার ওপর ছাদ না থাকার দুঃখ কেবল সেই বুঝতে পারে, যার আছে সে এই সুখ অনুধাবন করতে পারবে না। মাথার ওপর নিজের একটি ছাদ এলেই কীভাবে একটি মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে দেয়, এই প্রকল্প হচ্ছে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।  

আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের কাজ দেখতে প্রথম গেলাম জলবায়ুগত কারণে ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলোতে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের সংকেত পেলেই যে মানুষগুলো ছুটতেন আশ্রয়কেন্দ্রে, তারা পেয়েছেন আধা-পাকা ঘর। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এসব মানুষের ঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত প্রায়ই সময়। এক একটি ঘর পুনরায় দাঁড় করাতে বছর খানেক সময় চলে যেত। তারপর আবারও সেই ঘর ভাঙা দুশ্চিন্তা ভর করতো দুর্যোগের মৌসুমে। এসব মানুষের কাছে একটি ঘর করার অর্থ ছিল প্রথম থেকে আবার জীবন শুরু করা, যা মোটেও সহজ নয়। এখন তারা ঘর পাচ্ছেন সঙ্গে জমির মালিকানাও পাচ্ছেন, জীবন সাজানোর স্থায়ী ভাবনা এখন তাদের মনে। কারণ, আর ঘরের জন্য বাস্ত্যুচ্যুত হতে হবে না।

প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নিয়ে অনেকের অনেক প্রশ্ন সামনে এসেছে। অনেক ঘর ভেঙে পড়ার অভিযোগও এসেছে। তবে সারা দেশে যে পরিমাণ ঘর দেওয়া হয়েছে তাতে সেই সংখ্যা ১-২ শতাংশের বেশি না। ত্রুটি থাকতেই পারে যেকোনও পরিকল্পনায়, তবে এখানে ইতিবাচক দিক হচ্ছে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ঘর নির্মাণের অভিজ্ঞতা সরকার কাজে লাগাচ্ছে তৃতীয় পর্যায়ের ঘর নির্মাণে। তৃতীয় পর্যায়ের ঘর তৈরি হচ্ছে দুর্যোগের কথা মাথায় রেখে। আর তার জন্য বাড়ানো হয়েছে বরাদ্দ। এই প্রকল্পের কয়েকটি ইতিবাচক দিকের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জমি নির্বাচন। এই জমি নির্ধারণে নেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। নির্দেশনা দেওয়া আছে, যেখানে মাটি ভরাট করা হবে সেখানে যেন অন্তত ৬ মাসের আগে কাজ শুরু করা না হয়।  তিন ধরনের জমিতে তৈরি হচ্ছে আশ্রয়ণের ঘর। সরকারি খাস জমি, বেদখল হওয়া সরকারি জমি এবং কেনা জমি। জমি কিনে ঘর করে দেওয়ার নজিরও বিশ্বে এই প্রথম।

সরকার গৃহহীন মানুষদের ঘর করার জন্য ইতোমধ্যে সাড়ে পাঁচ হাজার একর বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার করেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মার্চ মাস পর্যন্ত দেশের আট বিভাগ থেকে উদ্ধারকৃত জায়গার পরিমাণ পাঁচ হাজার ৫১২ দশমিক ০৪৭৩ একর। এরমধ্যে ঢাকার  ১৩টি জেলায় এক হাজার ৩৯২ দশমিক ১১ একর, ময়মনসিংহের ৪ জেলায় ৩৩৩ দশমিক ৮৪ একর, চট্টগ্রামের ১১ জেলায় ৫৫৬ দশমিক ৯৭ একর, রংপুরের ৮ জেলায় ৯৪২ দশমিক ৪১৮ একর, রাজশাহীর ৮ জেলায় ৫৯৪ দশমিক ৭৪ একর, খুলনায় ১০ জেলার ৭৮৫ দশমিক ০৬ একর, বরিশালের ৬ জেলার ৩৬১ দশমিক ৭৬১ একর এবং সিলেটের ৪ জেলায় ৫৪৫ দশমিক ১৩৭ একর সরকারি খাস জমি উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত এই জায়গার আনুমানিক বাজার মূল্য ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা প্রায়। এই টাকা দিয়ে ঘর করা যেত আরও কয়েক লাখ। মুজিববর্ষে উপলক্ষে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে এক লাখ ১৭ হাজার ৩২৯টি। তৃতীয় পর্যায়ে আরও ৬৫ হাজার ৪৭৪টি ঘর নির্মাণের কাজ চলছে। ১৯৯৭ সাল থেকে এই প্রকল্পের আওতায় ৭ লাখ ৮ হাজার ৩টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। পাঁচ জন এক পরিবার হিসেবে সেই জনসংখ্যা ৩৫ লাখ ৪০ হাজার ১৫ জন। আসন্ন ঈদের আগে তৃতীয় পর্যায়ে আরও প্রায় ৩৩ হাজার ঘর হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কেউ যদি প্রশ্ন করে ঘর পেয়ে জীবনমান কীভাবে বদলাচ্ছে তাহলে আমি বলবো একটু স্বচক্ষে দেখুন। আমি যেখানেই গিয়েছি উপহারের ঘর পাওয়া মানুষদের সঙ্গে একদম খুঁটিনাটি বিষয়ে কথা বলেছি। তারা আগে কীভাবে ছিল এবং এখন কীভাবে জীবনধারণ করছে তার তফাৎ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি।  সুবিধাভোগী মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম পটুয়াখালীর বিচ্ছিন্ন উপজেলা রাঙ্গাবালিতে। সেখান থেকে গেলাম আরেক বিচ্ছিন্ন চর মন্তাজে। শুধু যে সমতলের সাধারণ মানুষকে ঘর দেওয়া হচ্ছে তা নয়। সেখানে গিয়ে দেখলাম মান্তা সম্প্রদায় ঘর পেয়েছে। নৌকায় যাদের জীবন এবং নৌকায় যাদের মরণ বলা হতো তারা এখন সমতলের বাসিন্দা। তাদের আছে সেমিপাকা ঘর, আর ঘরে এসেছে বিদ্যুৎ। তাদের ঘরে এখন লাইট-ফ্যান চলে। ঘর পাওয়া থেকে বঞ্চিত নেই সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরাও। বেদে সম্প্রদায়ের জন্য সবচেয়ে বড় আশ্রয়ণ প্রকল্প হচ্ছে ঝিনাইদহের কালিগঞ্জে।

ঘর পাওয়া একেক এলাকার মানুষের জীবনে এসেছে একেক রকম পরিবর্তন। আখাউড়া উপজেলায় দেখলাম আশ্রয়ণের সারি সারি ঘর। সেখানে নিজ ঘরের সামনে চাষাবাদ করছেন সেখানকার বাসিন্দারা। এখনকার একজন বাসিন্দার দেখলাম ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা রাখার গ্যারেজও আছে। কথা বলে জানলাম, চুরি যাতে না হয়ে যায় তাই বাড়ির সামনে খালি জায়গায় এই ঘর করা হয়েছে। হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষও পাচ্ছে ঘর। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার মন্ত মিয়া উপহারের ঘর পেয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় দিয়েছেন চায়ের দোকান। পরিবার ও সমাজ থেকে বিতাড়িত সে এখন পরিবার নিয়ে সমাজের মধ্যে বসবাস করছে। কিনেছেন সিএনজি চালিত অটোরিকশা। এভাবেই বদলে যাচ্ছে তাদের জীবন একটি ঘরেই।  

আমার কাছে সবচেয়ে বিস্ময়কর লেগেছে বেশিরভাগ জায়গায় গৃহহীন মানুষ উপহারের ঘর আগলে রাখছেন। ঘর বরাদ্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজের তদারকি করছেন। নিজেরা এসে পানি দিচ্ছেন যাতে ঘরটি টেকসই হয়। সম্পূর্ণ তৈরি ঘরের বারান্দায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন এসব মানুষ। বারান্দায় বসেই বিভিন্ন সময় এসব মানুষের সঙ্গে কথা বলি আমি। তাদের চোখের দিকেই তাকাই আর নির্মম সত্যটি খুঁজতে চেষ্টা করি। ঘর পেয়ে খুশি তো তারা? ঘর পাওয়ার অনুভূতি বলার সময় তাদের চোখ ছলছল করে, কাঁধে হাত রেখে বলে বুঝানোর চেষ্টা করে, অনুভূতি আর শব্দে ব্যক্ত করতে পারে না। আমি বুঝে নিই সেই অনুভূতি। আমি নিজ চোখে না দেখলে হয়তো বলতে পারতাম না যে তারা দুই হাত তুলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করে। এই দোয়া মন থেকে এমনিতেই তাদের আসে। কেউ তাদের শিখিয়ে দেয় না। তারা শেখ হাসিনার নাম শেখানো ছাড়াই উচ্চারণ করেন আর বলেন- আল্লাহ তুমি তারে দেখে রাইখো। কারণ, তারা জানে জীবনে নিজের একটি ঘর ও জমির মূল্য কী।

লেখক: স্টাফ রিপোর্টার, বাংলা ট্রিবিউন

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে ১৮ দেশের আহ্বান
জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে ১৮ দেশের আহ্বান
অডিও ফাঁস, নারীর কাছে ডিবি পুলিশ সদস্যের ‘হেরোইন বিক্রি’
অডিও ফাঁস, নারীর কাছে ডিবি পুলিশ সদস্যের ‘হেরোইন বিক্রি’
উপজেলা নির্বাচনে নেই বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল
উপজেলা নির্বাচনে নেই বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ