X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মা সম্মানিত, তবে তাকে নিয়ে বেশি গালি কেন?

জোবাইদা নাসরীন
০৯ মে ২০২২, ১৬:৪০আপডেট : ১৩ মে ২০২২, ১৭:৫৯

‘ওমা তোমার বাচ্চা এত শুকনা কেন? খাওয়া দাওয়া করতে চায় না তেমন? বাচ্চাদের অনেক কিছু খাওয়া শেখাতে হয়। বাচ্চারা কি রোজ এক জিনিস খেতে পছন্দ করে? মা হওয়া কি এত সহজ? আর ওকে তো বয়সের তুলনায় একটু ছোটই মনে হচ্ছে। এখনই মনোযোগ দাও, পরে কিন্তু পস্তাবা।’– এই তো ঈদের পরের দিনই একটি বাসায় আমার সঙ্গে দাওয়াত খেতে আসা একজনকে এমন মন্তব্য ছুড়ে দিলেন একজন। আমার সামনেই সেই মেয়েটির মুখ ভার হয়ে গেলো, সে খুব বেশি কিছু খায়নি। আমার মনে হচ্ছিল তিনি খুবই অপরাধ বোধে ভুগছেন। সমাজের কাছে তার অপরাধ তিনি বাচ্চাকে ভালো করে দেখভাল করতে পারছেন না।

গতকাল বিশ্ব মা দিবস চলে গেলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক মায়ের ছবি ভেসে এলো। মায়ের প্রতি ভালোবাসার স্তুতিবাক্যে সিক্ত হয় মন। ‘মায়ের চেয়ে আপন আর কেউ নেই, মায়ের আশ্রয় সবচেয়ে নিরাপদ এবং ভালোবাসাময়, মায়ের মতো কেউ সন্তানের জন্য জীবন উৎসর্গ করে না’, এবং গোত্র সংস্কৃতি, ধর্মভেদে সব সমাজেই মা পূজনীয়, মাকে সবচেয়ে বেশি সম্মান দেওয়া হয়।

সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা নারীকে দেবীর আসনে নিয়েছিল, যে কারণে আমি দেখতে পাই কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী কিংবা দুর্গার মতো প্রতাপশালী দেবীদের। অন্যদিকে তাত্ত্বিকদের মতে এই সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতাই নারীকে অধস্তন করেছে, ঘরের মধ্যে বন্দি করেছে। কারণ, সমাজ বলছে নারী সন্তান জন্ম দেয় বলে সন্তান লালন-পালনের দায়িত্বও তার। নারীর দেহকে দেখা হচ্ছে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে। যে কারণে বিয়ের সঙ্গেই রয়েছে সন্তান উৎপাদনের প্যাকেজ।

একটি মেয়ে একটু বড় হওয়ার পরই সমাজের প্রশ্ন ‘বিয়ে হচ্ছে না কেন? বিয়ে করলে, সুখবর কবে পাবো কিংবা বাচ্চা নিচ্ছো না কেন? বাচ্চা হলে, একটা কেন? আরেকটা তাড়াতাড়ি নিয়ে নাও। ছেলে হলে মেয়ে নেই কেন? মেয়ে  হলে ছেলে নেই কেন? বাচ্চা রেজাল্ট খারাপ করলো কেন? বাচ্চা ‘খারাপ’ হয়ে গেলো কেন? মা কী করে সারা দিন? সুতরাং সমাজের কাছে ‘মা হওয়া’ শুধু জন্মদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, সন্তানের সব দায়িত্ব পালন তাকেই করতে হবে আর এই  দায়িত্বের মধ্য দিয়ে সমাজ তাকে উপহার দেবে ‘ভালো মা’ আর ‘খারাপ মায়ে’র তকমা।

এর পাশাপাশি আরও আছে, মা হওয়া যদি এত আনন্দেরই হয় তাহলে সেই মায়ের আগে ‘বৈধ’-‘অবৈধ’ প্রশ্ন তুলে আমরা সেই মাতৃত্বেও কলঙ্ক আরোপ করি। সমাজের কাছে অতি কাঙ্ক্ষিত মাতৃত্ব আরও অনেক বেশি হয় অনাদৃত হয় বাবার ‘বৈধ’ পরিচয়ের অভাবে, যখন সুন্দর সন্তানটিকে ‘জারজ’ বলা হয়। যে কারণেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের সন্তানকে এ দেশে রাখতে অনেকেই অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।

শুধু কী তাই? গতকালকের ফেসবুক ভেসে গেছে মায়েদের খুব সুন্দর সুন্দর ছবি দিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হলো যে মাকে আমরা এত ভালোবাসি তাহলে কী করে এই দেশের সবচেয়ে খারাপ গালিগুলো মাকেই নিয়ে তৈরি? এবং অবলীলায় সেটিকে অনুমোদন দিই এবং চর্চা করি। তখন কিন্তু আমাদের একবারও মনে হয় না মা যদি আমাদের এত সম্মানের হয় তাহলে মাকে নিয়েই কেন এত গালি?

মা সন্তানের জন্য সবকিছু ত্যাগ করবে, পরে খাবে, জীবন উৎসর্গ করবে– এটাই ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু মা একজন মানুষ, তার অন্য সবার মতো অধিকার আছে সেটি আমরা মানতে চাই না। মা সবার পরে খাবে, মায়ের কাছে আমাদের সবার আবদার পূরণের জন্য– এটাই আমরা ভাবতে ভালোবাসি। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে মাকে যে আমরা অধিকার বঞ্চিত করছি সেটির দিকে খেয়াল আমাদের খুবই কম। কারও মা মারা গেলে বাবার দ্বিতীয় বিয়েকে সমাজ ‘ঘর সংসারের’ দোহাই দিয়ে যেভাবে বৈধ করে ঠিক সেভাবে বৈধ হয়ে ওঠে না বাবার মৃত্যুর পর মায়ের বিয়ে। কারণ, সমাজে কাছে ‘মা’ নারী তবে সেই মায়ের কোনও যৌবন, মন কিছুই থাকবে না, সে মায়ের কোনও অধিকার থাকবে না, সেই মা শুধু ‘মা’ নামক চিত্রের মধ্যেই বন্দি থাকবে। মায়ের কারও সঙ্গে সম্পর্ক হলে কিংবা বাচ্চাদের থেকে দূরে চলে গেলেই বলা হয়, তিনি কেমন মা, বাচ্চাদের রেখে চলে গেলেন? কারণ, আমাদের কাছে মা মানুষ নয়, একটা চরিত্র মাত্র। আর আমরা সেটা দিয়েই একজন মানুষকে পরিমাপ করতে থাকি।

মা নারীর একটি খোলস। আমরা মাকে মহিমান্বিত করি, কিন্তু নারীকে নয়। যার কারণে সবাইর তো মা-বোন আছে– এই বাক্য বলেই আমরা নারীদের যৌন হয়রানি করি।

বেশ কয়েক বছর ধরে এ দেশে ‘রত্নগর্ভা’ মায়েদের সম্মান দেয় কোনও কোনও বেনিয়ারা। জানি না এই ‘রত্ন’-এর মাপকাঠি কী? আরও জানি না এই মায়েদের কয়জন তাদের নিজেদের সিদ্ধান্তে সন্তান ধারণ করেছিলেন। সন্তান নেওয়ার বিষয় যখন বিয়ে প্যাকেজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তখন কয়জন মায়ের অসম্মতি কিংবা সিদ্ধান্ত জানতে চাওয়া হয়? সেই গর্ভের মূল্য তো আসলে যন্ত্রের মতই। তাই গর্ভের অধিকারহীন এই ‘রত্নগর্ভা’ তকমা আসলে কার কী উপকার করছে জানি না।

আমরা মায়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে অনেক বেশি সংঘর্ষহীন মনে করি। কিন্তু আসলেই কী তাই? আমরা এটিকে রোমান্টিসাইজড করি, একটি অসীম ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখি, এর বা‌ইরে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। কারণ, আমরা কেউই সমাজের কাছে ‘খারাপ’ মা হতে চাই না।

ঔপন্যাসিক মহাশ্বিতা দেবীর একটি সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম একদিন। ছেলে নবারুণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না বিশ বছরের অধিক সময়। সমাজে কাছে হয়তো তিনি ‘ভালো’ মা ছিলেন না। কিন্তু মুণ্ডাদের কাছে তিনি ছিলেন মা। তিনি স্পষ্টই দেখেছেন মা আসলে কোনও প্রাকৃতিক কিংবা জৈবিক বিষয় নয়, এটি সমাজের নির্মাণ। সেখান থেকে পিছলে গেলেই সমাজের রক্তচক্ষু।

আরও মজার বিষয় লক্ষ করবেন পাঠক, সব মা একা দাঁড়িয়ে নেই।

মা দিবসে দেখা গেলো অনেক নারীই মায়ের সঙ্গে নিজের শাশুড়ির ছবি দিয়েছেন এবং দুই মায়ের প্রতিই হয়তো অভিবাদন জানিয়েছেন। কিন্তু একেবারেই হাতে গোনা দু‌ই-একজন ছাড়া কোনও পুরুষই শাশুড়ির ছবি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মায়ের স্বীকৃতি দেন না। কারণ, তিনি সমাজকে ভয় পান। হয়তো সেটি করলেই তাকে নিয়ে ট্রল শুরু হবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এভাবেই ‘মা’কে দেখতে অভ্যস্ত।

কিছু দিন আগে একটি গবেষণার কাছে ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম। পুরুষ উত্তরদাতা জানালেন, স্ত্রী যখন তার শাশুড়ির সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন, তখন স্ত্রীকে মারেন। আর স্ত্রী অবাক করে বললেন, ‘আমার মায়ের বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে এই বাসায় এসে প্রথম গালিটা আমার মাকেই দেয়। তখন আমার কেমন লাগে? পাঠক বুঝতেই পারছেন সেই গালিটা কী?

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ