X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

মহামান্য হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি

লীনা পারভীন
০২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৯:২৪আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৯:২৪

আমাদের সমাজে নারীর প্রতি এক ধরনের ‘প্রভুত্ব’ ফলানোর মতো দৃষ্টিভঙ্গি আছে– এটা সত্য। এই সত্য আমরা নারীরা প্রতি মুহূর্তে ঘরে বাইরে, পারিবারিক বা সামাজিক জীবনে উপলব্ধি করছি। এই রাষ্ট্র স্বাধীন রাষ্ট্র। এর মূলনীতি হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক অর্থাৎ, কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এখানে রাষ্ট্রীয় নীতিবিরোধী কাজ। ঠিক তেমনই, রাষ্ট্র আমাকে শিখিয়েছে কোনও প্রকার লিঙ্গ, বর্ণ, ধর্ম ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে বৈষম্য করা যাবে না। এই দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। রাষ্ট্রের চাকা সচল আছে নারী ও পুরুষের কাঁধে ভর করে।

অথচ এই নারীকেই নিত্যদিন নানা ধরনের হেনস্তার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। একজন নারী বা পুরুষ সে স্বাধীন হিসাবে জন্মলাভ করে। স্বাধীনভাবে জন্মলাভ করা মানুষটি যত বড় হতে থাকে তত শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে থাকে। পরিবার বা সমাজ এত এত বিধি-নিষেধ আরোপ করতে থাকে যেখানে নিজের মতো করে শ্বাস নিতেও অনুমতি লাগে বা কতটা জোরে বা আস্তে শ্বাস ফেলা যাবে সে নিয়েও বিধি আরোপ করতে পছন্দ করে আমাদের সমাজ। নারীর জোরে হাসা নিষেধ, জোরে চলা নিষেধ, কথা বলা নিষেধ, নিজের পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া নিষেধ। এত নিষেধের মধ্যেই আমাদের নারীরা নিজের চেষ্টায় এগিয়ে চলছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী হচ্ছে। নাসার সর্বশেষ আবিষ্কারের মধ্যেও ছিল আমাদেরই সমাজ থেকে জন্ম নেওয়া একজন নারী। অথচ আজকে এই একবিংশ শতকে এসে শুনতে হচ্ছে ছোট পোশাক পরলে বিজ্ঞানী হওয়া যায় না।

পোশাক হচ্ছে একজন ব্যক্তির স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়। কে কোথায় কেন কোন পোশাক পরবে বা পরবে না সেটা নিয়ে একজন মানুষকে আক্রমণ করার অধিকার কারোরই নেই। এটা বে-আইনি। কিছু দিন আগে নরসিংদী রেল স্টেশনে একজন নারীকে তার পোশাকের কারণে আক্রমণ করা হয়েছে এবং তার সঙ্গীদের মারধরও করা হয়েছে। সেই মামলায় একজন অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা হয়। সেই আক্রমণকারীও একজন নারী।

একই মামলায় জামিন শুনানিকালে হাইকোর্টের একজন বিচারকের কিছু ব্যক্তিগত আলাপ, হাইকোর্টের অভিমত বা অবজারভেশন বলে কিছু সংবাদমাধ্যমে এসেছিল। কী ছিল সেই আলাপে সেইটা আশা করি এই লেখার পাঠক সবারই জানা। পরে সব মাধ্যমের প্রতিবাদের ফলে মাননীয় হাইকোর্ট সেই বক্তব্য তাদের নয় বলেও জানিয়েছে এবং নারীরা কোন ধরনের পোশাক পরবে বা পরবে না এ নিয়ে যে বক্তব্য সামনে এসেছে তেমন কোনও আলোচনা শুনানিকালে হয়নি বলেও জানা গেছে।

বলে রাখা ভালো যে সেই অপরাধী নারীর জামিনও কিন্তু বাতিল হয়েছে। অর্থাৎ, পোশাকের কারণে কোনও মানুষের ওপর আক্রমণকে হাইকোর্ট অপরাধ হিসেবেই দেখছে। আমরা বুঝে নিলাম যে হাইকোর্টকে বিতর্কিত করার উদ্দেশ্যে একটি মহল এই প্রচারণা করে থাকতে পারে। কিন্তু অবাক কাণ্ড হচ্ছে, হাইকোর্টের অস্বীকার করার পরেও একটি মহল অত্যন্ত সুকৌশলে হাইকোর্টের বিতর্কিত বক্তব্যকে (তথাকথিত) সাধুবাদ জানিয়ে মানববন্ধন, র‍্যালি করছে। হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেই প্ল্যাকার্ডের ভাষা অত্যন্ত নিম্নমানের, নারীর প্রতি অবমাননাকর এবং নারীর মানবাধিকারকে হরণ করে। তারা যেভাবে নারীর পোশাক নির্ধারণ করে দিতে চাইছে এটি নিশ্চিতভাবেই সমাজে নারীর প্রতি চলে আসা ধর্ষণ বা নিপীড়নকে আরও অনেক বাড়িয়ে দেবে। নারী ধর্ষিত হয় তার পোশাকের কারণে এমন একটি ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলে আসছে অনেক দিন ধরে। বিশ্ববিদ্যালয় বা কোনও প্রতিষ্ঠানে যখন নারীর পোশাকের উসিলায় নারী নির্যাতনকে হালাল করার পাঁয়তারা দেখা যায় তখন নিশ্চিত করেই বলা যায় এটি আমাদের সংবিধান বা নারীর আইনি অধিকারের লঙ্ঘন।

আমি একজন নারী হিসেবে, একজন নাগরিক হিসেবে এমন কর্মকাণ্ডকে চ্যালেঞ্জ করছি। যারা হাইকোর্টের নাম দিয়ে নারীকে হেয় করছে, নারীর অধিকারকে “রুল আউট” করে দিতে চাইছে তারা হাইকোর্টকে অবমাননা করছে বলেই আমি মনে করি। এটি সরাসরি সংবিধান লঙ্ঘন। কারণ, আগেই বলেছি সংবিধানের কোথাও লেখা নেই, নারীরা তাদের ইচ্ছামতো পোশাক পরতে পারবে না। যে কেউ চাইলে তার ব্যক্তিগত মত দিতেই পারে, কিন্তু সেই মত যদি অন্যের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে তাহলে তার বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অধিকারের মধ্যে পড়ে। ছেলেদের জন্য যদি কোনও পোশাক নির্ধারণ করা না থাকে তাহলে নারীর জন্য কেন থাকবে? আমাদের সংস্কৃতি বা মূল্যবোধের নাম দিয়ে কেউ চাইলেই কি নারীদের এভাবে প্রকাশ্যে অপমান করতে পারে? তাহলে কেন পারছে আজকে? কারা উসকে দিচ্ছে তাদের? কেন আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এদের বিরুদ্ধে পাবলিক নুইসেন্স তৈরির অভিযোগ আরোপ করবে না?

সবশেষে আমি মহামান্য হাইকোর্টের কাছে তাদের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে যে মানববন্ধন করা হচ্ছে তার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য আশা করছি। আমি জানি না আমার এই চাওয়া আদালত অবমাননা হবে কিনা। আমার নাগরিক অধিকারের সবশেষ জায়গা হচ্ছে আমাদের হাইকোর্ট। সেই জায়গাটিকে আমরা নিরাপদ ভাবতে চাই। তা না তাহলে আমাদের প্রতি চলে আসা নিপীড়নের সহায় আর কে হবে?

লেখক: কলামিস্ট

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘তীব্র গরমে’ চু্য়াডাঙ্গা ও পাবনায় ২ জনের মৃত্যু
‘তীব্র গরমে’ চু্য়াডাঙ্গা ও পাবনায় ২ জনের মৃত্যু
ডাগআউট থেকে রিভিউ নিতে বলায় ডেভিড, পোলার্ডের শাস্তি
ডাগআউট থেকে রিভিউ নিতে বলায় ডেভিড, পোলার্ডের শাস্তি
হিট অ্যালার্ট উপেক্ষা করে কাজে নামতে হয় যাদের
হিট অ্যালার্ট উপেক্ষা করে কাজে নামতে হয় যাদের
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ