X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

বয়ঃসন্ধিকাল ও কিশোর অপরাধ: পশ্চিমা ডিসকোর্স বনাম বাংলাদেশি বাস্তবতা

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
১৮ জুন ২০২২, ১৮:৩৩আপডেট : ১৮ জুন ২০২২, ১৮:৩৩
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশু-কিশোরের সংখ্যা ৪ কোটি। এই ৪ কোটির মধ্যে ১ কোটি ৩০ লক্ষ শিশু ও কিশোর ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত। এদের মধ্যে অধিকাংশ আবার দারিদ্র্যের কারণে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অপরাধের সঙ্গে শিশু-কিশোরদের সংশ্লিষ্টতা বাড়ছে কিনা তা জানার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হয়ে ২০০৮ সালে একটি গবেষণা করেছিল। ওই গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, শিশু ও কিশোর অপরাধীদের গড় বয়স ছিল ১৪ দশমিক ৯ বছর। সমাজ ও রাষ্ট্র ভেদে নানা কারণে কিশোর অপরাধ হলেও তার মধ্যে কয়েকটি কারণ প্রায় সব রাষ্ট্রেই দেখা যায়; যেমন- ভাঙা-পরিবার বা ‘ব্রোকেন ফ্যামিলি’, বৈষম্য, দারিদ্র্য এবং পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোধের সংকট।

বিভিন্ন গবেষকের প্রবন্ধেও এই প্রতিপাদ্যের সমর্থন রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ওয়েস্টার্ন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনাল জাস্টিস প্রোগ্রামের পরিচালক রোনাল্ড সি ক্রামার তার এক প্রবন্ধে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে সংঘটিত ‘স্কুল শুটিং’-এর কারণ হিসেবে সামাজিক সমস্যাকেই দায়ী করা চলে। অধ্যাপক ক্রামার বলেন, বৃহত্তর সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়সমূহ, যেমন- দারিদ্র্য, বৈষম্য, এবং ‘সোশাল এক্সক্লুশন’ বা সামাজিক বহির্ভুক্তি আমেরিকার অধিকাংশ যুবা-সহিংসতার মূল কারণ।

একবিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ সমাজে প্রত্যেকটি ব্যক্তি মানুষের জীবনকে বড় দাগে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়– এক. ‘চাইল্ডহুড’ বা শৈশব; দুই. ‘ অ্যাডোলোসেন্স’ (Adolescence) বা বয়ঃসন্ধিকাল; তিন. ‘অ্যাডাল্টহুড’ বা প্রাপ্ত বয়সকাল। বয়সের হিসাবে জন্মগ্রহণের পর থেকে ৯ বছর পর্যন্ত শৈশব; ৯ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত বয়ঃসন্ধিকাল; এবং ১৮ বছর থেকে বাকি সময়টি প্রাপ্ত বয়সকাল বলে ধরা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে যে একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের গড় আয়ু যখন সমাজ ভেদে ৬০ থেকে ৯০ বছর, তখন আমরা ব্যক্তি মানুষের জীবনকে শৈশব, বয়ঃসন্ধিকাল ও প্রাপ্ত বয়সকালে ভাগ করছি; এই বিভাজন কিন্তু ইতিহাসের সব সময়ে সব সমাজে এই রকম ছিল না। ফরাসি ঐতিহাসিক ফিলিপ এরিএস (Philippe Aries) জানাচ্ছেন যে মধ্যযুগে শৈশব ছিল ক্ষণস্থায়ী। তখনকার ইউরোপীয় সমাজে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩২ থেকে ৩৫ বছর।

সপ্তদশ শতাব্দী থেকে শৈশবের সময়কাল বাড়তে থাকে এবং এটি প্রাপ্ত বয়সকাল থেকে পৃথক হতে শুরু করে। ফিলিপ এরিএসের মতে, ঠিক ওই সময় থেকে আমরা বয়ঃসন্ধিকালের মানুষ অথবা শিশু কিশোরদের শারীরিক, নৈতিক ও যৌন বিকাশ নিয়ে ভাবতে শুরু করি। আজকে বৈশ্বিকভাবে শিশুদের সুরক্ষা ও নিবিড় পরিচর্যার যে কথা বলা হয়, সেই ধারণার সূত্রপাত সেই সময়ে যখন থেকে শৈশব মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ বলে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। এ কথাও আজ স্বতঃসিদ্ধ যে শিশুদের মধ্যে ভালো এবং খারাপ এই দুই সম্ভাবনাই নিহিত থাকে, খারাপের ওপর ভালো যেন জাঁকিয়ে বসতে পারে সেজন্যে শিশুদের সুরক্ষা, শৃঙ্খলা ও সুস্থ পারিবারিক পরিমণ্ডল প্রয়োজন।

ঐতিহাসিক ফিলিপ এরিএস বয়ঃসন্ধিকালের যে জনপ্রিয়তা, ও গুরুত্বের কথা বলেছেন, সেটি কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের বাস্তবতা; আমাদের বাংলাদেশে শৈশব ও বয়ঃসন্ধিকালের গুরুত্ব সাধারণ মানুষের উপলব্ধি ও প্রাত্যহিক জীবন চর্চায় এমন করে এখনও আসেনি। পরিবারে ও বিদ্যালয়ে শিশু-কিশোরদের ওপর নির্যাতন এবং বড়দের ইচ্ছে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার নানা ঘটনা, ও তথ্য-উপাত্ত প্রতিনিয়ত খবরের কাগজ, অনলাইন পত্রিকা ও গবেষণা প্রবন্ধে ছাপা হয়। কটু ভাষায় গালাগাল দেওয়া, মারধর করা, ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনও কাজ করতে বাধ্য করার কারণে শিশু ও কিশোরদের ওপর নানা ধরনের মানসিক চাপ তৈরি হয়; যার প্রতিক্রিয়ায় বয়ঃসন্ধিকালের অনেক ছেলেমেয়ে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়, সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের ধারা থেকে বিচ্যুত হয়, কোনও কোনও সময় তারা আত্মহত্যাও করে বসে।

এ ধরনের ঘটনাসমূহ প্রমাণ করে যে সন্তানের শৈশব, ও বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক, মানসিক, যৌন ও বুদ্ধিবৃত্তিক সুস্থ বিকাশের গুরুত্ব সম্পর্কে বাংলাদেশের অধিকাংশ বাবা-মা হয় সম্পূর্ণভাবেই অজ্ঞ, অথবা তাদের জ্ঞান পর্যাপ্ত নয়, অথবা তারা মনে করেন যে মারধর না করলে সন্তানকে মানুষ করা যাবে না। তারা নিজেরাও এই পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন, তাদের সন্তানরাও একইভাবে বেড়ে উঠবে বলে তাদের বিশ্বাস। এই ধরনের একটি প্রচলিত কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ ধারণা নিয়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ দম্পতি পিতামাতা হিসেবে প্যারেন্টিং শুরু করেন। বকাঝকা না দিয়ে, মারধর না করে, শরীর, ও মনের ওপর কোনও চাপ সৃষ্টি না করে সন্তানকে বড় করার পশ্চিমা কিন্তু আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি  সম্পর্কে বাংলাদেশের অধিকাংশ বাবা-মায়ের কোনও ধারণা নেই বললেই চলে। তবে পরিবর্তন আংশিকভাবে হলেও এসেছে শিক্ষিত, বিত্তবান ও সচেতন পরিবারগুলোতে। আর বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে আইন-কানুনগুলোতে; যেমন, ২০১৩ সালের শিশু আইন এবং উচ্চ আদালতের বিভিন্ন রায়ে।        

বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দৃশ্যমান হচ্ছে গত ৩/৪ দশক ধরে। প্রধানত কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের সমাজে শিশু ও কিশোরেরা ছিল নদী ও ধানক্ষেতের মতো প্রকৃতির অংশ। মা-মুরগি তার বাচ্চাদের যেভাবে আগলে রাখে, যুবক-যুবতীরা এ সমাজে সেভাবে সুরক্ষা পেতো। কিন্তু দ্রুত এটি উধাও হতে শুরু করলো আশির দশক থেকে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কারণে কৃষিজমি হ্রাস, নদীভাঙন, ভূমির অবক্ষয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেলেন; জীবন ও জীবিকার সন্ধানে ব্যাপক হারে তারা নতুন করে গড়ে ওঠা শহরগুলোতে অভিবাসন শুরু করলেন। মূলত তারা বসতি গড়ে তুললেন রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরে, যেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে।

সর্বহারা মানুষেরা তাদের পরিবার নিয়ে শহরের বস্তি, ফুটপাত, বাস বা ট্রেন স্টেশনে গিয়ে আশ্রয় নিলেন এবং এখানে তাদের জীবনমান হলো মানবেতর। গ্রামীণ ও কৃষিভিত্তিক জীবনে যে শিশুরা ছিল নদী, ধানক্ষেত, পাখি ও গাছদের মতো; যাদের বখে যাওয়া, ও দুরন্তপনাকে ‘নিষ্কলুষতা’ ও ‘সারল্যে’র চাদরে ঢেকে রাখা হতো; সেই শিশুরা বস্তি ও ফুটপাতের পরিবেশে এসে অপরাধের শিকারে পরিণত হলো। নব্বই-এর দশকের মাঝামাঝি ভাগ্যবিড়ম্বিত কত শিশু অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল, সে সংখ্যাটি কেউ জানে না। শুধু যে সব কিশোর কারাগারে এবং যে সব শিশু সংশোধন কেন্দ্রে মানবেতর জীবনযাপন করছিল, তাদের সংখ্যা দেখে আন্দাজ করা গিয়েছিল যে বাংলাদেশের কিশোর অপরাধ বাড়ছে।

কয়েক দশক ধরে কিশোর অপরাধের যে বিস্তৃতি হচ্ছিল, ২০১৭ সালে এসে ‘গ্যাং কালচার’ নামে তার একটি শাখা অভিভাবক, ও নাগরিকদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করলো। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় কিশোর গ্যাং কর্তৃক হত্যাকাণ্ড, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, নারীদের উত্ত্যক্ত করা, হর্ন বাজিয়ে দলবেঁধে মোটরসাইকেল দিয়ে মহড়া দেওয়ার অনেক ঘটনায় শঙ্কিত হলেন সবাই। একবিংশ শতাব্দীর স্মার্টফোন, ফেসবুক, টিকটক, সহজলভ্য পর্নোগ্রাফি এবং মুভি ও ভিডিও গেমসে সহিংস কনটেন্ট দেখার বাস্তবতায় দেখা গেলো সচ্ছল পরিবারের কিশোরেরা দলবেঁধে ভয়ংকর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।  কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হলো– যৌথ পরিবার ভেঙে পড়া; পারিবারিক, ও সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাওয়া; কিশোরদের মধ্যে হিরোইজমের প্রভাব; স্মার্টফোন, মোটরসাইকেল ও অস্ত্রের সহজলভ্যতা; কিশোরদের রাজনৈতিক ব্যবহার; সন্তানের ওপর বয়োজ্যেষ্ঠ ও অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে যাওয়া, সামাজিক নজরদারির অভাব ইত্যাদি।  

পরিশেষে বলতে চাই যে ইউরোপ, আমেরিকা, ব্রিটেনসহ পশ্চিমের দেশগুলোতে বয়ঃসন্ধিকালের আবিষ্কার; প্রত্যেকটি ছেলে এবং মেয়ের বয়ঃসন্ধিকালের হরমোনাল পরিবর্তন, তার আবেগ ও যৌনাকাঙ্ক্ষার ওপর এই পরিবর্তনের অভিঘাত; শৈশব ও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার মধ্যবর্তী ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধ ও উত্তাল সময়ের শারীরিক, মানসিক, ও বুদ্ধিবৃত্তিক নানা টানাপোড়েন প্রত্যেকটি ব্যক্তির জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়ের নানা ঘটনা এবং ক্রটিপূর্ণ মানসিক, ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ পরবর্তী জীবনে জটিলতা তৈরি করে, কেউ সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্যুত হয়ে যেতে পারে, কেউ কেউ জড়িয়ে পড়তে পারে ভয়ংকর অপরাধে।

বাড়বাড়ন্ত কিশোর অপরাধ এবং গ্যাং কালচার থেকে সুরক্ষা পেতে হলে আমাদের প্রত্যেকটি শিশুর শৈশব, কৈশোর ও বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক, মানসিক, যৌন ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ওপর জোর দিতে হবে। সাথে সাথে যেসব সামাজিক, অর্থনৈতিক, ও রাষ্ট্র কি অসঙ্গতির কারণে কিশোর অপরাধ বাড়ছে, সচ্ছল পরিবারের কিশোরেরা ‘গ্যাং কালচারে’ জড়িয়ে পড়ছে, আর কিশোরেরা রাতারাতি বিখ্যাত হওয়া বা টাকা উপার্জনের লোভে টিকটক বা ডিজে পার্টি কালচারের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে বা কোথাও কোথাও প্রতারণার শিকার হচ্ছে; সেই অসঙ্গতিগুলো চিহ্নিত করে প্রত্যেকটি শিশুকে সুস্থ স্বাভাবিক পরিবারে বেড়ে ওঠার ব্যবস্থা করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রকে এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে যাতে সব শিশু ও কিশোরের  শারীরিক, মানসিক, ও বুদ্ধিবৃত্তিগুলো যথাযথভাবে বিকশিত হতে পারে; প্রত্যেকটি শিশুই যেন সুনাগরিক হতে পারে, প্রতিটি কিশোরী ও কিশোর যেন হয়ে উঠতে পারে মানবিক বোধসম্পন্ন সুস্থ-স্বাভাবিক ও সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে।  

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
পার্বত্য তিন উপজেলার ভোট স্থগিত
পার্বত্য তিন উপজেলার ভোট স্থগিত
কৃষিজমির উপরিভাগ কাটার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ
কৃষিজমির উপরিভাগ কাটার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ
রাজধানীর শ্যামবাজার ঘাটে লঞ্চে আগুন
রাজধানীর শ্যামবাজার ঘাটে লঞ্চে আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ