X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

তামাকপণ্যে কর বাড়ালে রাজস্ব বাড়বে

ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত
৩১ মে ২০২২, ১৪:৩৭আপডেট : ৩১ মে ২০২২, ১৭:০৩

আজ বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এবারের প্রতিপাদ্যের সঙ্গে পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধের সম্পর্ক রয়েছে। পাশাপাশি, পরিবেশের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত। যে কারণে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জাতীয় উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

একটি দেশকে তামাকমুক্ত করতে নানান পথ অবলম্বন করা যেতে পারে। তবে কর বৃদ্ধি সম্ভবত সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি। বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবেও প্রমাণিত। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন দেশ এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করে কার্যকর ফল পেয়েছে। যুগোপযোগী ও কার্যকর কর পদ্ধতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে, সরকার তামাক খাত থেকে পেতে পারে ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকার বাড়তি রাজস্ব। ফলে জাতীয় উন্নয়ন তো বটেই, তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমে গিয়ে বছরে তামাকের কারণে মৃত্যু হওয়া ১ লাখ ৬১ হাজারের গ্রাফটাও নিম্নগামী করানোর সুযোগ থাকে। তাতে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমরা কিছুটা স্বস্তি পাই।

ইতোমধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এখন থেকেই তামাকের কর বৃদ্ধির ব্যাপারে কথা বলা জরুরি। নিজেদের অবস্থান থেকে সব উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আর এক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা। ২০১৬ সালে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করতে হবে। আমরা সেই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যেতে চাই।

গত অর্থবছরে আমরা সিগারেটে যে ধরনের কর ও মূল্য বৃদ্ধি দাবি করেছিলাম, তার শতভাগ বাস্তবায়ন হয়নি। নিম্ন ও মধ্যম স্তরের সিগারেটের মূল্য বৃদ্ধির দাবিও খুব একটা দৃশ্যমান হয়নি। এই দুই স্তরে সিগারেটের মূল্য বৃদ্ধি না করলে দেশের সবচেয়ে বড় ধূমপায়ী গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে। তাই এবারও সব সিগারেট ব্র্যান্ডে অভিন্ন করভারসহ (সম্পূরক শুল্ক চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৬৫%) মূল্যস্তরভিত্তিক সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ (সম্পূরক) শুল্ক প্রচলন করা অর্থাৎ, নিম্ন স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৫০ টাকা, মধ্যম স্তরে ৭৩ টাকা, উচ্চ স্তরে ১২০ টাকা এবং প্রিমিয়াম স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১৫২ টাকা নির্ধারণ করার সুপারিশ করছি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বরাবরের মতো এবারও সিগারেটের ব্র্যান্ডসমূহের মধ্যে দাম ও করহারের ব্যবধান কমিয়ে মধ্যমেয়াদে মূল্যস্তরের সংখ্যা ৪টি থেকে ২টিতে নামিয়ে আনার দাবি রইলো। পৃথিবীতে আর কোনও দেশে এত মূল্য স্তর নেই।

কর ও মূল্য বৃদ্ধি করতে হবে বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যেরও। ফিল্টারযুক্ত ও ফিল্টারবিহীন বিড়িতে অভিন্ন করভারসহ (সম্পূরক শুল্ক চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৪৫%) সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ (সম্পূরক) শুল্ক প্রচলন করে ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১১.২৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করে ৯.০০ টাকা সুনির্দিষ্ট শুল্ক আরোপ করতে হবে। দেশে ধোঁয়াবিহীন তামাকের মূল ব্যবহারকারী নারী। ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য (জর্দা ও গুল) নিয়ন্ত্রণে, প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৪৫ টাকা নির্ধারণ করে ২৭.০০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা দরকার। এছাড়াও প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১৫.০০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করতে হবে। এর ফলে উভয় ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কের হার হবে চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৬০ শতাংশ।

বরাবরই বলে আসছি, তামাক সংশ্লিষ্টরা অত্যন্ত কৌশলী। আমাদের তাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। এক্ষেত্রে তামাকের ব্যবহার কমাতে বাজেটে কয়েকটি বিষয় নিয়ে কাজ করা গেলে আমরা উপকৃত হতে পারি। উল্লেখিত উপায়ে মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি–

  • স্বাস্থ্য বিষয়ক লক্ষ্য অর্জন এবং রাজস্ব আয় সম্পর্কে সঠিক পূর্বানুমান করতে অ্যাড ভ্যালোরেম-এর পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট কর পদ্ধতি প্রবর্তন এবং করহার নিয়মিতভাবে মূল্যস্ফীতি ও আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। নিম্ন স্তরের সিগারেটের মূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করতে হবে।
  • সিগারেট বাজারের সিংহভাগ দখল করে রেখেছে এই স্তরের সিগারেট। বিড়ির দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়ানো যাতে সস্তা সিগারেট ও বিড়ির মধ্যে মূল্য পার্থক্য কমে আসে এবং এসব তামাকপণ্যের মধ্যে ভোক্তার পছন্দ পরিবর্তন নিরুৎসাহিত হয়।
  • এছাড়াও ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি কর আহরণ নীতির বাস্তবায়ন আরও জোরদার করা, একইসাথে প্রমিত প্যাকেট/কৌটার (standardized packaging) প্রচলনসহ অন্যান্য করবহির্ভূত পদক্ষেপ অনুসন্ধান/বাস্তবায়ন করা।

প্রস্তাবনাগুলো এসেছে বিভিন্ন তামাকবিরোধী সংস্থার যৌথ গবেষণার মাধ্যমে। খেয়াল করে দেখলাম, এগুলো বাস্তবায়িত হলে যে ফলাফল আসবে; তাতে জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম; সব ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসবে। সিগারেটের ব্যবহার ১৫.১% থেকে হ্রাস পেয়ে ১৪.০% পাবে। কেবল সিগারেট খাত থেকেই বাড়তি ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকাসহ প্রায় ৩৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে। প্রায় ১৩ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপান থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত হবে এবং ৮ লক্ষ ৯৫ হাজারের অধিক তরুণ ধূমপান শুরু করতে নিরুৎসাহিত হবে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, দীর্ঘমেয়াদে ৪ লক্ষ ৪৫ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৪ লক্ষ ৪৮ হাজার তরুণ জনগোষ্ঠীর অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে। শুরুতেই বলেছি, যা সম্পূরক শুল্ক, স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ এবং ভ্যাট বাবদ ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রত্যাশিত রাজস্বের চেয়ে ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা বেশি।

বিশ্বব্যাপী যতগুলো দেশে তামাকের ব্যবসা রমরমা, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দেশের ৩৫.৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কোনও না কোনও তামাক ব্যবহার করেন। আমরা ১০৯টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ধূমপায়ীর দিক থেকে নবম অবস্থানে আছি। এই তামাকের কারণে বিভিন্ন অসংক্রামক রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। এরমধ্যে নারী-শিশুও রয়েছেন। তবে তাদের মধ্যে পরোক্ষ ধূমপানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। টোব্যাকো এটলাসের একটি গবেষণায় এসেছে, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রসহ পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ।

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা নানান উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। যা বিভিন্নভাবে ফলপ্রসূ হচ্ছে। গত কয়েক বছরে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যাও কিছুটা কমেছে। তবে খুশি হওয়ার মতো ততটা নয়। অনেকেই বলেন, তামাক খাত থেকে যে রাজস্ব আয় আসে; তা দিয়ে দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নেওয়া হয়। এই খাত তাই বন্ধ করার নয়। কথাটা সত্যি নয়। কর যা আসে, তারচেয়ে ক্ষতি বেশি হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, অথচ একই সময়ে (২০১৭-১৮) তামাক খাত থেকে সম্পূরক শুল্ক ও মূসক বাবদ অর্জিত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ মাত্র ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। তাই আমাদের এমন কিছু ভাবতে হবে, যা থেকে আমরা আরও বেশি রাজস্ব আয় পাবো; পাশাপাশি তামাক ব্যবহারকারীদের সংখ্যাও কমে আসবে।

সেই উপায় খুঁজতেই তামাকপণ্যে যুক্তিযুক্ত ও কার্যকরী করব্যবস্থা ও মূল্যবৃদ্ধি বাস্তবায়ন জরুরি। এ ব্যাপারে ৮৬ জন মাননীয় সংসদ সদস্য মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছেন। আমাদের আন্তরিকতা আছে। আমি বিশ্বাস করি, আন্তরিকতার বাস্তবায়ন হবেই।

লেখক: অধ্যাপক; সংসদ সদস্য; চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিং; প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পহেলা বৈশাখের নির্দেশনা উপেক্ষা উদীচীর: যা বলছে ডিএমপি
পহেলা বৈশাখের নির্দেশনা উপেক্ষা উদীচীর: যা বলছে ডিএমপি
সিডনির গির্জায় ছুরিকাঘাতকে সন্ত্রাসী হামলা ঘোষণা
সিডনির গির্জায় ছুরিকাঘাতকে সন্ত্রাসী হামলা ঘোষণা
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১২ জনের
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১২ জনের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ