X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাংবাদিকতা নিয়ন্ত্রণে নতুন আইন ও কিছু কথা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২২ জুন ২০২২, ১৭:৩২আপডেট : ২২ জুন ২০২২, ১৭:৩২

নির্ভীক ও তথ্যসমৃদ্ধ সংবাদ পরিবেশন ছাড়া নাগরিকদের পক্ষে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব। কাজটা গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের। কিন্তু কোথায় যেন একটা পক্ষ আছে, যারা চায় আইন আর আইন যেন সাংবাদিকতায় সব কথা চলে না আসে। এ দেশে অসংখ্য আইন আছে সাংবাদিকদের ওপর নিয়ন্ত্রণের জন্য। এখন নতুন আরও একটি আইনের খসড়া অনুমোদিত হয়েছে। এর নাম ‘দ্য প্রেস কাউন্সিল (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, ২০২২’। বলা হচ্ছে, অপসাংবাদিকতা দূর করতে এই আইনের আওতায় সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে অর্থদণ্ড করতে পারবে প্রেস কাউন্সিল।

কিছু দিন আগেই বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বলেছিলেন, সাংবাদিকেরা অন্যায় করলে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রেখে একটি আইন হচ্ছে। সাংবাদিকরা প্রতিবাদ করেন, তথ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। তবে ঠিকই আইনটির অনুমোদন দেওয়া হলো, যদিও ১০ লাখ টাকার জরিমানার বিধানটি রাখা হয়নি, বলা হয়েছে জরিমানার পরিমাণ ঠিক করবে প্রেস কাউন্সিল।

বাংলাদেশে সাধারণভাবে সাংবাদিকদের ওপর নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনের অভাব নেই। তারপরও কেন এমন আইন হতে যাচ্ছে তা নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে উদ্বেগ কাজ করছে। ১৯টিরও বেশি আইন আছে সাংবাদিকতা নিয়ন্ত্রণের জন্য। এরমধ্যে ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বহু সাংবাদিক গ্রেফতার হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন এবং এই আইন এক মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে সাংবাদিক সমাজের জন্য। তাই হঠাৎ করে নতুন আরেক আইনের কথা শুনে সাধারণ সাংবাদিক সমাজে এক প্রকার ভয় কাজ করতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করতে হবে, এমন বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত নেই সাংবাদিকদের। ১৯৭৪ সালে প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট হয়েছিল। কাউন্সিল নিশ্চিত করতে চায় দেশে যেন নীতি-নৈতিকতা মেনে সাংবাদিকতা হয়। কিন্তু সেটির জন্য এরকম খড়গ নিয়ে উপস্থিত হওয়া কি কাউন্সিলের কাজ? সারা দেশে সাংবাদিকরা যখন ভূমিদস্যু, দুর্নীতিবাজ, রাজনৈতিক মাস্তান চক্র, কালোবাজারি, মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী এমনকি আমলাতন্ত্রের দ্বারা নির্যাতিত হয়, সে ব্যাপারে কোনোদিন কি প্রেস কাউন্সিল কোনও ভূমিকা রেখেছে? আর্টিক্যাল নাইনটিন বলছে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাংলাদেশে অন্তত ১১৮ জন সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছেন। প্রেস কাউন্সিল এ ব্যাপারে কোনও বক্তব্য দিয়েছে?

প্রস্তাবিত আইনে কাউন্সিল কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ সংশ্লিষ্ট পত্রিকায় প্রকাশের বিধান নতুন যুক্ত করা হয়েছে। এটিকে আমরা স্বাগত জানাই।  কিন্তু যখন শুনি যে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের হানিকর বা প্রেস কাউন্সিলের আচরণবিধিমালা পরিপন্থী সংবাদ, প্রতিবেদন, কার্টুন ইত্যাদি প্রকাশের দায়ে কোনও সংবাদপত্র বা সংবাদ সংস্থার বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নিতে পারবেন। সংবাদ সংস্থা বলতে প্রিন্ট মিডিয়া এবং সব ডিজিটাল মিডিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কার্টুন যদি প্রিন্ট বা ডিজিটাল মিডিয়াতে দেন আর সেটা যদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু হয় তাহলে তো সেটা আপনার অপরাধ হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কথাগুলো এমন যে এগুলোর ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের সময় অপপ্রয়োগ হতে পারে বেশুমার। 

এই সবগুলো বিষয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে। এবং সেই আইনটির প্রয়োগই যে অপপ্রয়োগ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা শুধু সাংবাদিক সমাজ নয়, পুরো জাতিই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। যার কারণে মন্ত্রী মুস্তাফা জব্বারকে এখন বলতে হয়, এই আইনের এমন প্রয়োগ হবে তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। এই একটি আইনের কারণে দেশের ভাবমূর্তি আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশ্নের মুখে। রিপোর্টার্স উইদাউট বডার্সের  ২০২২ সালের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা এক বছরে এক ধাক্কায় ১০ ধাপ নেমে গেছে ১৫২ থেকে ১৬২। 

প্রেস কাউন্সিলে সাংবাদিকদের প্রতিনিধি থাকে সম্পাদক পরিষদ, মালিকদের সংগঠন এবং ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন থেকে। প্রশ্ন জাগে, তারা কীভাবে এমন একটি আইনের পক্ষে মত দিলেন? প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বলছেন, সাংবাদিক প্রতিনিধিরা আইনটি অনুমোদন করেছেন। কিন্তু সাংবাদিক প্রতিনিধিরা বলছেন তারা জানেন না।

রাজনীতির সাথে সাংবাদিকতার সম্পর্ক বড় আকারে আছে, অতীতেও ছিল। অতীতের রাজনৈতিক নেতারা সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হলেও তাদের কণ্ঠস্বর প্রকাশের পরিসরটুকু দিতেন। এখন জেলায় জেলায় রাজনৈতিক নেতাদের ‘চামচা’রা সাংবাদিকদের শায়েস্তা করায় ব্যস্ত। তাদের হাতে আছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, নানা জায়গায় নেতারা সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর খড়গহস্ত। একটা ভয়ংকর অসহিষ্ণুতা সর্বত্র। নতুন আরেক আইন তাদের হাতে আরও অস্ত্র তুলে দেবে কিনা সেটা কি ভাববেন বিচারপতি নিজামুল হক?

এডমন্ড বার্ক সংবাদমাধ্যমকে ‘ফোর্থ এস্টেট’ বা চতুর্থ স্তম্ভ বলে অভিহিত করেছিলেন। গণতন্ত্র, আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয় রক্ষার কথা আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে। এটাও ঐতিহাসিকভাবে দেখা গিয়েছে যে সংবাদমাধ্যম চিরকাল প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভূমিকা নেয়। সমালোচনা করাটাই সাংবাদিকের কাজ, সরকারের মুখপাত্র হয়ে গুণকীর্তন করা নয়। আর সেই সমালোচনাকে গ্রহণ করার মধ্যেই আছে রাষ্ট্রীয় সুশাসনের ব্যবস্থা।

প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নতুন এসেছেন। প্রেস কাউন্সিল একটি বিচারিক প্রতিষ্ঠান। সেটা তারা নিশ্চিত করবেন যেন ভুক্তভোগীরা বেশি করে সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভের কথা জানিয়ে কাউন্সিলের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু তা না করে এমন একটা আইনের কথা ভাবছেন, যেন সাংবাদিক ও সম্পাদকদের ধরে-বেঁধে আনা যায়। সরকার ও সংবাদমাধ্যমের পারস্পরিক আলোচনার দরকার আগের চেয়ে অনেক বেশি। সরকারও নিশ্চয়ই চাইবে না যে শুধু একমুখী প্রচার হোক। রাজনৈতিক পরিবেশটা অসহিষ্ণু হয়ে গেছে নানা কারণে। সেখানে কাউন্সিল নতুন আইনের নামে ঘি ঢালবেন নাকি স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ প্রশস্ত হোক সেটা চাইবেন, সেই সিদ্ধান্ত তার। 

প্রেস কাউন্সিল আধুনিক হোক, শক্তিশালী হোক কিন্তু ভাবনায় এটাও থাকুক যে সাংবাদিকতা এবং রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কে যেন ছেদ না পড়ে। একদম বন্ধ যেন হয়ে না যায় বিরুদ্ধ মত শোনার পথ।

লেখক: সাংবাদিক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হাজারীবাগে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু
হাজারীবাগে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু
ব্রাজিলিয়ান মিগেলের গোলে কষ্টে জিতলো কিংস
ব্রাজিলিয়ান মিগেলের গোলে কষ্টে জিতলো কিংস
তীব্র গরমে সুপার লিগে দুই দিন করে বিরতি
ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগতীব্র গরমে সুপার লিগে দুই দিন করে বিরতি
ড্রিমলাইনারের কারিগরি বিষয়ে বোয়িংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বিমানকে মন্ত্রীর নির্দেশ
ড্রিমলাইনারের কারিগরি বিষয়ে বোয়িংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বিমানকে মন্ত্রীর নির্দেশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ